রুকু – ৫
৩৫। আল্লাহ্ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর জ্যোতি ২৯৯৬, ২৯৯৭। তাঁর জ্যোতির উপমা হলো এই যে, যেমন একটি দীপাধার [কুলুঙ্গী] যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ। বাতিটি কাঁচে ঘেরা, ২৯৯৮ কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ ২৯৯৯ ইহা প্রজ্জ্বলিত করা হয় পূত পবিত্র জলপাই বৃক্ষের তেল দ্বারা যা না পূর্বদেশীয় না পশ্চিম দেশীয় ৩০০০, ৩০০১। তাহার তেল এমনি উজ্জ্বল যে আগুন স্পর্শ করার পূর্বেই যেনো জ্বলে ওঠে ৩০০২। জ্যোতির উপরে জ্যোতি। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা পথ নির্দ্দেশ করেন তাঁর জ্যোতির দিকে ৩০০৩। আল্লাহ্ মানুষের জন্য উপমাসমূহ স্থাপন করেন।এবং আল্লাহ্ সকল বিষয়ে অবগত আছেন।
২৯৯৬। সংস্কৃতিবান ও সুরুচীসম্পন্ন পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের নিদ্দের্শনা দানের পরে এই চমৎকার গৌরবময় আলোর উপমা বর্ণনা করা হয়েছে। এই আলোর উৎস হচ্ছে আল্লাহ্র সম্বন্ধে অতীন্দ্রিয় সত্যকে অনুভবের ক্ষমতা যা স্তরে স্তরে গঠিত। এই আয়াতটি আধ্যাত্মিক রহস্যে সমৃদ্ধ , যার প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে পুস্তকের পরে পুস্তক রচনা করা হয়েছে। এখানে [ মওলানা ইউসুফ আলী ] খুব সহজ সরল ভাবে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন।
২৯৯৭। অন্ধকার ও আলো। অন্ধকারকে অপবিত্র , কুৎসিত, পাপের উৎসরূপে কল্পনা করা হয়। অপরপক্ষে আলো হচ্ছে সত্য, সুন্দর, পবিত্রতা, ন্যায় ও পূণ্যের প্রতীক। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক যে আলো, তার উৎস আল্লাহ্। আল্লাহ্র আলোর প্রতিফলনই হচ্ছে স্বাভাবিক আলো। আল্লাহ্ নিরাকার , অসীম শক্তির উৎস। তাঁর সম্বন্ধে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবে অনুভব করা সম্ভব নয়। তাঁর অস্তিত্ব শুধুমাত্র অনুভব করা সম্ভব আত্মার অস্তিত্বের মাঝে, যেখানে আত্মাও নিরাকার। যদি আল্লাহ্র সম্বন্ধে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ধারণা করতে হয়, তবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর মধ্যে আলো হচ্ছে সর্বাপেক্ষা পবিত্র ও সুন্দর বস্তু , যেখানে সামান্য হলেও তুলনা করা যায়। তবে স্বাভাবিক আলো, যার সাথে আমরা প্রতিদিনের জীবনে অভ্যস্ত , আল্লাহ্র নূরের সাথে তার তুলনায় কিছু অসুবিধা আছে। স্বাভাবিক আলোর অসুবিধাগুলি নিম্নরূপ : ১)জাগতিক আলোর নিজস্ব অস্তিত্ব নাই। সর্বদা তা কোনও উৎস থেকে উৎসারিত হবে। অর্থাৎ জাগতিক আলো উৎসের উপরে নির্ভরশীল। ২) জাগতিক আলো স্থির নয়, তা সর্বদা অতিবাহিত হচ্ছে। সকালে সূর্যের নরম সোনার আলো, দুপুরে তীব্র হয়ে অপরাহ্নে অস্তগামী সূর্যের সাথে শেষ হয়ে যায়। যদি আমরা বিজ্ঞানের ভাষায় আলোকে গতির বা শক্তির রূপ হিসেবে কল্পনা করি, তা হলে দেখা যায় আলো স্থির নয়। আলোর সাথে গতির নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। ৩) জাগতিক আলো স্থান ও কালের সাথে সম্পর্কিত। এর গতি ১,৮৬,০০০ মাইল প্রতি সেকেন্ডে। সূদূর আকাশে এমন তারাও বিরাজমান যার আলো উপরের গতিতে বিচ্ছুরিত হয়েও আমাদের পৃথিবীতে পৌঁছুতে হাজার বছর লেগে যায়। উপরে জাগতিক আলোর যে সব দোষত্রুটি বর্ণনা করা হলো , আল্লাহ্র নূর তার সকল কিছুর উর্দ্ধে। জাগতিক আলো আল্লাহ্র সত্তার জন্য প্রযোজ্য নয়। আল্লাহ্ নভোমন্ডল ও এর মাঝে যা কিছু সব সৃষ্ট বস্তুর নূর দাতা।
২৯৯৮। আল্লাহ্র নূরের প্রকাশকে তিনটি উপমার সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে, এগুলি হচ্ছে দীপাধার, প্রদীপ এবং কাঁচ। ১) “Miskkat” বা দীপাধার। প্রাচ্যদেশে দেয়ালে সামান্য খাঁজকেটে প্রদীপ স্থাপনের বন্দোবস্ত করা হয়। এই খাঁজটি বা দীপাধারটি মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে স্থাপন করা হয়ে থাকে, যেখানে প্রদীপটিকে রাখা হয়। এই বন্দোবস্ত ইলেকট্রিসিটি আবিষ্কারের পূর্বে ছিলো। উচ্চে স্থাপন করার ফলে প্রদীপের আলো সমস্ত ঘরকে আলোকিত করতে সক্ষম হতো। দীপাধারের পিছনের ও পাশের দেয়াল যদি সাদা রং করা থাকে , তবে আলোকে আরও সহজ ও সুন্দরভাবে প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়। দীপাধারের সম্মুখভাগ খোলা যা হচ্ছে কোনও দেয়াল শূন্য। জাগতিক দীপাধারকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আধ্যাত্মিক আলোর দীপাধারকে বোঝানোর জন্য। আত্মাকে আলোকিত করার জন্য যে আলো সে আলোর উৎস জাগতিক বস্তুর বহু উর্দ্ধে অবস্থিত। দীপাধার যেরূপ উচ্চে স্থাপন না করলে সমগ্র ঘরকে আলোকিত করতে সক্ষম হয় না, ঠিক সেরূপ জাগতিক বিষয় থেকে নিজেকে উর্দ্ধে স্থাপন না করলে আল্লাহ্র নূরে হৃদয় আলোকিত হয় না। মোমেন বান্দার হৃদয় হচ্ছে এরূপ দীপাধার। পার্থিব ও জাগতিক বিষয়বস্তু থেকে নিজেকে উর্দ্ধে স্থাপন করতে পারলেই , মোমেন বান্দার অন্তর আল্লাহ্র নূরকে অন্তরের দীপাধারে ধারণ করার ক্ষমতা লাভ করে। আল্লাহ্র নূর হচ্ছে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ ও অন্যান্য নিদর্শন। মোমেন বান্দার অন্তরে আল্লাহ্র নূরের হেদায়েত আসে বিচিত্র উপায়ে। এই নূর সকলের জন্যই অবারিত কিন্তু যারা বিশ্বাস করে না এবং গ্রহণে অসম্মত তাদের জন্য এই নূর প্রবেশের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। দীপাধারটি মোমেন বান্দার হৃদয়ের প্রতীক স্বরূপ। দীপাধার যেরূপ প্রদীপকে ধারণ করে, মোমেন বান্দার হৃদয় সেরূপ আল্লাহ্র নূরকে ধারণে সক্ষম। ২)প্রদীপ যেরূপ আলোর উৎসের মূল কেন্দ্র বিন্দু, আল্লাহ্র নূর সেরূপ আধ্যাত্মিক বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু। প্রদীপ ব্যতীত যেরূপ দীপাধার অর্থহীন। ঠিক সেরূপ আল্লাহ্র নূর ব্যতীত আধ্যাত্মিক সত্য অস্তিত্ববিহীন। দীপাধার যেরূপ শুধুমাত্র প্রদীপ স্থাপনের জন্য নির্মিত ; ঠিক সেরূপ নূরে হেদায়েত মোমেন বান্দার অন্তরের সাথে সম্পর্কিত। ৩) কাঁচ একটি স্বচ্ছ পদার্থ যার মধ্য দিয়ে আলো খুব স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে। দীপাধার যদি কাঁচের আবরণে ঢাকা থাকে, তবে মূল প্রদীপ পোকামাকড় ও বাতাসের ঝাপটা থেকে রক্ষা পায়। অপর পক্ষে কাঁচ স্বচ্ছ হওয়ার দরুণ আলোর বিকিরণে কোনও বাঁধার সৃষ্টি করে না। যদিও কাঁচ তৈরী হয় জাগতিক অস্বচ্ছ পদার্থ যথা বালি, সোডা, পটাশ ইত্যাদি থেকে , কিণ্তু কাঁচ নিজে আলোর প্রতিসরণের জন্য স্বচ্ছ – অর্থাৎ কোনও বাঁধার সৃষ্টি করে না। ঠিক সেরূপ আল্লাহ্র নূর বা হেদায়েত বা নূরে-হেদায়েত যে নামেই আখ্যায়িত করি না কেন সেই সত্য যা মানুষের বা জাগতিক ভাষায় প্রকাশ করা হয় সাধারণ মানুষের বুদ্ধির সীমার মাঝে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য। দীপাধারের কাঁচের পর্দ্দা ভেদ করে দীপাধারের আলো যেরূপ বিচ্ছুরিত হয় ; ঠিক সেরূপ মানুষের জাগতিক ভাষাকে অতিক্রম করে আল্লাহ্র নূরে মোমেন বান্দার হৃদয়ে স্থান লাভ করে।