রুকু – ৫
৪২। আল্লাহ্ই [ মানুষের ] আত্মাকে হরণ করেন মৃত্যুর মাধ্যমে ৪৩০৬; এবং যাদের মৃত্যু আসে নাই,তাদেরটাও হরণ করেন নিদ্রার সময়ে ৪৩০৭। যাদের উপরে মৃত্যুর হুকুম হয়ে যায়, তিনি তাদের [পুণরায় জীবনে ফিরে যাওয়া থেকে ] বিরত রাখেন ৪৩০৮। কিন্তু অপর সকলকে [ তাদের দেহের মাঝে ] ফিরিয়ে দেন , নির্দ্দিষ্ট সময়ের জন্য। অবশ্যই এতে নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা চিন্তাশীল ৪৩০৯।
৪৩০৬। ঘুম , স্বপ্ন ও মৃত্যুর রহস্য আজও মানুষের অজ্ঞাত। এ এক আকর্ষণীয় প্রহেলিকা। সম্ভবতঃ এই রহস্যের সমাধান মানুষের জ্ঞান , বিজ্ঞানের বাইরে। ঘুম , স্বপ্ন ও মৃত্যুর সম্বন্ধে বহু ধরণের কুসংস্কার , কাল্পনিক ধারণা এবং মনঃস্তাত্বিক গবেষণা বিদ্যমান। কিন্তু তা কোনটাই সম্পূর্ণ ঘটনাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয়। এই আয়াতে সামান্য কয়েকটি ছত্রে ঘুম ও মৃত্যুর ধর্মীয় মতবাদকে তুলে ধরা হয়েছে। দৈহিক সকল ক্রিয়া কর্মের সমাপ্তির মাধ্যমে মৃত্যু ঘটে অর্থাৎ দৈহিক মৃত্যু ঘটে, কিন্তু আমাদের আত্মার মৃত্যু ঘটে না ; তা অমর। তার অবস্থান তখন হয় পরলোকে বা আধ্যাত্মিক জগতে। আল্লাহ্ আমাদের আত্মাকে গ্রহণ করেন, যা আর পৃথিবীতে ফিরে আসে না।
৪৩০৭। দেখুন আয়াত [ ৬ : ৬০ ]। ঘুম কি ? এ প্রশ্ন বহু যুগ থেকে মানুষ করে আসছে। মানুষ , জীব-জন্তু , কীট পতঙ্গ সকলেই ঘুমায়। মানুষ ব্যতীত অন্য প্রাণীর ঘুমকে এ ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ঘুমকে বলা যায় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যবিরতি বিশেষ। কারণ ঘুমের সময়ে মানুষ বা প্রাণী কোনও কিছুই উপলব্ধি করতে পারে না , এই দৃশ্যমান পৃথিবী তাদের সম্মুখ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ ও প্রাণীকুলের দৈহিক অন্যান্য ক্রিয়াকর্ম যেমন : রক্ত সঞ্চালন , পরিপাক ক্রিয়া, শারীরিক বর্দ্ধন , নিশ্বাস প্রশ্বাস ইত্যাদি জৈবিক ক্রিয়াকর্ম স্বাভাবিক ভাবেই সম্পন্ন হতে থাকে , যদিও তা ঘটে অত্যন্ত ধীর গতিতে। ঘুমের সময়ে শুধুমাত্র স্নায়ুতন্ত্রের বিশ্রাম ঘটে। এই একটি ব্যাপারই মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে সার্বজনীন যা উভয় শ্রেণীর মধ্যেই ঘটে থাকে। সম্ভবতঃ এ সত্য বৃক্ষরাজির জন্যও প্রযোজ্য, কারণ, ধারণা করা হয় বৃক্ষরাজিরও স্নায়ুতন্ত্র বিদ্যমান। মানুষের বেলায় স্নায়ুতন্ত্রের বিশ্রামের সাথে সাথে মানসিক দক্ষতারও বিশ্রাম ঘটে। যে কোনও প্রকার মানসিক ক্রিয়াকর্ম বন্ধ হয়ে যায় সত্য কিন্তু এ সময়েই মানুষ সাধারণতঃ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন সাধারণতঃ দুধরণের হয়। এক ধরণের স্বপ্নে প্রতিদিনের জীবনের বিভিন্ন কার্যের প্রতিফলন ঘটে। অবচেতন মনের প্রতিফলন এসব স্বপ্নে ঘটে থাকে। জাগ্রত অবস্থায় সাধারণ বিবেক বুদ্ধিতে যে সব ঘটনা অবাস্তব মনে হয়। চেতনায় যা অবাস্তব ,অবচেতন মন তাকেই ধারণ করে স্বপ্নে। সাধারণ মানুষ এ রকম স্বপ্নই দেখে থাকে সাধারণতঃ। তবে কখনও কখনও কদাচিৎ মানুষ অন্য আর এক ধরণের স্বপ্ন দেখে থাকে – যার কোনও ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারে না। এ সব স্বপ্নে হয় ভবিষ্যতকে দেখা যায় নতুবা যা মানুষের অগোচরে তার দেখা মেলে। যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তারা জানেন বৈজ্ঞানিক কেকুল বহু সাধনা ও গবেষণা করেছিলেন জৈব রসায়নের মূল পদার্থ বেন্জিনের রাসায়নিক সুত্র আবিষ্কারের জন্য। দিন রাত্রের পরিশ্রমও যখন সফল হলো না ,তখন একদিন তিনি স্বপ্নে বেনজিনের সুত্রটি দেখতে পান এবং এই আবিষ্কারের ফলে তিনি রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান। এর ব্যাখ্যা কি ? মানুষের প্রাণ বা আত্মা বা ব্যক্তিত্ব যাই বলা হোক না কেন – তা আমাদের এই নশ্বর দেহের উর্দ্ধে অবস্থান করে। নশ্বর দেহ সে তো পশুতুল্য। পশুর যা কাম্য আমাদের দেহেরও সেই একই কাম্য। মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব তা তার দেহের জন্য নয়। তা হচ্ছে তার এই নশ্বর দেহের মাঝে পরমাত্মার অংশ আত্মার অবস্থানের জন্য। ঘুমের মাঝে আত্মা দেহকে ত্যাগ করে অন্য জগতে চলে যায় – এই আয়াতে সেই কথাই বলা হয়েছে। আল্লাহ্ তাদের সকলের প্রাণ বা আত্মাকে হরণ করে থাকেন। সে হিসেবে ঘুমন্ত ব্যক্তি ও মৃত ব্যক্তির অবস্থান একই – কারণ উভয়ের আত্মাই আল্লাহ্র সন্নিকটে যায়। কবিতার ভাষাতে ঘুমকে বলা হয়েছে “Twin brother of Death.” অতিপ্রাকৃত যে সব স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে তার ব্যাখ্যা করা তখনই সম্ভব যদি ঘুমের এই ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করা হয়।
৪৩০৮। ঘুমকে মৃত্যুর যমজ ভাই রূপে সম্বোধন করা হয়েছে। ঘুমের মাঝে আমাদের আত্মাকে অস্থায়ীভাবে নশ্বর দেহের রক্তমাংসের বন্ধন মুক্ত করা হয়। আল্লাহ্ তাদের আত্মাকে হরণ করেন। যারা ঘুমের মাঝে পরম শান্তিতে মৃত্যুবরণ করেন, তাদের আত্মা আর তাদের দেহের মাঝে ফিরে আসে না। পরিণতিতে তারা মৃত্যুবরণ করে। তাদের নশ্বর দেহ ধ্বংস হয়ে যায়। যাদের পৃথিবীর জন্য আরও সময় বাকী থাকে, তাদের আত্মাকে পুণরায় দেহের মাঝে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এভাবেই তারা তাদের পৃথিবীর মেয়াদকাল পূর্ণ করে থাকে।
৪৩০৯। ঘুম ,মৃত্যু ইত্যাদি সম্বন্ধে যদি মানুষ গভীর ভাবে চিন্তা করে, তবে তার সম্মুখে আধ্যাত্মিক বা পারলৌকিক জীবনের অনেক সত্যের রূপ উদ্ভাসিত হবে। যেমনঃ
১) পৃথিবীর জীবনে জীবন ও মৃত্যু যা আমরা সর্বদা প্রত্যক্ষ করে থাকি তাই-ই জীবনের শেষ কথা নয়।