Site icon BnBoi.Com

প্রেতচক্র – অনীশ দাস অপু

প্রেতচক্র

প্রেতচক্র

 

অতৃপ্ত প্রেতাত্মা

আমি ডুবে যাচ্ছি! আমি ডুবে যাচ্ছি!

পানিতে ছিটকে পড়ার সাথে সাথে আতঙ্কিত হয়ে উঠল চেলসি এমারসন। মনে মনে আকুতি করে উঠল, আমি মরতে চাই না।

কিছুক্ষণ আগে, ন বছরের মেয়েটি তার বাবা-মার চল্লিশ ফুট লম্বা সেইল বোট সী ইয়ার ডেকে শুয়ে সূর্যস্নান করছিল। বোট নোঙর করা ছিল ওয়াকার্স বে তে, এটা বাহামার ছোট একটা দ্বীপ থেকে সিকি মাইল দূরে। চেলসি সাঁতার প্রায় জানেই না, ওর লাইফ জ্যাকেট পরে থাকার কথা ছিল। কিন্তু ডেকে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিল চেলসি। ঘুম ঘুম চোখে জেগে ওঠে ও, ভেষ্ট গায়ে চাপানোর বদলে হাতে ধরে রেখেছিল।

ইয়টের পেছনে, ডেকের ওপর হাঁটতে হাঁটতে কতগুলো পেলিক্যান পাখির উড়ে যাওয়া দেখছিল চেলসি। লক্ষ্য করেনি কোনদিকে যাচ্ছে। ডেকে গুটিয়ে রাখা রশিতে পা বেঁধে হোঁচট খায় ও, মাথাটা দারুণভাবে ঠুকে যায় ডেক ঘিরে রাখা রেইলিং-এ, প্রায় জ্ঞান হারাবার মতো অবস্থা হয় চেলসির। হাত থেকে খসে পড়ে লাইফ জ্যাকেট, টলতে টলতে কয়েক পা এগিয়েছিল চেলসি, তারপর রেইলিং থেকে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যায় ক্যারিবিয়ানের নীল-সবুজ পানিতে।

পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডুবে গিয়েছিল চেলসি। বুঝতেই পারেনি কী ঘটছে। নাকে পানি ঢুকতে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল ও, বাঁচার তাগিদে পানিতে দ্রুত হাত চালাতে লাগল ওপরে ভেসে ওঠার জন্যে। পানির ওপরে ওঠো, নিজেকে নির্দেশ দিল চেলসি। বাতাস দরকার তোমায়। না হলে মরে যাবে। পা চালাও চেলসি, পানিতে লাথি মারো! ভুস করে ভেসে উঠল ও, মুখ হাঁ করে বাতাস টানতে লাগল হাঁপাতে হাঁপাতে। কিন্তু সাহায্যের জন্যে চিৎকার করার আগে আবার পানির নিচে ডুবে গেল চেলসি।

ভেসে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা করল মেয়েটা, আতঙ্কে তালগোল পাকিয়ে গেল মাথা। পানিতে পড়লে কীভাবে উদ্ধার পাওয়া যাবে সে কথা একদম ভুলে গেল। শান্ত থাকতে পারছে না ও… চিৎ হয়ে শ্বাস বন্ধ করে থাকলে আপনা আপনি ভেসে উঠবে সারফেসে, এ কথা মনেই নেই। চেলসি শুধু বুঝতে পারছে ও পানির তলায় তলিয়ে যাচ্ছে এবং মৃত্যু অবধারিত।

হঠাৎ করেই কোত্থেকে যেন শরীরে শক্তি ফিরে পেল চেলসি। জানে হাতে সময় কম। সাগরের সাথে যুদ্ধে হেরে যাবার আশংকাই বেশি। শেষ চেষ্টা করল ও। ওপরে ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিল বাঁচাও! বাঁচাও! বলে। কিন্তু সে চিৎকারে জোর নেই। ইয়টে ঘুমিয়ে থাকা চেলসির বাবা-মার কানে পৌঁছুল না মেয়ের মরণ আর্তনাদ।

কেউ সাহায্য না করলে বাঁচতে পারবে না এতক্ষণে বুঝে গেছে চেলসি। আবার পানির নিচে তলিয়ে গেল ও, দম বন্ধ করে রইল। কিন্তু কতক্ষণ শ্বাস বন্ধ করে থাকা যায়? ফুসফুসে যেন আগুন ধরে গেল। আর পারব না আমি। সব শেষ। এবার সত্যি মারা যাচ্ছি আমি। লড়াই করে টিকে থাকার চেষ্টা বাদ দিল হতাশ চেলসি।

হঠাৎ, ভোজবাজির মতো কে যেন চেলসির টি-শার্ট ধরে টানতে লাগল, ওকে উপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পানিতে ভেসে ওঠার পরে বেদম কাশতে লাগল চেলসি। মুখ হাঁ করে বাতাস টানছে। ফুসফুসের আগুন নিভে গেল নিশ্বাস নিতে পেরে। ওহ্, থ্যাঙ্ক গুডনেস, কেউ আমাকে বাঁচিয়েছে। বিদ্বস্ত এবং প্রচণ্ড রকম দুর্বল চেলসি শুধু কোনোমতে বলতে পারল আমাকে ছেড়ে চলে যেয়ো না, তারপর ঘুরল ও। দেখবে কে তার রক্ষাকর্তা। যাকে দেখল তাকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না চেলসির।

কোনো মানুষ নয়- ওটা একটা তামাটে রঙের জার্মান শেফার্ড কুকুর। টি শার্ট কামড়ে ধরেছিল কুকুরটা। ছেড়ে দিল। চেলসি পাগলের মতো ওটার পেছনের একটা পা চেপে ধরল। জোরে জোরে পা দিয়ে স্ট্রোক মেরে মেরে ধীরে ধীরে সাঁতার কাটতে শুরু করল কুকুর, চেলসিকে নিয়ে এগোল তীরের দিকে।

অগভীর পানিতে পৌঁছে কুকুরটাকে ছেড়ে দিল চেলসি, হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে পড়ল তীরে, একটা পাথরের স্তূপের পাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। জ্ঞান হারিয়েছে। জ্ঞান ফিরল জার্মান শেফার্ডের জিভের স্পর্শে। ওর মুখ জিভ দিয়ে চাটছে কুকুরটা।

চেলসি জড়িয়ে ধরল কুকুরটার গলা। বারবার বলতে লাগল, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। প্রত্যুত্তরে লেজ নেড়ে সরে গেল কুকুর। তাকাল সী ইয়ার দিকে। উঁচু গলায় ডাকতে লাগল। চেলসি এখনো হাঁপাচ্ছে। বালুতে পিঠ দিয়ে শুয়ে থাকল ও। কুকুরটার ঘেউ ঘেউ থামার পরে উঠে বসল। দেখল চলে গেছে শেফার্ড। চারদিকে চোখ বুলাল ও। কোথাও চিহ্ন নেই ওর রক্ষাকর্তা কুকুরের।

এদিকে, সেইলবোটে, চেলসির বাবা-মা কেন এবং অ্যালেন ঘুম ভেঙে দেখলেন তাদের কন্যা লাপাত্তা। ডেকের ওপরে, নিচে মেয়েকে কোথাও না পেয়ে– তারা উচ্চস্বরে ডাকতে লাগলেন, চেলসি! চেলসি! কোথায় তুমি?

হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠলেন কেন। ষ্টার্নে চেলসির জ্যাকেট আছে শুধু। ও নেই।

মেয়ে আমার পানিতে পড়ে যায়নি তো! আঁতকে উঠলেন এলেন। তাঁরা এবার উন্মাদের মতো ডাকাডাকি শুরু করলেন মেয়ের নাম ধরে।

সাগর তীর বসে চেলসি শুনতে পেল ওদের ডাক। হাত উঁচু করে সে চেষ্টাতে শুরু করল, এই যে আমি এখানে!

ওই তো চেলসি! আনন্দে অ্যালেনের কেঁদে ফেলার জোগাড়। সাগর তীরে। ও গড। ও বেঁচে আছে!

লাফ মেরে নিজেদের ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে বসলেন কেন ও অ্যালেন, দ্রুত বৈঠা মেরে এগোলেন তীরের দিকে। ভীত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁরা, তীরে পৌঁছেই।

চেলসি, কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন বাবা। তুমি ঠিক আছ তো?

কেঁদে ফেলল চেলসি। আমি ইয়ট থেকে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যাই … ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে চলল ও।…ডুবে যাচ্ছিলাম… মনে হচ্ছিল মরে যাব… এমন সময় বিশালদেহী একটা কুকুর এসে আমাকে উদ্ধার করে। বলে হুহু করে কাঁদতে লাগল ও। অনেকক্ষণ কান্নার পরে বুকটা হালকা হলো চেলসির, কিভাবে রক্ষা পেয়েছে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিল।

ঘটনাটা অদ্ভুত, সোনা, বললেন অ্যালেন। চেলসি লক্ষ্য করল বাবা-মা পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছেন। বোঝাই যায় চেলসির গল্প বিশ্বাস করেন নি তারা।

আমার কথা বিশ্বাস হয়নি তোমাদের, না? জিজ্ঞেস করল চেলসি।

তুমি সুস্থ আছ সেটাই যথেষ্ট, বললেন কেন।

কুকুরটাকে দেখেছ তোমরা? জানতে চাইল ছোট্ট মেয়েটি। ওর ডাক শুনেছ?

না সোনা, শুনিনি, জবাব দিলেন অ্যালেন।

ওটা বড় একটা জার্মান শেফার্ড, বলল চেলসি। কালো, গায়ে গাঢ় বাদামী দাগ। কই যে গেল কুকুরটা!

বোটে চলল, বললেন মা।

সেদিন দুপুরে চেলসি নিচের ডেকে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, শুনল বাবা-মা ওর সাগরে পড়ে যাবার ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছেন।

আসলে কী ঘটেছিল বলে তোমার মনে হয়, কেন?

কোনো কুকুর যে ওকে উদ্ধার করেনি তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই, বললেন কেন। এদিকের উপকূলে অন্য কোনো বোট চোখে পড়েনি আমার। সাগর তীর খা খা করছে। যদিও দ্বীপের ওদিকটাতে একটা গ্রাম আছে। কিন্তু বালুতে আমি কোনো কুকুরের পায়ের ছাপ দেখতে পাইনি।

ঢেউয়ের কারণে পায়ের ছাপ মুছে যেতে পারে।

যদি সত্যি কুকুরটা পানির ধারে গিয়ে থাকে, তাহলে। সাগর সৈকত খুবই দীর্ঘ এবং খালি। কুকুরটাকে আমাদের চোখে পড়া উচিত ছিল-যদি না ওটা পানিতে সাঁতরে যায়। আর কোনো কুকুরই অমন কাজ করবে না।

কুকুরই যদি না ছিল তাহলে চেলসিকে রক্ষা করল কে?

আমার ধারণা চেলসি আতঙ্কিত হয়ে কুকুরের কথা ভেবেছে। ভেবেছে একটা কুকুর তাকে উদ্ধার করেছে। আসলে সে নিজের চেষ্টায় তীরে এসে পৌঁছেছে।

আর সহ্য হলো না চেলসির। সে দৌড়ে উঠে এল ওপরের ডেকে। গলা ফাটিয়ে বলল, তোমরা কে কী ভাবছ তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি জানি আসলে কী ঘটেছে। একটা জার্মান শেফার্ড রক্ষা করেছে আমার জীবন!

.

প্রায় আধা মাইল দূরে, ওয়াকার্স বের অপর প্রান্তে, ১২ বছরের র‍্যাচেল কাজ সাঁতার কাটার জন্যে বেরিয়ে পড়ল ওদের ভাড়া করা বীচ হাউজ থেকে। ওর পায়ে ফ্লিপার মাস্ক আর স্মরকেল। ছুটি শেষ হবার আর মাত্র একদিন বাকি। তারপর ওরা ফিরে যাবে নিজেদের বাড়িতে। র‍্যাচেল ছুটির শেষ সময়টুকু যতটা সম্ভব সাগরে সাঁতার কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা নাস্তা খেতে ব্যস্ত, র‍্যাচেল নেমে পড়ল সাগরে। ও খুব ভালো সাঁতার জানে। তীর থেকে পঁচাত্তর গজের মতো দূরে, একটা কোরাল রীফের দিকে এগিয়ে চলল ও। উপুড় হয়ে সাঁতার কাটছে র‍্যাচেল। চোখে পড়ল একটা ষ্টার ফিশ। ছয় ইঞ্চি লম্বা বাহু দিয়ে একটা চিংড়ি মাছ ধরে আছে ওটা। ষ্টার ফিশটাকে ভালো করে দেখার জন্যে গভীর দম নিয়ে পানির নিচে ডুব দিল র‍্যাচেল। ষ্টার ফিশের কাছে এসেছে, একটা ছায়া দেখতে পেল ও সাগর তলে। আতঁকে উঠল র‍্যাচেল। মাই গড! ওটা নির্ঘাৎ হাঙর। কিন্তু পরক্ষণে ভুল ভেঙে গেল ওর। ভালো করে তাকাতে দেখল হাঙর নয়, ওটা একটা কুকুর।

পানির ওপরে উঠে এল র‍্যাচেল, খুলে ফেলল মাস্ক। দেখল ওর কাছ থেকে ত্রিশ গজ দূরে তামাটে রঙের, গায়ে গাঢ় বাদামী ফুটকিঅলা একটা জার্মান শেফার্ড দ্রুতগতিতে সাঁতার কাটছে।

কুকুরটার পিছু পিছু সাঁতরাতে শুরু করল র‍্যাচেল। মনে পড়ে গেল বাবা-মাকে কথা দিয়েছে রীফ ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না ও। তাই পানিতে মাথা তুলে থাকা একখণ্ড পাথরের ওপরে উঠে বসল র‍্যাচেল।

কুকুরটা যাচ্ছে কোথায়? অবাক হয়ে ভাবল ও। উজ্জ্বল সূর্যালোকে চোখ ঝলসে যায়। র‍্যাচেল কপালের ওপর হাত রেখে ভুরু কুঁচকে তাকাল দিগন্তরেখার দিকে। আর কোনো ডাইভার বা সাঁতারু চোখে পড়ল না। আধখানা চাঁদের মতো বে-র ওধারে একটা ইয়ট ছাড়া অন্যকিছু দেখতে পাচ্ছে না র‍্যাচেল। লক্ষ্য করল একজন নারী আর একজন পুরুষ ইয়ট থেকে লাফিয়ে নামল একটা ডিঙিতে, তীরের দিকে এগোতে লাগল। ওখানে ছোট একটা মেয়ে ওদের দিকে হাত তুলে নাড়ছে। র‍্যাচেল অনুমান করল কুকুর এবং ওই মানুষগুলোর মধ্যে সম্ভবত কোনো সম্পর্ক নেই।

শিস দিল র‍্যাচেল। অ্যাই, কুকুর, এদিকে এসো। আবার শিস দিল ও, কিন্তু গতিপথ বদলাল না জার্মান শেফার্ড। একমনে সাঁতার কেটেই চলেছে।

হঠাৎ কুকুরটা ডেকে উঠল। পরপর তিনবার। খুশি খুশি গলা। যেন প্রভুকে বাড়ি ফিরে আসতে দেখেছে তার পোষা জানোয়ার। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল পানির নিচে।

কুকুরটা কই গেল? ওর কিছু হয়নি তো? কুকুরটার আবার দেখা মিলবে সে আশায় রইল র‍্যাচেল। কিন্তু এক মিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট গেল, তবু দেখা নেই ওটার।

ওহ্, মাই গড! চিৎকার করে উঠল র‍্যাচেল। কুকুরটা নির্ঘাৎ ডুবে মরেছে!

পাথরখণ্ড থেকে লাফিয়ে পানিতে নেমে পড়ল ও, ফিরে এল তীরে। তারপর এক ছুটে বাড়িতে। মা! বাবা! আমি বিরাট একটা কুকুর দেখেছি-জার্মান শেফার্ড-সাগরে সাঁতার কাটছিল। তারপর হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল পানির নিচে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিন্তু ওটাকে আর ভেসে উঠতে দেখলাম না। কুকুরটা ডুবেই গেল কি না! খোঁজ নিয়ে দেখব একবার?

দেখো। বললেন ওর বাবা। তবে জেট স্কি ব্যবহার কোরো।

কিছুক্ষণ পরে র‍্যাচেলের সঙ্গে বাবাও বেরিয়ে পড়লাম। যেখানে কুকুরটাকে শেষ মুহূর্তে দেখা গেছে, সে জায়গায় খোঁজাখুঁজি চালালেন। কিন্তু কোনো চিহ্ন নেই জার্মান শেফার্ডের। তীরে ফিরে এলেন ওরা। র‍্যাচেল অবাক হয়ে ভাবতে লাগল কুকুর সাগরে সাঁতার কাটতে যাবে কেন?

.

সেদিন সন্ধ্যায় দ্বীপের ওধারের শহুরেবাসীরা তাদের গ্রামের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে একটি বীচ পার্টির আয়োজন করল। খোলা আকাশের নিচে তৈরি করা হলো উনুন, আগুনে ঝলসাতে লাগল শামুক আর মাছের কাবাব। একটি ব্যাণ্ড দল বাজাচ্ছে রেগে সঙ্গীত, আর সব বয়সের মানুষ বাজনার তালে তালে নাচছে।

ওই পার্টিতে চেলসির সাথে পরিচয় হলো র‍্যাচেলের। এক বাহামিয়ান মহিলা র‍্যাচেলের কালো চুলে চমৎকার বিনুনি করে দিয়েছিল। ওটা দেখে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল চেলসি।

তোমার চুলের বিনুনি খুব সুন্দর হয়েছে, চেলসি বলল র‍্যাচেলকে। বিশেষ করে রঙিন পুঁতির কারণে আরো বেশি ভালো লাগছে।

ধন্যবাদ, বলল র‍্যাচেল। বাহামায় আজকেই আমার শেষ রাত। তাই অন্যরকম একটু সাজলাম আর কি। এরপর মেয়ে দুটি গল্পে মেতে উঠল। কে কিভাবে ছুটি কাটিয়েছে, কী রকম মজা করেছে এসব আর কি।

চেলসি তার নতুন বন্ধুর কাছে গল্প করছে দ্বীপের কোন্ কোন্ জায়গায় সে ঘুরেছে, র‍্যাচেলের চোখ আটকে গেল একটা জার্মান শেফার্ডের ওপর-তামাটে রঙের, গায়ে বেগুনি দাগ-ভিড়ের মাঝখানে দ্রুত পায়ে হাঁটছে।

সাগরে যে কুকুরটাকে আজ দেখেছি ওটা কি সেটা? ভাবছে র‍্যাচেল। চেহারা তো সেরকমই মনে হচ্ছে। যাক, ওটা সুস্থ আছে জেনে ভালো লাগছে। যাই, ভালো করে দেখে আসি কুকুরটার কী অবস্থা।

একটু উঠব, চেলসি, বলল র‍্যাচেল, ওই কুকুরটাকে দেখে আসি।

র‍্যাচেলের চোখ অনুসরণ করে চেলসিও দেখতে পেল জার্মান শেফার্ডকে। আরে ওই তো সে-ই! সেই কুকুরটা!

কুকুরটাকে দেখেছ আগে?

হ্যাঁ। সে এক লম্বা গল্প। আজ সকালে ও-ই আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। চলো তো যাই।

ছুটল ওরা। কুকুরটার পিছু নিল। ওটা একটা গলিতে বাঁক নিল। দাঁড়াল ঝকঝকে সবুজ রঙের একটা বাড়ির সামনে। বাড়িটির জানালাগুলো নীল। কুকুরটা এক লাফে সামনের বারান্দায় উঠল, শুয়ে পড়ল ওখানে।

সাবধানে কুকুরটার দিকে পা বাড়াল ওরা। লেজ নাড়ছে কুকুর। ওরা হাত বুলিয়ে দিল গায়ে। কিছু বলল না জার্মান শেফার্ড। চুপচাপ আদর খেতে লাগল। এটাই সেই কুকুর কি না ঠিক বুঝতে পারছি না, বলল চেলসি।

মানে?

চেলসি তখন গল্পটা খুলে বলল র‍্যাচেলকে। জানাল কীভাবে সেইল বোট থেকে পড়ে গিয়েছিল ও। ডুবে মারা যাচ্ছিল, একটা জার্মান শেফার্ড কুকুর ওকে জামা ধরে টেনে তীরে পৌঁছে দেয়। তারপর অদৃশ্য হয়ে যায় ওটা।

আশ্চর্য তো! চেঁচিয়ে উঠল র‍্যাচেল। আমি ওই একই রকম তামাটে বর্ণের, গায়ে বাদামী ফুটকিঅলা একটা কুকুরকে দেখেছি। সাগরে সাঁতার কাটছিল। তারপর ঘেউ ঘেউ করতে করতে ওটা পানির নিচে চলে যায়। আর দেখিনি ওটাকে। জার্মান শেফার্ডকে ভালো করে দেখল র‍্যাচেল। তবে এটা সেই কুকুরটা নাও হতে পারে। এটাকে ওটার চেয়ে আকারে ছোট লাগছে দেখতে। আর গায়ের রঙও বেশি গাঢ়।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে লাফিয়ে উঠল দুই কিশোরী। লাফ মেরে সিধে হলো কুকুর, শুরু করে দিল ঘেউ ঘেউ। বিশাল শরীরের এক বাহামিয়ান মহিলা, মাথায় গোলাপ রঙের স্ট্র হ্যাট এবং একই রঙা ফুলতোলা কাপড় পরা, পা রাখল বারান্দায়।

হ্যালো, মেয়েরা, কুকুরটার দিকে ফিরল মহিলা, মিস মলি, তুমি কি এই সুন্দর মেয়েদুটিকে এখানে নিয়ে এসেছ?

একরকম তাই, বলল চেলসি ওর পিছু নিয়ে এসেছি আমরা। আজ সকালে পানিতে ডুবে মরার হাত থেকে একটা কুকুর প্রাণ বাঁচিয়েছে আমার। অনেকটা এটার মতো দেখতে।

র‍্যাচেল বলল, সকাল বেলায় সাগরে সাঁতার কাটার সময় আমিও এরকম একটা কুকুর দেখতে পাই। হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যায় সে। ভেবেছিলাম ডুবে গেছে। আপনার কুকুরটাকেই বোধহয় দেখেছিলাম।

আচ্ছা! অবাক বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গেল মহিলার চোখ। ভারী অদ্ভুত তো! বারান্দায় বসতে বলল সে ওদেরকে। তোমাদের রহস্যের একটা সমাধান হয়তো দিতে পারব। তবে বিশ্বাস করা না করা তোমাদের ইচ্ছে।

কাঠের রকিং চেয়ারে বসল মহিলা। তার প্রকাণ্ড শরীরের ওজনে কাঁচক্যাচ করে আর্তনাদ ছাড়ল চেয়ার। আগে পরিচয় পর্বটা সেরে নিই। আমি জ্যানেল। তোমরা?

চেলসি ইমারসন।

র‍্যাচেল কাৎজ।

তাহলে, চেলসি, আজ সকালে তোমাকে একটা জার্মান শেফার্ড প্রাণ বাঁচিয়েছে আর র‍্যাচেল তুমি একই কুকুরকে দেখেছ সাগরে সাঁতার কাটতে? চেয়ারে দুলতে দুলতে প্রশ্ন করল মহিলা। তারপর আপন মনে বলল, সেদিন হয়তো এসে হাজির হয়েছে। হ্যাঁ, এতদিন পরে অবশেষে মুক্তি ঘটতে পারে তার।

আপনি কী বলছেন? জিজ্ঞেস করল র‍্যাচেল।

মেয়েরা, তোমাদেরকে আমি হতাশ করতে চাই না। তবে আজ সকালে তোমরা যে কুকুরটাকে দেখেছ সে মিস মলি নয়। মিস মলি বোধহয় পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র জার্মান শেফার্ড যে পানিকে ডরায়। অথচ সে এই ছোট্ট দ্বীপে বাস করছে যার চারদিকে সমুদ্র।

দোল খাওয়া বন্ধ করল জ্যানেল, চেয়ারটা টেনে নিয়ে এল মেয়েদের কাছে। ফিসফিস করে বলল, তোমরা যাকে দেখেছ, আমি নিশ্চিত, সে সেবা-ভূত সেবা।

ভূত? আঁতকে উঠল ওরা একসঙ্গে।

মিথ্যা বললে আমার কালো চুল সোনালি হয়ে যাবে। হ্যাঁ, দ্বীপের দূর প্রান্তে, সেবাকে সাগরে দেখা গেছে, দেখা গেছে সাগর-সৈকতেও। আর সেটা ১৮৮০ সালের শেষ দিক থেকেই দেখা যাচ্ছে। শুনবে সেই ঘটনা?

একসাথে মাথা ঝাঁকাল ওরা।

রিচমণ্ড নামে একটা জাহাজ কিউবা থেকে বারমুডা যাচ্ছিল। জনা কুড়ি ছিল তার যাত্রী, উইনচেষ্টার পরিবারসহ। এ পরিবারে ন্যান্সি আর পলি নামে স্কুলছাত্রী দুই বোন ছিল। বাবা-মার সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছিল। আর ওদের সঙ্গী ছিল একটি জার্মান শেফার্ড। নাম সেবা। ওদের বাবা রপ্তানীর ব্যবসা করতেন। পরিবার নিয়ে বারমুডা যাচ্ছিলেন।

সুন্দর একটি দিনে যাত্রা শুরু হয় ওদের। দখিনা বাতাসের সাথে অনুকূল স্রোত পেয়ে তরতর করে এগিয়ে চলছিল জাহাজ। কিন্তু জাহাজের ক্রু কিংবা যাত্রীদের কেউই জানত না প্রায় ৫০০ মাইল দূর থেকে ভয়ঙ্কর গতিতে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড়। বাহামা চ্যানেল ধরে দ্রুত এগোচ্ছিল ঝড়টা। কিউবা থেকে রওনা হবার দিন দুই পরে অশান্ত হয়ে উঠল সাগর, আকাশের রঙ বদলে গেল হঠাৎ। এক বুড়ো নাবিক সুর করে বলতে লাগল, সকালে যদি থাকে আকাশ লাল, কপালে আছে অশেষ আকাল। রাতে যদি লাল হয় আকাশ, নাবিক পায় নিশ্চিত আশ্বাস। তো সে সকালে আকাশের রঙ লাল বর্ণই ছিল।

রিচমণ্ডের যাত্রীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হামলা করে বসল হারিকেন। সে কী প্রচণ্ড ঝড়! কুদ্ধ নেকড়ের মতো গর্জাচ্ছিল বাতাস। রাগী দানবের হাত হয়ে উঠেছিল যেন সাগরের ঢেউ, ভীষণ বেগে আছড়ে পড়ছিল জাহাজের গায়ে, ওটাকে নাকানি-চোবানি খাওয়াচ্ছিল ইচ্ছে মতো।

উইনচেষ্টার পরিবার তাদের কুকুরকে নিয়ে নিচের ডেকে আশ্রয় নিল। শুনতে পেল মাথার ওপর মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ছে মাস্তল। পাল-টাল কোথায় উড়ে গেল বাতাসের তোড়ে। জাহাজটার বাঁচা-মরা পুরোপুরি নির্ভর করছিল ঝড় থেমে যাবার ওপর।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভয়ঙ্কর ঝড় ইচ্ছেমতো খেলল রিচমকে নিয়ে। দ্বীপের অগভীর পানিতে মাথা উঁচিয়ে থাকা পাথরখণ্ডের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে জাহাজের মারাত্মক ক্ষতি হলো। মি: উইনচেষ্টার কাঠের টুকরোর সঙ্গে রশি দিয়ে মেয়েদেরকে বেঁধে ফেলতে লাগলেন। সাগরে পড়ে গেলেও যাতে ওরা ডুবে না। যায়। কিন্তু কাজটা শেষ করার আগেই প্রবল ঢেউয়ের আঘাতে রীফের গায়ে। আছড়ে পড়ল জাহাজ, নারকেলের ভাঙা খোলের মতো দুটুকরো হয়ে গেল। কাঠের জাহাজ-এর কার্গো আর যাত্রীরা ধাক্কার চোটে ছিটকে পড়ে গেল ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে।

ন্যান্সি আর পলি আঁকড়ে ধরে রইল সেবাকে। কিন্তু পাহাড় সমান ঢেউ ছিনিয়ে নিয়ে গেল কুকুরটাকে ওদের কাছ থেকে। সেবা কাঠের ভাঙা টুকরোগুলো খুঁজছিল। দেখল একটা টুকরো ধরে তারস্বরে কাঁদছে ন্যান্সি। সাহায্য চাইছে আর্তস্বরে। টুকরোটা বারবার পিছলে যাচ্ছে হাত থেকে। শেষে হাল ছেড়ে দিল ও।

সেবা প্রাণপণে সাঁতরে পৌঁছে গেল ন্যান্সির কাছে। ন্যান্সি কুকুরটার পেছনের পা ধরে ফেলল। সেবা সাঁতার কেটে চলে এল তীরে, ওখানে পৌঁছে পরিশ্রমে আর ভয়ে নেতিয়ে পড়ল ন্যান্সি।

ঠিক এভাবেই কুকুরটা আমাকে বাঁচিয়েছে আজ সকালে, বলল চেলসি।

তো কী বলছিলাম? ওহ্, হ্যাঁ সেবার কথা। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সেবা। তবে কান খাড়া ছিল ওর। শুনতে পেল আরেকটা মেয়ের ক্ষীণ আর্তনাদ।

পলি? জিজ্ঞেস করল র‍্যাচেল।

হ্যাঁ। ছোট্ট পলি ভাঙা মাস্তল আঁকড়ে ধরে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু তীব্র স্রোত ওকে মাঝ সাগরে টেনে নিয়ে। যাচ্ছিল। সেবা প্রবল ক্লান্তি সত্ত্বেও আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে। পলিকে উদ্ধার করতে ছুটল।

এদিকে ন্যান্সি অপেক্ষা করছিল তার বোনের জন্যে। সেবাকে পানিতে লাফিয়ে পড়তে দেখেছে সে। যেন জানত পলিকে উদ্ধার করে আনবেই সেবা কিন্তু হায় তা আর হলো না। সেবা বা পলি কেউই আর ফিরে এল না।

মাথা নাড়ল র‍্যাচেল। ইস, কী দুঃখজনক ঘটনা!

হ্যাঁ। সত্যি দুঃখজনক ঘটনা ছিল ওটা। ন্যান্সি বেচারীর কী দশা দেখো। বেচারী তার বাবা-মা, বোন এবং কুকুরটাকে হারিয়েছে। অন্যান্য যাত্রীদের লাশ ভেসে এসেছিল তীরে। তবে পলিকা সেবার লাশ খুঁজে পায়নি কেউ।

এর সাথে আমাদের কী সম্পর্ক? জানতে চাইল চেলসি।

সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ওই ভয়ংকর ঝড়ের পরে, ওয়াকার্স বে তে প্রতি বছর একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যেতে লাগল। জেলে, ট্যুরিষ্ট বা এরকম অনেকেই দেখল তামাটে রঙের, বাদামী ফুটকিঅলা একটা জার্মান শেফার্ড সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

সেবার ভূত? জিজ্ঞেস করল র‍্যাচেল।

হা, সেবার ভূত। আমাদের দ্বীপের অনেকের বিশ্বাস সেবা একটি অতৃপ্ত প্রেতাত্মা। ছোট্ট পলির খোঁজে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভেবে দেখ, একটা কুকুর তার মনিবের মেয়েকে এতই ভালোবাসত যে মৃত্যুর পরেও তাকে ভুলতে পারেনি।

ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও প্রশ্নটা করি- আপনার কি ধারণা সেবাই আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে? প্রশ্ন করল চেলসি।

ধারণা? আমি নিশ্চিত ওটা সেবা ছিল।

আপনি বলেছিলেন সেদিন হয়তো এসে হাজির হয়েছে। হ্যাঁ, এতদিন পরে অবশেষে মুক্তি ঘটতে পারে। মানে কী এ কথার? জানতে চাইল র‍্যাচেল।

আমার ধারণা অতৃপ্ত প্রেতাত্মাদের অসম্পূর্ণ কিছু কাজ থাকে, ব্যাখ্যা করল জ্যানেল। সে কাজ শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি পায় না তাদের আত্মা। সেবার আত্মাও অতৃপ্ত ছিল সে পলিকে রক্ষা করতে পারেনি বলে। একশ বছর ধরে তার আত্মা ঘুরে মরেছে অসমাপ্ত কাজটা সমাপ্ত করার জন্যে। তারপর চেলসির ঘটনাটা ঘটল। সে বোট থেকে পড়ে গেল। ডুবে মরতে যাচ্ছিল। সেবা এসে তাকে বাঁচাল। রক্ষা করল একটি বাচ্চা মেয়ের জীবন। আর পানিতে ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজন রইল না সেবার। তার আত্মা মুক্তি পেল এতদিন পরে।

কিন্তু কুকুরটাকে আমিও দেখেছি, বলল র‍্যাচেল। আর সেটা চেলসি উদ্ধার পাবার পরে।

আমার ধারণা তুমি যে সেবাকে দেখেছ সে ছিল ১০০ বছরের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া সেবা। একটা কথা জিজ্ঞেস করি? অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে কি ঘেউ ঘেউ করেছিল কুকুরটা?

জ্বি, জবাব দিল র‍্যাচেল।

তার মানে পৃথিবীর কাছ থেকে চির বিদায় নিয়েছে সে, বলল জ্যানেল। আর কেউ কোনোদিন দেখতে পাবে না তাকে। তার আত্মা এখন বাস করছে শান্তিতে।

 

 

ঘাতক

খুন হয়ে যাচ্ছে, এই ভয়টা যেদিন থেকে পেয়ে বসল ওকে, সাহস করে কথাটা কাউকে বলতে পারেনি। আশঙ্কাটা একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল, গত কয়েকমাস ধরে, ধীরে ধীরে প্রবল হচ্ছিল সন্দেহ, ছোট্ট কয়েকটা ঘটনা সেটাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। গভীর এবং তীব্র এক স্রোতের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে সে এই মুহূর্তে, নিচের দিকে প্রচণ্ড জোরে কে যেন টানছে ওকে, কালো এবং বিশাল এক গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছে। অষ্টগুড়, টেনিস বল সাইজের ড্যাবডেবে চোখওয়ালা বিকট চেহারার কী ওটা? গোল গোল, চাকা চাকা দাগ শুড়লোর, এক সঙ্গে প্রসারিত হলো সবকটা একটা ঝিলিক দেখল সে শুধু, পরক্ষণে টের পেল হিলহিলে গুঁড়গুলো তাকে বেঁধে ফেলেছে ঠাণ্ডা, কঠিন নিষ্পেষণে। মুখ হাঁ হয়ে গেল তার, চিৎকার দিতে যাচ্ছে গলা ফাটিয়ে..

ঘরটাকে তার মনে হলো বিশাল এক সমুদ্র, ভেসে আছে সে। কিন্তু চারপাশে ওরা কারা? সাদা মুখোশ পরা, হাতে ধারাল যন্ত্রপাতি, কথা বলছে নিচু স্বরে। কে আমি, ভাবার চেষ্টা করল সে; কি নাম আমার?

শায়লা হক। বিদ্যুৎচমকের মত নিজের নামটা মনে পড়ল তার। মাহবুবুল হকের স্ত্রী। কিন্তু তারপরও অস্বস্তিবোধটা দূর হলো না। নিজেকে তার ভীষণ একা এবং অসহায় মনে হচ্ছে মুখোশধারী লোকগুলোর মাঝে। প্রচণ্ড ব্যথা তার শরীরে, বমি উগরে আসতে চাইছে, সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে মৃত্যুভয়।

আমি ওঁদের চোখের সামনে খুন হয়ে যাচ্ছি, ভাবল শায়লা। এই ডাক্তার কিংবা নার্সরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারছেন না আমার শরীরে কি ভয়ঙ্কর একটা জিনিস ঘাপটি মেরে আছে। জানে না মাহবুবও। শুধু আমি জানি। আর জানে ওই খুনেটা-খুদে গুপ্তঘাতক।

মারা যাচ্ছি আমি। কিন্তু কাউকে কথাটা বলতে পারছি না। আমার সন্দেহের কথা শুনলে ওঁরা হাসবেন, বিদ্রূপ করে বলবেন প্রলাপ বকছি। কিন্তু খুনেটাকে ওরা ঠিকই কোলে তুলে নেবেন, ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করবেন না আমার মৃত্যুর জন্যে ওটাই দায়ি। শুধু সবাই শোক প্রকাশ করবে আর আমার খুনীর জন্যে সবার দরদ উথলে পড়বে।

মাহবুব কোথায়? অবাক হলো শায়লা। নিশ্চয়ই ওয়েটিং রূমে। একটার পর একটা সিগারেট ফুকছে আর ঘড়ির দিকে একঠায় তাকিয়ে অপেক্ষা করছে কখন শুনবে সংবাদটা। শায়লার শরীর হঠাৎ ঘেমে গোসল হয়ে গেল, প্রচণ্ড ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল ও। এবার! আসছে ওটা! আমাকে খুন করতে আসছে! চিৎকার শুরু করল সে। কিন্তু আমি মরব না! কিছুতেই মরব না!

বিশাল এক শূন্যতা গ্রাস করল শায়লাকে। খালি খালি লাগল পেট। ব্যথাটা হঠাই চলে গেছে। প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগল নিজেকে। অন্ধকারের একটা পর্দা দ্রুত নেমে আসছে চোখের ওপর। হে খোদা, আঁধারের রাজ্যে হারিয়ে যেতে যেতে ভাবল শায়লা, শেষ পর্যন্ত ঘটেছে তাহলে ব্যাপারটা…।

পায়ের শব্দ শুনতে পেল শায়লা। আস্তে আস্তে কে যেন হেঁটে আসছে। দূরে, একটা কণ্ঠ বলে উঠল, ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। ওকে এখন ডিস্টার্ব কোরো না।

পরিচিত শেভিং লোশনের সুঘ্রাণ স্বর্গের শান্তি বইয়ে দিল শায়লার শরীরে। মাহবুব। ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আর কণ্ঠটা ডা. মোখলেসুর রহমানের।

চোখ খুলল না শায়লা। নরম গলায় বলল, আমি জেগে আছি। অবাক কাণ্ড। কথা বলছে সে। তার মানে মারা যায়নি তো!

শায়লা! অনুভব করল ওর হাতদুটো উষ্ণ আবেগে চেপে ধরেছে মাহবুব।

তুমি খুনেটার সঙ্গে দেখা করতে চাইছ, মাহবুব, ভাবল শায়লা। আমি শুনতে পাচ্ছি তুমি ওটাকে দেখতে চাইছ, তাহলে আমার আর কিছুই বলার নেই। চোখ খুলল শায়লা। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মাহবুব। দুর্বল হাতটা বাড়াল শায়লা, শুজনিটা সরাল একপাশে।

ঘাতক তাকাল মাহবুবের দিকে। তার ছোট্ট মুখটা লাল, কালো গভীর চোখ জোড়া শান্ত। ঝিকমিক করছে।

ইসসিরে! হেসে উটল মাহবুব। কি সুন্দর আমার সোনাটা! চুমু খাওয়ার জন্য ঝুঁকল সে, আস্তিন ধরে টান দিলেন ডা. মোখলেসুর রহমান।

না, না, এখন নয়, পরে, বললেন তিনি। নবজাতক শিশুকে এভাবে চুমু খেতে নেই। তুমি আমার চেম্বারে এসো। কথা আছে।

যাওয়ার আগে শায়লার হাতে চাপ দিল মাহবুব। কৃতজ্ঞ গলায় বলল, ধন্যবাদ, শায়লা। অসংখ্য ধন্যবাদ।

ক্লিষ্ট হাসল শায়লা। কিছু বলল না।

ডাক্তারের রূমে ঢুকল মাহবুব। হাত ইশারায় ওকে বসতে বললেন মোখলেসুর রহমান। একটা সিগারেট ধরালেন। গম্ভীর মুখে অনেকক্ষণ চুপচাপ টানলেন ওটা। তারপর কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। সোজা তাকালেন মাহবুবের চোখে।

বাচ্চাটাকে তোমার স্ত্রী মেনে নিতে পারছে না, মাহবুব।

কি!

ওর জন্য খুব কঠিন সময় গেছে। তোমাকে তখন বলিনি তোমার টেনশন বাড়বে বলে। ডেলিভারী রূমে শায়লা হিস্টিরিয়া রোগীর মত চিৎকার করে অদ্ভুত সব কথা বলছিল- আমি ওগুলো রিপিট করতে চাইছি না। তবে বুঝতে পারছি বাচ্চাটাকে সে নিজের বলে ভাবতে পারছে না। তবে এর কারণটা আমি তোমাকে দুএকটা প্রশ্ন করে জানতে চাই। সিগারেটে বড় একটা টান দিলেন ডাক্তার, একমুখ ধোয়া ছেড়ে বললেন, বাচ্চাটা কি ওয়ান্টেড চাইল্ড মাহবুব?

একথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

জানাটা খুব জরুরি।

অবশ্যই সে ওয়ান্টেড চাইল্ড, আমরা একসঙ্গে এ নিয়ে প্ল্যান করেছি। শায়লা তখন কত খুশি–।

হুমম-সমস্যা তো হয়েছে ওখানেই। যদি বাচ্চাটা আনপ্ল্যানড হত তাহলে ব্যাপারটাকে সাধারণ একটা কেস বলে ধরে নিতাম। অপ্রত্যাশিত শিশুকে বেশিরভাগ মা-ই ঘৃণা করে। কিন্তু শায়লার ক্ষেত্রে এটা ঠিক মিলছে না।

মোখলেসুর রহমান সিগারেটটা ঠোঁট থেকে আঙুলের ফাঁকে ধরলেন, অন্য হাত দিয়ে চোয়াল ঘষতে ঘষতে বললেন, তাহলে ব্যাপারটা অন্যকিছু হবে। হয়তো শৈশবের কোন ভীতিকর স্মৃতি ওর তখন মনে পড়েছে। কিংবা আর সব মায়ের মতই সন্তান জন্ম দেবার সময় মৃত্যুভয় ওকে কাবু করে ফেলেছিল। যদি এরকম কিছু হয় তাহলে দিন কয়েকের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে, মাহবুব একটা কথা-শায়লা যদি তোমাকে বাচ্চাটার ব্যাপারে কিছু বলে… মানে… ইয়ে, সে চেয়েছিল বাচ্চাটা মৃত জন্ম নিক, তাহলে কিন্তু শ হয়ো না। আশা করছি সব ঠিক থাকবে। আর যদি কোন সমস্যা দেখা দেয় তাহলে ওদেরকে নিয়ে এই ব্যাচেলর বুড়ো ডাক্তার চাচার চেম্বারে চলে এসো কেমন? তোমাদেরকে এমনিতেও দেখতে পেলে খুবই খুশি হব।

ঠিক আছে, চাচা। শায়লা একটু সুস্থ হলেই সপরিবারে আপনার বাসায় আবার যাব।

.

চমৎকার একটি দিন। মৃদু গুঞ্জন তুলে টয়োটা স্কারলেট ছুটে চলেছে লালমাটিয়ার দিকে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মাহবুব। আহা, কি সুন্দর নীল আকাশটার রঙ! কাঁচ নামিয়ে দিল ও। রাস্তার পাশের একটা ফুলের দোকান থেকে রজনীগন্ধার সুবাস ঝাঁপটা মারল নাকে। প্রাণভরে গন্ধটা টানল মাহবুব। বেনসনের আনকোরা প্যাকেটটার সেলোফেন ছিঁড়ে একটা সিগারেট জল ঠোঁটে। টুকটাক কথা বলছে। শায়লার সঙ্গে। শায়লা হালকাভাবে জবাব দিচ্ছে। বাচ্চাটা ওর কোলে। মাহবুব খেয়াল করল আলগোছে ধরে আছে সে ছোট্ট মানুষটাকে। মাতৃসুলভ কোন উষ্ণতা প্রকাশ পাচ্ছে না শায়লার আচরণে। যেন কোলে শুয়ে আছে চীনে মাটির একটা পুতুল। ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করল মাহবুব।

আচ্ছা! শিস দিয়ে উঠল ও।খোকন সোনার কি নাম রাখব আমরা?

শায়লা বাইরের সবুজ গাছগাছালি দেখতে দেখতে উদাসীন গলায় বলল, এখনও ঠিক করিনি। তবে একদম ভিন্নরকম কোন নাম রাখতে চাই আমি। এখনই এ নিয়ে গবেষণায় বসতে হবে না। আর দয়া করে বাচ্চার মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ো না তো। বলল বটে, কিন্তু এ যেন নিছক বলার জন্যই বলা।

শায়লার গা ছাড়া ভাব আহত করল মাহবুবকে। সিগারেটটা ফেলে দিল জানালা দিয়ে। দুঃখিত, বলল ও।

বাচ্চাটা চুপচাপ শুয়ে আছে তার মায়ের কোলে। দ্রুত অপসৃয়মান গাছের ছায়ারা খেলা করছে তার মুখে। কালো চোখ দুটো খোলা। ছোট্ট, গোলাপি, রবারের মত মুখ হাঁ করে ভেজা শ্বাস ফেলছে।

শায়লা একপলক তাকাল তার বাচ্চার দিকে। শিউরে উঠল।

ঠাণ্ডা লাগছে? জানতে চাইল মাহবুব।

অল্প। কাঁচটা উঠিয়ে দাও, মাহবুব, ঠাণ্ডা গলায় বলল শায়লা।

মাহবুব ধীরে জানালার কাঁচ ওঠাল।

.

দুপুর বেলা।

মাহবুব খোকন সোনাকে নার্সারী রূম থেকে নিয়ে এসেছে, উঁচু একটা চেয়ারের চারপাশে অনেকগুলো বালিশ রেখে তার মধ্যে শোয়াল ওকে।

শায়লা প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে বলল, ওকে অত উঁচু চেয়ারে শুইয়ো না। পড়েটড়ে যাবে।

আরে না, পড়বে না। দেখো টুটুবাবু এখানেও দিব্যি আরামে ঘুমাবে। হাসছে মাহবুব। খুব ভালো লাগছে ওর। দেখো, দেখো, বাবু সোনার মুখ দিয়ে লালা পড়ে কেমন চিবুক ভিজিয়ে দিয়েছে! তোয়ালে দিয়ে বাচ্চার মুখ মুছে দিল মাহবুব। চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করল এদিকে তাকিয়ে নেই শায়লা।

বুঝলাম সন্তান জন্ম নেবার সময়টা খুব সুখকর কিছু নয়, চেয়ারে বসতে বসতে বলল মাহবুব। কিন্তু সব মায়েরই তার বাচ্চার প্রতি কিছু না কিছু মায়া থাকে।

ঝট করে মুখ তুলল শায়লা। ওভাবে বলছ কেন? ওর সামনে এসব কথা কক্ষনো বলবে না। পরে বোলো। যদি তোমার বলার এত ইচ্ছে থাকে।

কিসের পরে! সংযম হারাল মাহবুব। ওর সামনে বললেই বা কি আর পেছনে বললেই বা কি? হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল ও। ডাক্তারের কথা মনে পড়ে গেছে। শায়লার মানসিক অবস্থা এখন ভালো নয়। ওর সঙ্গে রাগারাগি করা চলবে না। ঢোক গিলল মাহবুব। নিচু গলায় বলল, দুঃখিত, শায়লা।

কোন কথা বলল না শায়লা। প্রায় নিঃশব্দে শেষ হলো ওদের মধ্যাহ্ন ভোজন।

রাতে, ডিনারের পর, মাহবুব বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেল ওপরে। শায়লা ওকে কিছু বলেনি। কিন্তু ওর নীরব অভিব্যক্তি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছিল কাজটা মাহবুবকেই করতে হবে।

নার্সারীতে খোকন সোনাকে রেখে নিচে নেমে এল মাহবুব। ক্যাসেট প্লেয়ারে রবীন্দ্র সঙ্গীত চাপিয়েছে শায়লা, সম্ভবত-শুনছে না। ওর চোখ বন্ধ, আড়ষ্টভাবে শুয়ে আছে বিছানায়। শব্দহীন পায়ে এগিয়ে এল মাহবুব। দাঁড়াল শায়লার পাশে। একটা হাত রাখল চূর্ণ কুন্তলে। চমকে চোখ মেলে চাইল শায়লা। স্বামীকে দেখে স্বস্তি ফুটে উঠল দুচোখের তারায়। যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর শরীরে, জড়িয়ে ধরল সে মাহবুবকে। মাহবুব টের পেল ওর আড়ষ্ট শরীর ধীরে ধীরে নমনীয় হয়ে যাচ্ছে, যেন প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল কোন কারণে, এখন পরম আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে স্বামীর বুকে। মাহবুব ওর ঠোঁট খুঁজল। অনেকক্ষণ এক হয়ে থাকল দুজোড়া অধর।

তুমি, তুমি খুব ভালো, মাহবুব! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল শায়লা। কত নিশ্চিন্তে তোমার ওপর ভরসা করতে পারি আমি! এত নির্ভরযোগ্য তুমি!

হাসল মাহবুব। বাবা বলতেন- পুত্র মনে রেখো, তোমার সংসারে তুমিই একমাত্র অবলম্বন।

কালো, উজ্জ্বল কেশরাজি ঘাড় থেকে সরাল শায়লা। তোমার বাবার যোগ্য পুত্রই হয়েছ বটে। তোমাকে পেয়ে এত সুখী আমি। জানো, প্রায়ই আমি ভাবি এখনও যেন আমরা নবদম্পতিই রয়ে গেছি। আমাদের নিজেদের ছাড়া আর কারও কথা ভাবতে হচ্ছে না, কারও দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না, আমাদের কোন সন্তান নেই।

মাহবুবের হাত দুটো নিজের গালে ছোঁয়াল শায়লা। হঠাৎ অস্বাভাবিক সাদা হয়ে উঠেছে তার মুখ।

ওহ, মাহবুব, একটা সময় ছিল যখন ছিলাম শুধু তুমি আর আমি। আমরা পরস্পরকে নিরাপত্তা দিতাম। আর এখন এই বাচ্চাটাকে আমাদের নিরাপত্তা দিতে হবে, কিন্তু বদলে তার কাছ থেকে কোন নিরাপত্তা পাব না। আমি কি বলতে চাইছি তুমি বুঝতে পারছ। হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে আমি কত কিছু চিন্তা করেছি। দুনিয়াটা হচ্ছে একটা মন্দ জায়গা

তাই কি?

হ্যাঁ, তাই। কিন্তু আইন সকল মন্দ থেকে আমাদের রক্ষা করে। যখন আইন বলে কিছু থাকে না তখন ভালোবাসা নিরাপত্তার সন্ধান দেয়। আমি তোমাকে আঘাত করছি, কিন্তু আমার ভালোবাসা তোমাকে রক্ষা করছে। যদি ভালোবাসা না থাকত তাহলে পৃথিবীর সব মানুষই অসহায় হয়ে পড়ত। আমি তোমাকে ভয় পাই না। কারণ আমি জানি তুমি আমার ওপর যত রাগ করো, বকা দাও, খারাপ ব্যবহার করো, সবকিছুর ওপর ছাপিয়ে ওঠে আমার প্রতি তোমার গভীর প্রেম, নিবিড় ভালোবাসা। কিন্তু বাচ্চাটা? ও এত ছোট যে ভালোবাসা কিংবা অন্য কোন কিছুই সে বুঝবে না যতক্ষণ না আমরা তাকে ব্যাপারটা বোঝাই। যেমন ধরো, ও কি এখন বুঝবে কোনটা ডান আর কোনটা বাম?

এখন বুঝবে না। তবে সময় হলে শিখে নেবে।

কিন্তু…। কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল শায়লা, নিজেকে ছাড়িয়ে নিল মাহবুবের বাহুবন্ধন থেকে।

কিসের যেন শব্দ শুনলাম!

মাহবুব চারদিকে চাইল। কই, আমি তো কিছু শুনিনি…।

লাইব্রেরি ঘরের দরজার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে শায়লা। ওই ওখানে, ফিসফিস করে বলল সে।

ঘর থেকে বেরুল মাহবুব, খুলল লাইব্রেরি ঘরের দরজা। আলো জ্বেলে এদিক ওদিক চাইল। কিছু চোখে পড়ল না। আলো নিভিয়ে আবার ফিরে এল শায়লার কাছে। নাহ্, কিচ্ছু নেই, বলল ও। তুমি আসলে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। নাও, এখন শুতে চলো দেখি।

নিচতলার সব আলো নিভিয়ে ওরা উঠে চললো ওপরে। সিঁড়ির শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে শায়লা বলল, অনেক আজেবাজে কথা বলেছি, মাহবুব। কিছু মনে কোরো না। আসলেই আমার শরীরটা তেমন ভালো নেই।

শায়লার কাঁধে হাত রাখল মাহবুব। মৃদু চাপ দিল। কিছু মনে করেনি সে।

নার্সারী রূমের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল শায়লা, ইতস্তত করছে। তারপর হাত বাড়াল পেতলের নবের দিকে, দরজা খুলে পা রাখল ভেতরে। খুব সাবধানে এগিয়ে চলল বাচ্চার দোলনার দিকে। ঝুঁকল শায়লা, সঙ্গে সঙ্গে কাঠ হয়ে গেল শরীর। মাহবুব! চিৎকার করল ও।

দৌড় দোলনার কাছে চলে এল মাহবুব।

.

বাচ্চাটার মুখ টকটকে লাল, সম্পূর্ণ ভেজা; ছোট্ট হাঁ-টা বারবার খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে; চোখদুটো যেন জ্বলছে রাগে। হাতজোড়া সে উঠিয়ে রেখেছে শূন্যে, যেন বাতাস খামচে ধরার চেষ্টা করছে।

আহারে, দরদ ঝরে পড়ল মাহবুবের গলায়, বাবু সোনাটা না জানি কতক্ষণ ধরে কেঁদেছে!

কেঁদেছে? শায়লা দোলনার একটা পাশ আঁকড়ে ধরল ভারসাম্য রক্ষার জন্য। কই, কান্নার আওয়াজ তো শুনলাম না।

দরজা বন্ধ, শুনবে কি করে?

এ জন্যই বোধহয় ওর মুখ এত লাল আর এত জোরে শ্বাস টানছে?

অবশ্যই। আহারে, আমার সোনা রে। অন্ধকারে একা কেঁদে কেঁদে না জানি কত কষ্ট পেয়েছে। আজ রাতে ওকে আমাদের ঘরে নিয়ে যাই, কি বলো? এখানে একা থাকলে আবার যদি কাঁদে।

আদর দিয়ে দিয়ে তুমিই ওকে নষ্ট করবে, বলল শায়লা।

কোন কথা না বলে বাচ্চাটাকে দোলনা সহ নিজেদের শোবার ঘরে নিয়ে চলল মাহবুব। টের পেল শায়লার চোখ তাদেরকে অনুসরণ করছে।

.

নিঃশব্দে কাপড় ছাড়ল মাহবুব। বসল খাটের এক কোনায়। হঠাৎ কি মনে পড়তে হাতের তালুতে ঘুসি মারল ও।

ধুত্তুরি ছাই! তোমাকে তো বলতে ভুলেই গেছি। আমাকে সামনের শুক্রবার আবার হংকং যেতে হবে।

আবার হংকং কেন?

যাওয়ার কথা ছিল তো আরও দুমাস আগে। তোমার কথা ভেবে যাওয়াটাকে পিছিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওদিকের অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে না গেলেই নয়।

কিন্তু তুমি গেলে যে আমি একদম একা হয়ে পড়বে।

তোমার জন্য নতুন কাজের একটা বুয়া ঠিক করেছে আউয়াল। মহিলা শুক্রবার আসবে। তোমার কোন অসুবিধা হবে না। তাছাড়া আমি তো মাত্র অল্প কটা দিন থাকব।

তবুও আমার ভয় করছে। কেন জানি না এত বড় বাড়িতে একা থাকার কথা ভাবলেই বুকটা গুড়গুড় করে ওঠে। আমি যদি তোমাকে সব কথা খুলে বলি তুমি নির্ঘাত আমাকে পাগল ঠাওরাবে। আমার মনে হচ্ছে আমি বুঝি পাগল হয়ে যাব।

বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল মাহবুব। ঘরের বাতি নেভানো। অন্ধকারে বিছানার ধারে হেঁটে এল শায়লা, লেপটা তুলল, ঢুকল ভেতরে। ক্রিমের মিষ্টি গন্ধ নাকে ভেসে এল, রমণীর উষ্ণ শরীর উত্তেজিত করে তুলল মাহবুবকে, সে শায়লাকে জড়িয়ে ধরল। তুমি যদি আমাকে আরও কয়েকটি দিন পরে যেতে বলল তাহলে আমি–

না, শরীর থেকে মাহবুবের হাতটাকে আস্তে সরাল শায়লা। তুমি যাও। আমি জানি ব্যাপারটা জরুরী। আমি আসলে তোমাকে যে কথাগুলো তখন বললাম সেগুলো সম্পর্কে এখন ভাবছি। আইন, ভালোবাসা এবং নিরাপত্তা। আমার ভালোবাসা তোমাকে নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু বাচ্চাটা- শ্বাস টানল ও। তোমাকে সে কী নিরাপত্তা দেবে, মাহবুব?

কি বলা যায় ভাবছিল মাহবুব। বলবে কিনা যে সে যতসব আজগুবি ব্যাপার নিয়ে অহেতুক চিন্তা করে মরছে? এমন সময় খুট করে বেড সুইচ টিপল শায়লা। সাদা আলোয় উদ্ভাসিত হলো বেডরূম।

দ্যাখো, আঙুল দিয়ে নির্দেশ করল শায়লা।

বাচ্চাটা শুয়ে আছে দোলনায়। কালো চকচকে চোখ মেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

আবার বাতি নেভালো শায়লা। সরে এল মাহবুবের দিকে। থরথর করে কাঁপছে ওর শরীর।

যাকে আমি জন্ম দিয়েছি তাকে এত ভয় পাব কেন, সায়লার ফিসফিসে কণ্ঠ কর্কশ এবং দ্রুত হয়ে উঠল। কারণ ও আমাকে খুন করতে চেয়েছে। ও ওখানে। শুয়ে আছে, আমাদের সব কথা শুনছে, সব বুঝতে পারছে। অপেক্ষা করছে কবে। তুমি বাইরে যাবে আর সে আবার আমাকে খুন করার চেষ্টা চালাবে। খোদার কসম বলছি! কান্নায় গলা বুজে এল শায়লার।

প্লীজ! ওকে থামাতে চেষ্টা করল মাহবুব। কেঁদো না প্লীজ!

অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল শায়লা অন্ধকারে। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে থাকল। আস্তে-আস্তে কাঁপুনিটা কমে এল, নিঃশ্বাস হয়ে উঠল স্বাভাবিক এবং নিয়মিত। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

চোখ লেগে এল মাহবুবেরও।

ঘুমের গভীরতর স্তরে যেতে যেতে একটা শব্দ শুনল সে।

ছোট্ট, ভেজা, রবারের ঠোঁট থেকে চটচটে শব্দ। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল মাহবুব।

.

সকালবেলা ঝরঝরে মন নিয়ে ঘুম থেকে জাগল ওরা। শায়লা মধুর হাসল স্বামীর দিকে চেয়ে। হাতঘড়িটা দোলনার ওপর দোলাল মাহবুব, সূর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল কাঁচ। দেখো, বাবু, দেখো, কি চকচকে, কি সুন্দর! কি চকচকে, কি সুন্দর! সুর করে বলছে সে।

আবারও হাসল শায়লা স্বামীর ছেলেমানুষী দেখে। মনে এখন ওর আর কোন শঙ্কা নেই। মাহবুব নিশ্চিন্তে তার ব্যবসার কাজে হংকং যেতে পারে। ভয় পাবে না শায়লা। বাবুর যত্ন ঠিক নিতে পারবে সে।

শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ বিমানের ডিসি-১০-এ উড়াল দিল মাহবুব। নীল আকাশ, পেঁজা তুলো মেঘ আর সূর্যের ঝকঝকে সোনালি রশ্মি ছুঁয়ে গেল ওকে। ফ্রেশ মুড নিয়ে হংকং-এর এয়ারপোর্টে পা রাখল ও। শেরাটন হোটেলে আগেই রূম বুক করা ছিল। ওখানে উঠে প্রথমেই লং ডিসট্যান্স কলে শায়লাকে ফোন করে জানাল, সে ঠিকঠাক মত পৌঁছেছে। এক্সপেক্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা ওর। পরবর্তী ছটা দিন ঝড় বয়ে গেল ওর ওপর দিয়ে একটা বিজনেস ডিল করতে গিয়ে। এর মধ্যে একদিন ঢাকায় ফোন করল ও। কিন্তু ওদিক থেকে কোন সাড়া পেল না। ফোন ডেড। তবে চিন্তিত হলো না মাহবুব। মাঝে মাঝে এভাবে ফোন ডেড হয়ে। পড়ে ওদের বাসায়। এক্সচেঞ্জে কমপ্লেন জানালে আবার ঠিক হয়ে যায়। এবারও ওরকম কিছু একটা হয়েছে ভেবে ব্যাপারটা নিয়ে আর ভাবল না সে। কাজের মধ্যে এমন বুঁদ হয়ে গেল যে বাড়ির কথা প্রায় মনেই পড়ল না। সপ্তম দিনে, ব্যাংকোয়েট হলে একটা কনফারেন্স সেরে রূমে ফিরেছে মাহবুব, জামা কাপড় ছাড়ছে বিশ্রাম নেয়ার জন্য, ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল ফোন। অপারেটর জানালা ঢাকা থেকে ট্রাঙ্ককল। খুশি হয়ে উঠল মাহবুব। নিশ্চয় শায়লা। যাক, তাহলে এবার ওদের বাসার ফোনটা তাড়াতাড়িই ঠিক হয়েছে।

শায়লা? আগ্রহ ভরে ডাকল মাহবুব।

না, মাহবুব। ডা. মোখলেসুর রহমান বলছি।

ডাক্তার চাচা!

একটা খবর দেব। কিন্তু ভেঙে পড়া চলবে না। শোনো, শায়লা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমার ক্লিনিকে আছে। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে এসো, ওর নিউমোনিয়া হয়েছে, তবে ভেব না, আমার পক্ষে যতদূর সম্ভব শায়লার জন্যে করব আমি। তবে ওর পাশে এখন তোমাকে খুব দরকার।

হাত থেকে ফোন খসে পড়ল। কোন মতে উঠে দাঁড়াল, পায়ের তলাটা ফাঁকা ঠেকল। মনে হলো অসীম এক ঘূর্ণির মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে ও। ঘরটা অস্পষ্ট হয়ে উঠল, দুলছে।

শায়লা, আর্তনাদ করে উঠল মাহবুব। অন্ধের মত এগোল সে দরজার দিকে।

.

তোমার স্ত্রী মা হিসেবে খুব চমৎকার, মাহবুব। নিজের কথা সে একটুও ভাবেনি। বাচ্চাটার জন্যে চিন্তায় চিন্তায়…।

ডা. মোখলেসুর রহমানের একটা কথাও শুনছে না মাহবুব। একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে শায়লার পাণ্ডুর মুখের দিকে। শায়লার মুখের পেশী বার কয়েক কাপল, চোখ মেলে চাইল ও। অস্ফুট একটা হাসি ফুটল ঠোঁটে, তারপর কথা বলতে শুরু করল। আস্তে আস্তে কথা বলছে শায়লা। মা হিসেবে বাচ্চার প্রতি একজন তরুণীর কি দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাই বর্ণনা দিচ্ছে সে। ধীরে ধীরে গলা চড়ল ওর, ভয় ফুটল কণ্ঠে, তীব্র বিতৃষ্ণা বিষোদগার হলো। ডাক্তারের মুখাবয়বে কোন পরিবর্তন হলো না, কিন্তু মাহবুব বারবার কেঁপে উঠল। থামাতে চাইল ও শায়লাকে, কিন্তু পারল না।

বাচ্চাটা ঘুমাতে চাইত না। আমি ভেবেছিলাম ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ও দোলনায় শুয়ে থাকত আর শুধু চেয়ে থাকত। আর গভীররাতে উঠে কাঁদতে শুরু করত। প্রচণ্ড জোরে কাঁদত ও, সারারাত। একের পর এক রাত। আমি কত চেষ্টা করেছি থামাতে পারিনি। আর আমিও ওর কান্নার চোটে একটা রাতও ঘুমাইনি।

মাথা নাড়লেন ডা. মোখলেসুর রহমান। ক্লান্তির চরমে পৌঁছে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। কিন্তু এখন ও দ্রুত আরোগ্যের পথে। কয়েকদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে আশা করি।

অসুস্থবোধ করছে মাহবুব। বাচ্চা? আমার বাচ্চাটার কি অবস্থা?

ও ঠিকই আছে।

ধন্যবাদ, ডাক্তার চাচা। আপনাকে যে কি বলে কৃতজ্ঞতা জানাব…।

ওকে, ওকে সান। এমনিতেই খাটো মানুষ আমি। কৃতজ্ঞ করে আরও খাটো কোরো না। বরং ধন্যবাদ প্রাপ্য তোমাদের ওই কাজের বুয়ার, জামালের মা না কি যেন নাম, তার। শায়লা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল বাথরূমে। এমনিতেই ক্লান্ত শরীর, তারপর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। ভাগ্যিস নিউমোনিয়াটা ওকে খুব বেশি কাবু করার আগেই আমি উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পেরেছি। তোমাদের ওই কাজের বুয়াটা যদি বাথরূমের দরজা ভেঙে শায়লাকে বের করতে আরও ঘণ্টাখানেক দেরি করত তাহলে ওকে বাঁচানো কষ্টকর হয়ে উঠত। এনি ওয়ে, শায়লাকে তুমি শিগগিরই বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে। কাজেই চিন্তার কিছু নেই।

ডাক্তার দরজাটা ভেজিয়ে চলে গেলেন। শায়লা দুর্বল গলায় ডাকল, মাহবুব!

ঘুরল মাহবুব। জড়িয়ে ধরল শায়লাকে। শায়লা ওর হাত দুটো শক্ত করে ধরে থাকল। ভীত গলায় বলতে শুরু করল, আমি নিজের সঙ্গে প্রতারণা করেছিলাম। তোমাকে বুঝতে দেইনি যে হাসপাতাল থেকে ফেরার পরেও আমি শরীরে পুরো। শক্তি ফিরে পাইনি। কিন্তু বাচ্চাটা আমার দুর্বলতা টের পেয়ে গিয়েছিল। তাই প্রতি রাতে ওটা কাঁদত। কিন্তু যখন কাঁদত না তখন অস্বাভাবিক রকম নীরব থাকত। আমি রাতে ঘরের বাতি জ্বালাতে সাহস পেতাম না। জানতাম আলো জ্বাললেই দেখব ও আমার দিকে একঠায় তাকিয়ে আছে।

মাহবুব জড়িয়ে ধরে আছে শায়লাকে। শায়লার প্রতিটি কথা ও উপলব্ধি করতে পারছে অন্তরে অন্তরে। বাচ্চাটাকে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ও, টের পাচ্ছে ওর উপস্থিতি। এই বাচ্চা প্রতিদিন গভীররাতে ঘুম থেকে জাগে যখন আর সবার বাচ্চারা স্বাভাবিকভাবে ঘুমায়। এই বাচ্চা জেগে থাকে, যখন কাঁদে না তখন। চিন্তা করে। আর তার দোলনা থেকে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থাকে। এসব কি হচ্ছে? নিজেকে ভর্ৎসনা করল মাহবুব। এত চমৎকার তুলতুলে একটা বাচ্চাকে নিয়ে এসব কি ভাবছে সে। শায়লার দিকে মনোযোগ ফেরাল সে।

শায়লা বলে চলেছে, আমি বাচ্চাটাকে খুন করতে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, তাই। তুমি যেদিন হংকং গেলে তার পরদিনই আমি ওর ঘরে ঢুকে ঘাড়ের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু হাত ঢুকিয়েই থাকলাম। অনেকক্ষণ নড়তেই পারলাম না। ভীষণ ভয় লাগছিল আমার। তারপর বিছানার চাদর দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে, উল্টো অবস্থায় রেখে দৌড়ে পালালাম ঘর থেকে।

মাহবুব ওকে থামাতে চাইল।

না, আমাকে আগে শেষ করতে দাও। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ফোঁসফেঁসে গলায় বলল শায়লা। ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ভাবলাম ঠিক কাজটাই করেছি আমি। বাচ্চারা দোলনায় কাপড় পেঁচিয়ে এভাবে শ্বাসরোধ হয়ে কতই তো মারা যায়। কেউ জানবেই না যে আমিই কাজটা করেছি। কিন্তু ওকে মৃত অবস্থায় দেখব বলে যেই ঘরে ঢুকেছি…মাহবুব, বিশ্বাস করো, দেখি কি ও মরেনি! হ্যাঁ, মরেনি। বেঁচে আছে। তোষকে পিঠ দিয়ে হাসছে ও আর বড় বড় শ্বাস ফেলছে। তারপর ওকে আর আমার ধরার সাহসই হলো না। আমি সেই যে ও ঘর থেকে চলে এলাম আর সেদিকে গেলাম না। আমি ওকে খাওয়াতেও যাইনি কিংবা একবার দেখতেও যাইনি। হয়তো বুয়া ওকে খাইয়েছে। ঠিক জানি না আমি, শুধু এটুকু জানি সারারাত সে চিৎকার করে কেঁদে আমাকে জাগিয়ে রাখত। আর মনে হত সমস্ত বাড়িতে ওটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভয়ে আর দুশ্চিন্তায় আমি ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে পড়লাম। হাঁফিয়ে উঠেছে শায়লা। দম নিতে একটু থামল। তারপর আবার শুরু করল, বাচ্চাটা ওখানে সারাদিন শুয়ে থাকে আর খালি আমাকে খুন করার পরিকল্পনা আঁটে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। কারণ ও বুঝতে পেরেছে ওর সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জেনে ফেলেছি। ওর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ভালোবাসা নেই; আমাদের মধ্যে কোন নিরাপত্তার বন্ধন নেই; কোনদিন হবে না।

দীর্ঘক্ষণ কথা বলে ক্লান্ত হয়ে পড়ল শায়লা। একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল। মাহবুব অনেকক্ষণ বসে থাকল ওর শিয়রে, নড়তে ভুলে গেছে যেন। ওর রক্ত জমাট বেঁধে গেছে শরীরে। কোথাও একটা নার্ভও কাজ করছে না।

.

দিন তিনেক পর শায়লাকে বাড়িতে নিয়ে এল মাহবুব। তারপর সিদ্ধান্ত নিল পুরো ব্যাপারটা সে জানবে ডাক্তার চাচাকে। মোখলেসুর রহমান অখণ্ড মনোযোগে মাহবুবের সব কথা শুনলেন।

তারপর বললেন, দেখো, মাহবুব, তুমি ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করো। কখনও কখনও মায়েরা তাদের সন্তানদের ঘৃণা করেন, এটা এক ধরনের দ্বৈতসত্তা। ভালোবাসার মধ্যেই ঘৃণা, প্রেমিক প্রেমিকারা তো হরহামেশা খুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করছে। কয়েকদিন মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ। বাচ্চারাও তাদের মায়েদের ঘৃণা করে…।

বাধা দিল মাহবুব, আমার মাকে আমি কখনও ঘৃণা করিনি।

করেছ। কিন্তু স্বীকার করবে না। এটাই স্বাভাবিক। মানুষ তার প্রিয়জনদের ঘৃণা করার কথা কখনও স্বীকার করতে চায় না।

কিন্তু শায়লা তার বাচ্চাকে ঘৃণা করার কথা স্পষ্ট করে বলছে!

বরং বলল সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। ঘৃণা এবং ভালোবাসার যে স্বাভাবিক দ্বৈতসত্তা রয়েছে, সে ওটা থেকে একটু এগিয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক ডেলিভারীর মাধ্যমে ওর বাচ্চার জন্ম। নরকযন্ত্রণা সহ্য করেছে সে সন্তান জন্ম দেয়ার সময়। এই প্রায় মৃত্যুর অভিজ্ঞতা এবং নিউমোনিয়ার জন্যে শায়লা বাচ্চাটাকেই একমাত্র দায়ী মনে করছে। নিজের সমস্যা সে নিজেই সৃষ্টি করছে, কিন্তু দায়ভারটা তুলে দিচ্ছে হাতের কাছে যাকে সবচেয়ে সহজ টার্গেট হিসেবে পাচ্ছে, তার ওপর। আমরা সবাই এটা করি। চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা খেলে দোষ দেই ফার্নিচারটার। অথচ নিজেরা যে সাবধান নই সেদিকে খেয়াল রাখি না। ব্যবসায় ফেল করলে অভিসম্পাত করি খোদা, আবহাওয়া কিংবা আমাদের ভাগ্যকে। তোমাকে নতুন করে কিছু বলার নেই। আগেও যা বলেছি আজও তাই বলছি। লাভ হার। ওকে আরও বেশি বেশি ভালোবাসো। পৃথিবীর সেরা ওষুধ হলো এই ভালোবাসা। ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে ওর প্রতি তোমার স্নেহটাকে ফুটিয়ে তোলো, ওর মধ্যে নিরাপত্তাবোধ জাগিয়ে তোলো। ওকে বোঝাও বাচ্চারা কত নিষ্পাপ আর মোটেও অনিষ্টকারী নয়। বাচ্চাটার মূল্য কারও চেয়ে কম নয় এই অনুভূতি ওর মধ্যে জাগিয়ে তোলে। দেখবে কয়েকদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে। মৃত্যুভয় ভুলে যাবে শায়লা, ভালোবাসতে শুরু করবে তার বাচ্চাকে। যদি আগামী মাসের মধ্যে ওর কোন পরিবর্তন না দেখো, তাহলে আমাকে জানিও। আমি ওকে কোন ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে পাঠাব। এখন তুমি যেতে পারো। তবে দয়া করে চেহারা থেকে অসহায় ভাবটা মুছে ফেলো।

.

শীত ফুরিয়ে বসন্ত এল। বসন্তকে বিদায় জানাল গ্রীষ্ম। মাহবুবদের লালমাটিয়ার বাড়িতে সবকিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল মাহবুব তার কাজে ব্যস্ত থাকছে ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগ সময় সে ব্যয় করছে স্ত্রীর জন্যে। শায়লা এখন অনেকটাই সুস্থ। বিকেলে দুজনে মিলে হাঁটতে যাচ্ছে ক্রিসেন্ট লেকের পাড়ে, কখনও সামনের লনে ব্যাডমিন্টনের নেট ঝুলিয়ে পয়েন্ট গুণে খেলছে, মাহবুবকে হারাতে পারলে হাততালি দিয়ে উঠছে বাচ্চাদের মত। আস্তে আস্তে শক্তি ফিরে পাচ্ছে শায়লা। মনে হচ্ছে ভয়টার হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে ও।

তারপর একদিন রাতে প্রবল কালবৈশাখী ঝড় হলো ঢাকা শহরে। আকাশের বুক চিরে সাপের জিভের মত ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ, ভীষণ শব্দে বাজ পড়ল কাছে কোথাও, হাওয়ার ক্রুদ্ধ গর্জন যেন কাঁপিয়ে দিতে লাগল বাড়িটাকে। সেই সঙ্গে কেঁপে উঠল শায়লা। ঘুম ভেঙে জড়িয়ে ধরল সে স্বামীকে, ওকেও ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য করল। শায়লাকে আদর করতে করতে মাহবুব জানতে চাইল, কি হয়েছে।

ভয়ার্ত গলায় শায়লা বলল, কে যেন আমাদের ঘরে ঢুকেছে। লক্ষ করছে আমাদেরকে।

আলো জ্বালাল মাহবুব। আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছ, সস্নেহে বলল সে। এতদিন তো ভালোই ছিলে। আবার কি হলো? আলো নেভালো সে।

অন্ধকারে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শায়লা। তারপর হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল। ওকে বুকে চেপে ধরে থাকল মাহবুব, ভাবল তার এই মিষ্টি বউটা কি সামান্য কারণেই না ভয় পায়।

হঠাৎ ঘুম চটে যাওয়ায় আর ঘুম আসছিল না মাহবুবের। অনেকক্ষণ আগড়ম বাগডুম ভাবল সে। শব্দটা হঠাৎ কানে এল। খুলে যাচ্ছে বেডরূমের দরজা। ইঞ্চিকয়েক খুলে গেল পাল্লা দুটো।

কেউ নেই ওখানে। বাতাস থেমেছে বহুক্ষণ।

চুপচাপ শুয়ে থাকল মাহবুব। মনে হলো একঘণ্টারও বেশি সময় সে অন্ধকারে শুয়ে আছে।

তারপর, অকস্মাৎ গোঙানির মত কান্নার আওয়াজ ভেসে এল দূর থেকে। কাঁদছে বাচ্চাটা।

গোঙানির শব্দটা অন্ধকারের মধ্যে গড়িয়ে গড়িয়ে এল, ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, যেন প্রতিধ্বনি তুলল দেয়ালে। এই সময় আবার শুরু হলো ঝড়।

মাহবুব খুব আস্তে আস্তে একশো পর্যন্ত গুণল। থামছে না বাচ্চা, একভাবে কেঁদেই চলেছে।

সাবধানে শায়লার বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করল মাহবুব, নামল বিছানা থেকে। স্যাণ্ডেলে পা গলিয়ে এগোল দরজার দিকে।

ও এখন নিচে, রান্নাঘরে যাবে, ঠিক করল মাহবুব। খানিকটা দুধ গরম করে চলে আসবে ওপরে, অরপর…।

মিশমিশে অন্ধকারটা যেন মুহূর্তের জন্যে অদৃশ্য হয়ে গেল সামনে থেকে, পা পিছলে গেছে মাহবুবের। নরম কি একটা জিনিসের ওপর পাটা পড়েছিল ওর, টের পেল অসীম শূন্যের এক কালো গহ্বরের মধ্যে ছিটকে যাচ্ছে সে।

উন্মাদের মত হাত বাড়াল মাহবুব, প্রচণ্ড ঝাঁকি খেলো কব্জি জোড়া, ধরে ফেলেছে রেলিং। নিজেকে গাল দিল একটা।

কিসের ওপর পা দিয়ে পিছলে পড়েছিল মাহবুব? জিনিসটা কি বোঝার জন্যে হাতড়াতে শুরু করল অন্ধকারে। মাথায় দ্রিম দ্রিম ঢাক বাজছে। হৃৎপিণ্ড যেন গলার কাছে এসে ঠেকেছে, প্রচণ্ড ব্যথা করছে হাত।

নরম জিনিসটা খুঁজে পেল মাহবুব। ওটার গায়ে আঙুল বুলিয়েই বুঝতে পারল, একটা পুতুল। বিদঘুঁটে চেহারার বড়সড় এই পুতুলটা সে কিনেছিল তার বাবু সোনার জন্যে।

হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না মাহবুব। কে যে এভাবে জিনিসপত্র ছড়িয়ে রাখে! নাহ্, কাজের বুয়াটা ছুটিতে দেশের বাড়ি গিয়ে মুশকিলই হলো দেখছি। আরেকটু হলেই ভবলীলা সাঙ্গ হতে যাচ্ছিল মাহবুবের। অত উঁচু থেকে সরাসরি সিমেন্টের মেঝেতে আছড়ে পড়লে বাঁচত নাকি সে? ভাগ্যিস রেলিংটা ধরে ফেলেছিল।

.

পরদিন, নাস্তার টেবিলে কথাটা বলল শায়লা। আমি দিন কয়েকের জন্য একটু বরিশাল যেতে চাই। আব্বা-আম্মাকে দেখি না অনেকদিন। তুমি যদি সময় করতে না পারো, আমাকে একাই যেতে দাও, প্লীজ। জামালের মা বুধবার আসবে তার দেশের বাড়ি থেকে। সে একাই বাবুর যত্ন নিতে পারবে। আমি ওকে সঙ্গে নিতে চাচ্ছি না। আসলে বলতে পারো আমি কয়েকদিনের জন্যে ওর কাছ থেকে পালাতে চাইছি। ভেবেছিলাম এই ব্যাপারটা-মানে ভয়টা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি। কিন্তু তা আর পারলাম না। ওর সঙ্গে একরূমে আর থাকতে পারছি না আমি। ও এমনভাবে আমার দিকে তাকায় যেন প্রচণ্ড ঘৃণা করে আমাকে। এভাবে আরও কিছুদিন চললে আমি সত্যি পাগল হয়ে যাব। আমার মন বলছে খারাপ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। সেটা ঘটার আগেই কিছুদিনের জন্য বাইরে যেতে চাই।

থমথমে মুখে চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রাখল মাহবুব। তোমার আসলে এখন দরকার একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট। তিনি যদি তোমাকে বাইরে যেতে বলেন তাহলে যেয়ো। কিন্তু এভাবে আর চলে না। তোমার টেনশনেই আমি মরলাম!

মুখ কালো হয়ে গেল শায়লার। অনেকক্ষণ চুপ হয়ে থাকল। তারপর ওর দিকে না চেয়ে আস্তে আস্তে বলল, তুমিই বোধহয় ঠিক বলেছ। আমাকে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার। ঠিক আছে, তুমি কারও সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করো। তুমি যেখানে বলবে সেখানেই আমি যেতে রাজি, মাহবুব।

মাহবুব ওর ঠোঁটে চুমু খেলো। ডোন্ট টেক ইট আদার ওয়ে, ডার্লিং। তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে কথাটা বলিনি। তুমি তো জানোই, তুমি আমার কাছে কতখানি! তোমার সামান্য কষ্ট হলেও আমি দিশেহারা হয়ে যাই।

মুখ তুলল শায়ালা। হাসল। জানি, মাহবুব। আমি কিছু মনে করিনি। যাকগে, তুমি আজ ফিরবে কখন?

অন্যান্য দিনের মতই। কেন, হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? এমনিই। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরলে আমি একটু স্বস্তি পাই। চারদিকে এত অ্যাক্সিডেন্ট হয়। আর যে জোরে গাড়ি চালাও তুমি, আমার খুব ভয় হয়।

ওতো আমি সবসময়ই চালাই। অ্যাক্সিডেন্টে মরব না, একশোভাগ গ্যারান্টি দিলাম। শায়লার ফর্সা গাল টিপে দিল সে। হাসতে হাসতে বলল, চলি, দৃঢ় পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মাহবুব ফ্রেশ মুড নিয়ে।

.

অফিসে পৌঁছেই ডাক্তার মোখলেসুর রহমানকে ফোন করল মাহবুব। জানতে চাইল তাঁর জানাশোনা ভালো কোন সাইকিয়াট্রিস্ট আছে কিনা। ডা, সানোয়ারা বেগমের কথা বললেন রহমান সাহেব। অত্যন্ত দক্ষ এবং নির্ভরযোগ্য একজন মনোবিজ্ঞানী। জানালেন ভদ্রমহিলার সঙ্গে তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখলেন, মাহবুবকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিল মাহবুব। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কাজে।

সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর যখন ফ্রী হলো মাহবুব, অনুভব করল বাসায় যাওয়ার জন্যে কতটা ব্যগ্র হয়ে আছে মন। লিফটে নামার সময় গতরাতের ঘটনাটা মনে পড়ল ওর। শায়লাকে আছাড় খাওয়ার কথা বলেনি সে। পুতুলটার কথা বললে সে যদি অন্যভাবে রিঅ্যাক্ট করে! থাক, দরকার নেই বলার। অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট।

সূর্য ডুবে গেছে টয়োটা বিল্ডিং-এর আড়ালে। টকটকে লাল আভা ছড়িয়ে আছে ওদিকের আকাশে। সিঁদুর রঙা মেঘগুলো আশ্চর্য সব মূর্তি এঁকে রেখেছে আকাশের বুকে। অপূর্ব! একটা সিগারেট ধরিয়ে ফুরফুরে মেজাজে গাড়ি চালাচ্ছে মাহবুব।

গাড়ি-বারান্দায় টয়োটা রাখল মাহবুব। শায়লাকে নিয়ে এখনই আবার বেরুবে সে। ঠিক করেছে লং ড্রাইভে গাজীপুরের দিকে যাবে। ফেরার পথে রাতের খাবারটা সেরে নেবে কোন চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে।

হাত ওপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙল মাহবুব। বুক ভরে টেনে নিল তাজা বাতাস। পেছন থেকে মিষ্টি স্বরে ডেকে উঠল একটি পাখি। কলিংবেলে চাপ দিল। পিয়ানোর টুং টাং শব্দ বাজতে শুরু করল দোতলায়। দেড় মিনিট পার হওয়ার পরেও শায়লা আসছে না দেখে ভ্রু কুঁচকে উঠল ওর। ঘুমিয়ে পড়েনি তো শায়লা। কিন্তু এ সময় তো ওর ঘুমাবার কথা নয়। দরজার নবে হাত রাখল মাহবুব। মোচড় দিল। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজা। কপালে আরও একটা ভাঁজ পড়ল ওর। সদর দরজা কখনও ভোলা রাখে না শায়লা। দিনকাল ভালো নয় জানে। তাহলে হলো কি আজ মেয়েটার।

ঘরে ঢুকেই উঁচু গলায় ডাকল মাহবুব, শায়লা! কোন উত্তর নেই। আবারও ডাকতে গেল, কিন্তু হাঁ হয়েই থাকল মুখ। দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছে সে, ভয়ের তীব্র একটা ঠাণ্ডা স্রোত জমিয়ে দিল ওকে।

কিম্ভূত পুতুলটা পড়ে আছে সিঁড়ির গোড়ায়। কিন্তু পুতুল নয়, মাহবুব তাকিয়ে আছে শায়লার দিকে। শায়লার হালকাঁপাতলা দেহটা দুমড়ে মুচড়ে আছে সিঁড়ির গোড়ায়। যেন একটা ভাঙা পুতুল, আর কোনদিন খেলা করা যাবে না। কোনদিন না।

মারা গেছে শায়লা।

বাড়িটি আশ্চর্যরকম নিঃশব্দ, শুধু মাহবুবের বুকে হাতুড়ির আঘাত পড়ছে দমাদম।

মারা গেছে শায়লা।

মাথাটা দুহাতে আঁকড়ে ধরল মাহবুব, স্পর্শ করল চম্পক অঙ্গুলি। ভীষণ ঠাণ্ডা। বুকের সঙ্গে চেপে ধরে থাকল মাহবুব শায়লাকে। কিন্তু ও তো আর বেঁচে উঠবে না, আর কখনও জলতরঙ্গ কণ্ঠে ডাকবে না তার নাম ধরে। বাঁচতে চেয়েছিল শায়লা। তার কাছে নিরাপত্তা চেয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থ মাহবুব বাঁচাতে পারেনি তার প্রিয়তমাকে, পারেনি নিরাপত্তা দিতে।

উঠে দাঁড়াল ও। ডাক্তার চাচাকে ফোন করতে হবে। কিন্তু নাম্বারটা মনে আসছে না। ভূতগ্রস্তের মত উঠে এল মাহবুব দোতলায়। সম্মোহিত ভঙ্গিতে এগিয়ে চলল নার্সারী রূমের দিকে। খুলল দরজা। পা রাখল ভেতরে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল দোলনার দিকে। পেটের মধ্যেটা গুলিয়ে উঠছে। কোনকিছু ঠাহর করতে পারছে না। ভালো মত।

বাচ্চাটা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, কিন্তু মুখখানা লাল, ঘামে চকচক করছে, যেন অনেকক্ষণ একভাবে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

ও মারা গেছে, ফিসফিস করে বলল মাহবুব। মারা গেছে শায়লা।

তারপর হঠাৎ হাসতে শুরু করল। নিচু গলায় হাসতেই থাকল। সংবিৎ ফিরে পেল গালে সজোরে চড় খেয়ে। চমকে উঠল ডাক্তার মোখলেসুর রহমানকে দেখে। তিনি একের পর এক চড় মারছেন ওকে আর চেঁচাচ্ছেন, শান্ত হও, মাহবুব। প্লীজ, কাম ডাউন!

শায়লা মারা গেছে, ডাক্তার চাচা, মোখলেসুর রহমানকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেলল মাহবুব। পড়ে গেছে ও দোতলা থেকে পা পিছলে। গত রাতে আমিও পুতুলটার গায়ে পা পিছলে প্রায় মারা যাচ্ছিলাম। আর এখন

মোখলেসুর রহমান ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। কোন কথা বললেন না।

উন্মাদের মত মাথা ঝাঁকাতে শুরু করল মাহবুব। জানেন, ডাক্তার চাচা, আমি ওর সুন্দর একটা নাম দেব ভেবেছিলাম। এখন কি নাম দেব জানেন? আজরাইল!

রাত এগারোটা। শায়লাকে আজিমপুর গোরস্থানে কবর দিয়ে এসেছে মাহবুব। শুকনো মুখে বসে আছে লাইব্রেরি ঘরে। অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বলল, ভেবেছিলাম শায়লাকে ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাব। ভেবেছিলাম ও মাথায় গণ্ডগোল হয়েছে। কিন্তু এখন বুঝছি বাচ্চাটাকে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা অমূলক ছিল না।

ডাক্তার সশব্দে শ্বাস ফেললেন। শায়লার মত তুমিও দেখি ছেলেমানুষী শুরু করলে। অসুস্থতার জন্য শায়লা বাচ্চাটাকে দোষ দিত আর এখন তুমি ওর মৃত্যুর জন্যে তাকে দায়ী করছ। খেলনাটার ওপর পা পিছলে দোতলা থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙেছে শায়লার। এজন্যে তুমি কোনভাবেই বাচ্চাটাকে অভিযুক্ত পারো না।

ওটা আজরাইল।

চুপ করো! ওই শব্দটা আর কখনও মুখে আনবে না।

মাথা নাড়ল মাহবুব। শায়লা রাতে অদ্ভুত সব শব্দ শুনত, কে যেন হাঁটছে ঘরে। আপনি জানেন, ডাক্তার চাচা, কে ওই শব্দ করত? বাচ্চাটা। ছয়মাসের একটা বাচ্চা, অন্ধকারে ঘুরে বেড়াত, আমাদের সবকথা শুনত! চেয়ারের হাতল চেপে ধরল মাহবুব। আর আমি যখন আলো জ্বালাতাম, কিছু চোখে পড়ত না। বাচ্চাটা এত ছোট যে কোন ফার্নিচারের আড়ালে লুকিয়ে পড়াটা ওর জন্য কোন সমস্যা ছিল না।

থামবে তুমি! বললেন ডাক্তার।

না চাচা, আমাকে বলতে দিন। সব বলতে না পারলে আমি পাগল হয়ে যাব। আমি গতবার ব্যবসার কাজে হংকং গেলাম। তখন কে শায়লাকে সারারাত জাগিয়ে রেখেছিল, কে তার নিউমোনিয়া বাধিয়েছিল? ওই বাচ্চা। কিন্তু এত চেষ্টার পরেও যখন শায়লা মরল না, তখন সে আমাকে খুন করতে চাইল। ব্যাপারটা ছিল স্বাভাবিক; সিঁড়িতে একটা খেলনা ফেলে রাখো, বাপ তোমার জন্যে দুধ না নিয়ে আসা পর্যন্ত কাঁদতে থাকো, তারপর সে অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পিছলে পড়ে ঘাড় ভাঙুক। সাধারণ একটা কৌশল, কিন্তু কাজের। আমি মরতে মরতে বেঁচে গেছি। কিন্তু ফাঁদটা শায়লাকে শেষ করেছে।

একটু থামল মাহবুব। হাঁপিয়ে গেছে। খানিকপর বলল, বহু রাতে আমি আলো জ্বেলে দেখেছি ঘুমায়নি ওটা, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেশিরভাগ শিশু ওই সময় ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু ও জেগে থাকত, চিন্তা করত।

বাচ্চারা চিন্তা করতে পারে না।

ও পারে। আমরা বাচ্চাদের মন সম্পর্কে কতটুকুই বা জানি? শায়লাকে ওর ঘৃণা করার কারণও ছিল। শায়লা ওকে মোটেও স্বাভাবিক কোন শিশু ভাবত না। ভাবত অস্বাভাবিক কিছু। ডাক্তার চাচা, আপনি তো জানেনই জন্মের সময় কত বাচ্চা তাদের মায়েদের খুন করে। এই নোংরা পৃথিবীতে জোর করে টেনে আনার ব্যাপারটা কি ওদেরকে ক্ষুব্ধ করে তোলে? মাহবুব ক্লান্তভাবে ডাক্তারের দিকে ঝুঁকল। পুরো ব্যাপারটা এক সুতোয় বাঁধা। মনে করুন, কয়েক লাখ বাচ্চার মধ্যে কয়েকটা জন্মাল অস্বাভাবিক বোধ শক্তি নিয়ে। তারা শুনতে পায়, দেখতে পায়, চিন্তা করতে পারে, পারে হাঁটাচলা করতে। এ যেন পতঙ্গদের মত। পতঙ্গরা জন্মায় স্ব-নির্ভরভাবে। জন্মাবার কয়েক হপ্তার মধ্যে বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখি পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। কিন্তু সাধারণ বাচ্চাদের কয়েকবছর লেগে যায় হাঁটতে, চলতে কথা বলা শিখতে।

কিংবা ধরুন, কোটিতে যদি একটি বাচ্চা অস্বাভাবিকভাবে জন্মগ্রহণ করে? জন্মাল একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মেধা এবং শক্তি নিয়ে। কিন্তু যে ভান করল আর দশটা বাচ্চার মতই। নিজেকে দুর্বল হিসেবে প্রমাণ করতে চাইল, খিদের সময় তারস্বরে কাঁদল। কিন্তু অন্য সময় অন্ধকার একটা বাড়ির সব জায়গায় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে সে, শুনছে বাড়ির লোকজনের কথাবার্তা। আর তার পক্ষে সিঁড়ির মাথায় ফাঁদ পেতে রাখা কত সোজা! কত সহজ সারারাত কেঁদে তার মাকে জাগিয়ে রেখে অসুস্থ করে তোেলা।

ফর গডস শেক! দাঁড়িয়ে পড়লেন ডাক্তার, উত্তেজিত। এসব কি উদ্ভট কথা বলছ তুমি!

উদ্ভট শোনালেও ব্যাপারটা সত্যি, ডাক্তার চাচা, মানুষটা ছোট বলেই আমরা ওকে সন্দেহ করতে পারছি না। কিন্তু এই খুদে সৃষ্টিগুলো ভীষণ রকম আত্মকেন্দ্রিক। কেউ ওদের ভালো না বাসলে ঠিকই টের পায়। তখন তাদের প্রতি ওদের ঘৃণা উথলে ওঠে। আপনি কি জানেন ডাক্তার চাচা, পৃথিবীতে সবচেয়ে স্বার্থপর হচ্ছে শিশুরা?

মোখলেসুর রহমান জাকুটি করে অসহায়ভাবে মাথা নাড়লেন।

মাহবুব বলল, আমি বলছি না বাচ্চাটার ওপর কোন অস্বাভাবিক শক্তি ভর করেছে। কিন্তু সময়ের আগেই ও যেন দ্রুত বেড়ে উঠেছে। আর এই ব্যাপারটাই আমার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকছে।

ঠাট্টা করতে চাইলন ডাক্তার। ধরো, বাচ্চাটা শায়লাকে খুনই করেছে। কিন্তু খুনের তো একটা উদ্দেশ্য থাকে। বাচ্চাটার উদ্দেশ্য কি ছিল?

জবাবটা তৈরিই ছিল। ত্বরিতগতিতে বলল মাহবুব, যে বাচ্চা জন্মগ্রহণ করেনি তার সবচেয়ে শান্তির জগৎ কোথায়? তার মায়ের জরায়ু। ওখানে সময় বলে কিছু নেই, আছে শুধু শান্তির অপার সমুদ্র, একমনে গা ভাসিয়ে থাকো। কোন কোলাহল নেই, নেই দুশ্চিন্তা। কিন্তু তাকে যখন জোর করে টেনে আনা হলো এই মাটির পৃথিবীতে, নিরবচ্ছিন্ন শান্তির জগৎ থেকে মুহূর্তে সে পতিত হলো এক নরকে। স্বার্থপর এই পৃথিবীতে তাকে বেঁচে থাকতে হলে মানুষের ভালোবাসা আদায় করতে হবে। অথচ যার সঙ্গে তার কোন পরিচয় নেই। পরিচিত জগৎ থেকে হঠাৎ এই অপরিচিত দুনিয়ায় এসে নিজেকে সে প্রচণ্ড অসহায় ভাবতে থাকে, তখন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তার ছোট্ট মগজে তখন শুধু স্বার্থপরতা আর ঘৃণা ছাড়া অন্যকিছু থাকে না। মোহময় জগৎ থেকে কে তাকে এই নিষ্ঠুর পরিবেশে নিয়ে এল, ভাবতে থাকে সে! এ জন্য দায়ী কে? অবশ্যই মা। তার অপরিণত মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে তখন মায়ের প্রতি ছড়িয়ে পড়ে প্রবল ঘৃণা। বাপও মায়ের চেয়ে ভালো কিছু নয়। সুতরাং তাকেও ঘৃণা করো। খুন করো দুজনকেই।

বাধা দিলেন ডাক্তার। তুমি যা বললে এই ব্যাখ্যা যদি সত্যি হত তাহলে পৃথিবীর সব মহিলাই তাদের বাচ্চাদের ভয়াবহ কিছু একটা ভাবত।

কেন ভাববে না? আমাদের বাচ্চাটা কি তার জলজ্যান্ত উদাহরণ নয়? হাজার বছরের ডাক্তারী শাস্ত্রের বিশ্বাস তাকে প্রটেক্ট করছে। প্রকৃতিগতভাবে সবার ধারণা

সে খুব অসহায়, কোন কিছুর জন্য দায়ী নয়। কিন্তু এই বাচ্চাটা জন্মেইছে বিপুল ঘৃণা নিয়ে। যত দিন যাচ্ছে ততই প্রবল হয়ে উঠছে তার ঘৃণা। সে রাতে শুয়ে থাকে দোলনায়, ফর্সা টুকটুকে মুখখানা ভেজা, শ্বাস ফেলতে পারছে না। অনেকক্ষণ কেঁদেছে বলে এই অবস্থা? অবশ্যই নয়। সে দোলনা থেকে নেমেছে, মাগুড়ি দিয়ে বেড়িয়েছে সারা ঘরে। তারপর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ও আমার শায়লাকে খুন করেছে। আমিও ওকে খুন করব।

ডাক্তার মাহবুবের দিকে একগ্লাস জল আর কয়েকটা সাদা বড়ি এগিয়ে দিলেন। তুমি কাউকে খুন করবে না। তুমি এখন আগামী চব্বিশ ঘণ্টার জন্য ঘুমাবে। নাও, এগুলো গিলে ফেলল। একটা ভালো ঘুম হলেই এসব উদ্ভট চিন্তা মাথা থেকে দূর হয়ে যাবে।

মাহবুব পানি দিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেলল ঘুমের বড়িগুলো। ওপরে উঠল ও। কাঁদছে। শুয়ে পড়ল বিছানায়। মোখলেসুর রহমান ওর ঘুম আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। তারপর চলে গেলেন।

ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে মাহবুবের, এই সময় শব্দটা শুনল।

কে? অস্পষ্ট গলায় বলল সে।

কে যেন হলঘরে ঢুকেছে।

ঘুমিয়ে পড়ল মাহবুব।

.

পরদিন খুব ভোরে মাহবুবের বাসায় হাজির হলেন ডাক্তার মোখলেসুর রহমান। মাহবুবকে নিয়ে খুব টেনশনে আছেন তিনি। ছোটবেলা থেকে ওকে চেনেন। আবেগপ্রবণ, অস্থির। ভাগ্যিস গতরাতে তিনি ওদের বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ড্রপ করেছিলেন। নইলে ছেলেটা শায়লার শোকে ওভাবে হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যেত। শায়লার কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে গেল তার। এত লক্ষ্মী একটা মেয়ে! কি চমৎকার সুখের জীবন ছিল ওদের। সব গেল ছারখার হয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। মাহবুবকে তিনি কিছুদিনের জন্যে দূরে কোথাও ঘুরে আসতে বলবেন। এভাবে একা থাকলে মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটতে পারে ছেলেটার।

কলিংবেল বাজালেন ডাক্তার। কোন উত্তর নেই। তার মনে পড়ল মাহবুব বলেছিল কাজের মহিলা দেশের বাড়িতে গেছে। নব ঘোরালেন তিনি। খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকলেন। ডাক্তারি ব্যাগটা রাখলেন কাছের একটা চেয়ারে।

সাদামত কি একটা সরে গেল দোতলার সিঁড়ি থেকে। মোখলেসুর রহমান প্রায় খেয়ালই করলেন না। তার নাক কুঁচকে উঠেছে। কিসের যেন গন্ধ পাচ্ছেন।

গন্ধটা গ্যাসের!

বিদ্যুৎ খেলে গেল ডাক্তারের শরীরে, ঝড়ের বেগে সিঁড়ি টপকালেন তিনি, ছুটলেন মাহবুবদের বেডরূমে লক্ষ্য করে।

বিছানায় নিশ্চল পড়ে আছে মাহবুব, সারা রূম ভরে আছে গ্যাসে। দরজার পাশে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো অগ্নিনির্বাপক গ্যাস সিলিণ্ডারের মুখ ভোলা। হিসহিস শব্দে বেরিয়ে আসছে সাদা পদার্থটা। মোখলেসুর রহমানের চকিতে মনে পড়ল মাহবুব একবার বলেছিল সে তার বেডরূমে অগ্নিনির্বাপক গ্যাস সিলিণ্ডার লাগিয়েছে। কারণ তার কোন এক বন্ধু নাকি বিছানায় শুয়ে সিগারেট খেতে গিয়ে নেটের মশারিতে আগুন লাগিয়ে পুড়ে মরার জোগাড় হয়েছিল। মাহবুবেরও শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। শায়লার তাগিদেই নাকি সে নিরাপত্তার জন্যে ওই সিলিণ্ডার লাগিয়েছে দেয়ালে।

মোখলেসুর রহমান দ্রুত সিলিণ্ডারের মুখ বন্ধ করলেন। বন্ধ জানালাগুলো খুলে দিলেন। তারপর দৌড়ে এলেন মাহবুবের কাছে।

ঠাণ্ডা হয়ে আছে শরীর। অনেক আগেই মারা গেছে মাহবুব।

কাশতে কাশতে ঘর থেকে বেরোলেন ডাক্তার। চোখ দিয়ে অবিরল ধারায়। পানি ঝরছে। মাহবুব কিছুতেই ওই সিলিণ্ডারের মুখ খোলেনি। ঘুমের মধ্যে ওর হাঁটার অভ্যাস আছে, বলেছিল শায়লা। কিন্তু যে পরিমাণ ঘুমের ওষুধ ডাক্তার ওকে খাইয়েছেন তাতে দুপুর পর্যন্ত মাহবুবের অঘোরে ঘুমাবার কথা। সুতরাং এটা আত্মহত্যাও হতে পারে না। তাহলে কি…!

হলঘরে মিনিট পাঁচেক পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন ডাক্তার মোখলেসুর রহমান। তারপর এগোলেন নার্সারী রূমের দিকে। দরজা বন্ধ। ধাক্কা দিয়ে খুললেন তিনি দরজা। দাঁড়ালেন দোলনার পাশে।

দোলনাটা খালি।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন ডাক্তার দোলনা ধরে। তারপর অদৃশ্য কাকে যেন উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলেন:

নার্সারীর দরজাটা বন্ধ ছিল। তাই তুমি তোমার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান দোলনাতে ফিরে আসতে পারোনি। তুমি বুঝতে পারোনি যে বাতাসের ধাক্কায় দরজাটা অমনভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি জানি তুমি এই বাড়ির কোথাও লুকিয়ে আছ। ভান করছ এমন কিছুর, আসলে যা তুমি নও। মাথার চুল খামচে ধরলেন ডাক্তার, বিবর্ণ একটুকরো হাসি ফুটল মুখে। আমি এখন শায়লা আর মাহবুবের মত কথা বলছি, তাই না? কিন্তু আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না। আমি অপার্থিব কোন কিছুতে বিশ্বাস করি না। তারপরও আমি কোন ঝুঁকি নেব না।

নিচে নেমে এলেন ডাক্তার। চেয়ারে রাখা ডাক্তারি ব্যাগ খুলে একটা যন্ত্র বের করলেন।

হলঘরে ঘড়ঘড় একটা আওয়াজ শোনা গেল। কে যেন ঘষটে ঘষটে আসছে এদিকে। পাঁই করে ঘুরলেন ডাক্তার।

আমি তোমাকে এই দুনিয়ায় এনেছি, ভাবলেন তিনি। আর এখন আমিই তোমাকে এখান থেকে সরিয়ে দেব…!

শব্দ লক্ষ্য করে ঠিক ছপা হেঁটে গেলেন ডাক্তার। হাতটা উঁচু করে ধরলেন সূর্যালোকে।

দেখো বাবু! কি চকচকে, কি সুন্দর!

সূর্যের আলোতে ঝিকিয়ে উঠল স্কালপেলটা।

 

ঘাসের আড়ালে কে

বসন্তের এক চমৎকার দিনে আমি হাজির হলাম বাতেংগো। দক্ষিণ সাগরের পরিনেশিয়ান গ্রামগুলোর মত বাতেঙগোও বিশিষ্ট হয়ে আছে তার লম্বা ঘাসের জন্যে। আর ব্রনক্স বোটানিক্যাল গার্ডেনের জন্যে আমি এবার বিশেষ শ্রেণীর ঘাস খুঁজতেই বেরিয়েছি। বাতেংগার সবেধন নীলমণি লঞ্চঘাটে নামার পরেই পরিচয় হলো ঘাট মাস্টার গ্রেভসের সঙ্গে। সুদর্শন, হাসিখুশি স্বভাবের এই তরুণ খুব সহজেই কাউকে আপন করে নিতে পারে। এমনকি আমার পোষা কুকুর ডন, যে কিনা পলিনেশিয়ান কিংবা মেলানেশিয়ান কাউকেই পছন্দ করে না, সে পর্যন্ত গ্রেভসের ভক্ত হয়ে গেল দশ মিনিটের মধ্যে।

গ্রেভসের ঢেউ খেলানো লোহার ছাদের বাড়িটি আপাদমস্তক ঘোষণা করছে এখানে একজন অবিবাহিত পুরুষ মানুষ বাস করে। গ্রেভস এই দ্বীপে আছে বছর তিনেক। গর্বিত সুরে জানাল, এই সময়ের মধ্যে একদিনও তাকে কেউ কর্তব্যকর্মে গাফিলতি করতে দেখেনি। বেশ কিছুদিন ধরে সাদা চামড়ার মানুষের সান্নিধ্যে থেকে বঞ্চিত গ্রেভস। আমাকে দেখে এত খুশি হলো যে পরিচয়ের আধঘণ্টার মধ্যে জেনে ফেললাম তার শৈশবের সমস্ত ঘটনা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

অবশ্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাটি খুবই সরল। পরবর্তী ট্রিপে যে স্টীমারটি আসছে ওটায় চড়ে তার বান্ধবী আসবে আমেরিকা থেকে। তারা দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে এবং স্টীমারের ক্যাপ্টেন ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।

বন্ধু, বলল সে, আপনি হয়তো ভাবছেন আমার প্রেমিকা এখানে এসে খুবই একা অনুভব করবে। কিন্তু আপনি জানেন না আমি আমার সমস্ত ভালোবাসার অর্ঘ্য তার পায়ের তলায় নিবেদন করব। নিঃসঙ্গতা তাকে ছুঁতেই পারবে না। একজন মানুষ, যে সারাদিন ভাবতে থাকে কি করে তার প্রেমিকাকে সুখী করবে, সে তার স্বপ্নকন্যাকে কাছে পেলে কি করবে কল্পনা করুন তো একবার! আচ্ছা আপনি না। হয় এবার ভেতরে আসুন। ওর সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেই।

গ্রেভস আমাকে নিয়ে তার বেডরূমে ঢুকল, ড্রেসিং টেবিলের ওপর দেয়ালে বাঁধানো একটি বড় ছবির সামনে ধ্যানমগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

একজন সামান্য ঘাট মাস্টারের প্রেমিকা এত সুন্দরী হবে এ আমি কল্পনাই করিনি। মেয়েটি শুধু রূপবতীই নয়, অদ্ভুত লাবণ্যময়ী। অদ্ভুত নিষ্পাপ একটি ভাব খেলা করছে তার সুন্দর মুখখানায়।

খুব সুন্দরী, বলল সে। তাই না?

এতক্ষণ চুপচাপ গ্রেভসের কথাই শুনে গেছি আমি। এবার মন্তব্য করলাম, আমি এখন দিব্যি বুঝতে পারছি কেন আপনি এই অসাধারণ রূপবতী মেয়েটির ছবির দিকে তাকিয়ে নিজেকে একা ভাবেন না। এই মেয়ে কি সত্যি সামনের ট্রিপে এখানে আসছে? আমার এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না!

হ্যাঁ, বলল গ্রেভস। সুন্দর না?

একজন ঘাট মাস্টার, বলে চললাম আমি, তার নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য এমনকি তার পোষা কুকুর, বেড়ালের সঙ্গেও কথা বলে। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি আসল মানুষটিকে না দেখেও তার ছবির সঙ্গে কথা বলে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়া যায় যদি সে হয় এরকম শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যের অধিকারিণী। আসুন, হাত মেলাই।

তারপর আমি গ্রেভসকে প্রায় একরকম টেনেই ও ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এলাম। কারণ আমার হাতে সময় খুব কম। যে কাজে এসেছি ওটার ব্যাপারে তাড়াতাড়ি খোঁজ খবর নেয়া দরকার।

আমি কি কাজে এসেছি তা কিন্তু এখনও আপনি জানতে চাননি, বললাম আমি। তাই নিজে থেকেই বলছি। আমি ব্রনক্স বোটানিক্যাল গার্ডেনের জন্যে ঘাস সংগ্রহ করছি।

আচ্ছা! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল গ্রেভস। তাহলে তো আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন, ভাই। এই দ্বীপে একটা গাছও আপনার চোখে পড়বে কিনা সন্দেহ। কিন্তু চারদিকে আপনি শুধু ঘাসের বন্যাই দেখতে পাবেন। আমার বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই তো কমপক্ষে পঞ্চাশ রকমের ঘাস রয়েছে।

আঠারো পদের ঘাস অবশ্য ইতিমধ্যে আমার চোখে পড়েছে, বললাম আমি। কিন্তু সেটা আসল কথা নয়। আসল কথা হচ্ছে বাতেঙগো দ্বীপের ঘাসে কখন আঁটি হয়?

পনি ভেবেছেন এই প্রশ্ন করে আমাকে বোকা বানাবেন, তাই না? বলল সে। কিন্তু ঘাট মাস্টারের কাজ করলেও এসবেরও ছিটেফোঁটা খবর আমি রাখি, ভাই সাহেব। ওদিকে, হাত তুলে দেখাল সে, ওগুলোকে আমরা বিচ নাট বলি ওগুলোতে প্রথম আঁটি জন্মাবে। আর যতদূর জানি সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে যাবে।

সত্যি বলছেন?

আরে, আমি মিথ্যা বলতে যাব কোন্ দুঃখে?

সেক্ষেত্রে, বললাম আমি, আপনি আমাকে নির্ধারিত সময়েই আবার এখানে দেখতে পাবেন।

সত্যি? উদ্ভাসিত হয়ে উঠল গ্রেভসের মুখ। তাহলে তো আপনি আমাদের বিয়েতেও অংশ নিতে পারবেন।

ও ব্যাপারেও আমার যথেষ্ট আগ্রহ আছে। আমি আপনার স্বপ্নকন্যাকে বাস্তবে দেখতে চাই।

আপনি যাওয়ার পর আপনার কাজে লাগে এমন কিছু সাহায্য কি করতে পারি? আমার হাতে এমনিতেই প্রচুর সময়…।

ঘাস সম্বন্ধে যদি আপনার মোটামুটি একটা ধারণা থাকে…

তা অবশ্য নেই। তবে আমি ওদিকটাতে একবার যাব। যদিও যেতে হবে একাই। কারণ ওরা কেউ আমার সঙ্গে যেতে চাইবে না।

গ্রামের লোক?

হ্যাঁ। কুসংস্কারে বোঝাই সব। মানুষের চেয়ে ওই গ্রামে কাঠের দেবতার সংখ্যা বেশি। আর সবাই যেন আত্মহত্যার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সবকটা পাগল… আলোইট! হাঁক ছাড়ল গ্রেভস।

তার ডাক শুনে বাড়ির ভেতরে থেকে হেলেদুলে বেরিয়ে এল দশ বারো বছরের একটি ছেলে।

আলোইট, বলল গ্রেভস, এক দৌড়ে দ্বীপের পাহাড়টায় উঠে এই ভদ্রলোকের জন্য কিছু ঘাস নিয়ে আসতে পারবে? উনি তোমাকে এই জন্যে পাঁচ ডলার বকশিশ দেবেন।

মুখ শুকিয়ে গেল আললাইটের। মাথা নাড়ল যাবে না সে।

পঞ্চাশ ডলার?

এবার আরও জোরে মাথা নাড়ল আলোইট। আমি শিস দিয়ে উঠলাম। এতগুলো টাকার লোভ কেউ সামলাতে পারে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না।

তাহলে ফোট ব্যাটা কাপুরুষ, ধমকে উঠল গ্রেভস। আমার দিকে ফিরে বলল, দেখলেন তো? টাকা পয়সা, মারধোর কোন কিছু দিয়েই ওদেরকে সাগর তীর থেকে একমাইল দূরেও নিয়ে যেতে পারবেন না। ওরা বলে পাহাড়ের কাছে ওই ঘাসের রাজ্যে গেলে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা আপনার জীবনেও ঘটতে পারে।

কোন্ ঘটনা?

বহু বছর আগে এক মহিলা গিয়েছিল ওখানে, বলল গ্রেভস। মহিলাকে পরে লম্বা ঘাসের নিচে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তার শরীর পুরোটা কালো হয়ে ফুলে গিয়েছিল। পায়ের গোছের ঠিক ওপরে কিসে যেন কামড় দিয়েছিল তাকে।

সাপ তো হতেই পারে না, বললাম আমি। আমি খুব ভালো করেই জানি এসব দ্বীপে সাপ নেই।

সাপে কামড়েছে এমন কথা ওরাও বলেনি, বলল গ্রেভস। ওরা বলেছে কামড়ের জায়গায় খুব ছোট ছোট দাঁতের দাগ দেখা গেছে। যেন খুব ছোট বাচ্চা কামড়েছে। উঠে দাঁড়াল সে। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, এসব গাঁজাখুরি ব্যাপার নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। আপনি যদি ঘাস খুঁজতে ওদিকে যেতে চান তো একাই যেতে হবে। আর যদি না যান তাহলে চলুন একবার ঘাটের দিকে যাই। একটা ব্রেক ভেঙে গেছে। ওটাকে মেরামত করতে হবে। হপ্তা পাঁচেক পর আমি আবার যাত্রা শুরু করলাম বাতেগো দ্বীপের দিকে। একমাসেরও বেশি সময় ধরে আমি মানুষজনের সঙ্গ থেকে একরকম বঞ্চিত। তাই যতই বাতেঙগোর লঞ্চ ঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের জলযান, ততই উৎফুল্ল হয়ে উঠছি আমি। গ্রেভস। এবং তার ভাবি স্ত্রীর কথা ভাবছি। মেয়েটির সৎসাহসের প্রশংসা করতেই হয়। সবকিছু ছেড়ে দক্ষিণ সাগরের এই নির্জন দ্বীপে শুধু অর প্রেমিকের স্বার্থে বসবাস করতে আসা চাট্টিখানি কথা নয়।

অবশেষে তীরে এসে ভিড়ল তরী। হাঁটুর কাছে রাখা শটগানটি তুলে নিলাম হাতে। ডন ঘেউ ঘেউ করে তার আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। আমি ট্রিগারে চাপ দিলাম।

গুলির শব্দে বেরিয়ে এল গ্রেভস তার বাড়ি থেকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটি রুমাল নাড়তে লাগল। আমি মেগাফোনে চিৎকার করে বললাম তাকে দেখে খুব খুশি হয়েছি। জানতে চাইলাম সে বাতেগোতে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে কিনা।

এতদূর থেকেও গ্রেভসের আচরণে কেমন একটা আড়ষ্ট ভাব লক্ষ করলাম আমি। কয়েক মিনিট পর মাথায় একটি টুপি চাপিয়ে বাড়ি থেকে বেরুল সে। দরজা বন্ধ করল। হাঁটতে শুরু করল গ্রামের দিকে। কিন্তু ওর হাঁটার ভঙ্গিতেও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবটি অনুপস্থিত। আমাকে দেখে সে খুব একটা খুশি হয়েছে বলে মনে হলো না।

আশ্চর্য তো! ডনকে উদ্দেশ্য করে বললাম আমি। গ্রেভসের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসছে।

ডনকে নিয়ে লঞ্চ থেকে নেমে পড়লাম আমি। এগোলাম তীর ধরে। অনেক গ্রামবাসী দাঁড়িয়ে আছে তীরে। এত অচেনা মানুষের উপস্থিতি ডনের জন্যে রীতিমত অস্বস্তিকর। সে আমার পায়ে পায়ে চলতে লাগল। গ্রেভস আসার আগেই তীরে পৌঁছে গেলাম আমরা। গ্রেভস ওখানে হাজির হতেই গ্রামবাসীরা সভয়ে সরে গেল দূরে, যেন কোন কুরোগীকে দেখছে। আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসল গ্রেভস, কথা বলার জন্যে মুখ খুলতেই ডন পা শক্ত করে ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠল।

ডন! চাপা গলায় ধমকে উঠলাম আমি। ডন গুটিসুটি মেরে গেল, কিন্তু ওর পিঠের লোম খাড়া হয়ে উঠল, ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকল গ্রেভসের দিকে। গ্রেভসের মুখটা টানটান, রাগরাগ একটা ভাব। ছেলেমানুষি ভাবটা চেহারা থেকে। একেবারেই উধাও। কিছু একটা ব্যাপারে ও খুব টেনশনে আছে, মনে হলো আমার।

এই যে বন্ধু, বললাম আমি। খবর কি তোমার?

গ্রেভস ডানে আর বাঁয়ে তাকাল একবার, লোকগুলো সিঁটিয়ে গেল, পিছু হটল আরও কয়েক পা।

খবর তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছ, কাঠখোট্টা গলায় জবাব দিল সে। আমাকে একঘরে করা হয়েছে। একটু থেমে আবার বলল, এমনকি তোমার কুকুরটাও তা বুঝতে পেরেছে। ডন, গুড বয়! এদিকে এসো!

ডন গরগর করে উঠল।

দেখলে তো!

ডন! ধারাল গলায় বললাম আমি। এই লোকটি আমার বন্ধু। তোমারও। যাও, গ্রেভস। ওকে একটু আদর করো।

গ্রেভস এগোল ডনের দিকে। ওর মাথায় চাপড় মেরে আদুরে গলায় কি যেন বলতে লাগল।

ডন এবার আর গর্জন করল না বটে, কিন্তু গ্রেভসের প্রতিটি চাপড়ে শিউরে উঠল সে, যেন খুব ভয় পাচ্ছে।

তাহলে তোমাকে একঘরে করে রাখা হয়েছে, অ্যাঁ? ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ কৌতুককর মনে হলো। তা তোমার দোষটা কি?

কিছুই না। আমি শুধু ওই ঘাসের জঙ্গলে গিয়েছিলাম, বলল গ্রেভস। আর আমার… আমার কিছু হয়নি বলে ওরা আমাকে একঘরে করেছে।

মাত্র এই?

হ্যাঁ।

আচ্ছা! বললাম আমি। আমিও শিগগির একবার ওদিকে যাব। তার মানে আমাকেও ওরা একঘরে করে রাখবে। তাহলে ভালোই হবে। একসঙ্গে দুজন একঘরে হব। আচ্ছা, আমার জন্যে ইন্টাররেস্টিং কোন ঘাসের সন্ধান পেয়েছো ওখানে? ..

ঘাসের খবর আমি জানি না, বলল সে। কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং একটা জিনিসের সন্ধান পেয়েছি। ওটা তোমাকে দেখাব এবং তোমার কাছে কিছু পরামর্শও চাইব। যাবে নাকি আমার বাড়িতে?

লঞ্চেই রাত কাটাব ঠিক করেছি, বললাম আমি। কিন্তু তুমি যদি জোরাজুরি করো আর রাতের খাবারটা।

আমি তোমার জন্যে এখনই লাঞ্চের ব্যবস্থা করছি, তাড়াতাড়ি বলল গ্রেভস। একঘরে হয়ে থাকার পর থেকে রান্নাবান্না সব নিজেকেই করতে হচ্ছে। অবশ্য আমার রান্না তোমার খুব একটা খারাপ লাগবে না আশা করি।

গ্রেভসকে এখন অনেকটা হাসিখুশি দেখাচ্ছে।

ডনকে সঙ্গে নেব?

একটু ইতস্তত করল গ্রেভস, আ…ইয়ে…ঠিক আছে।

তোমার অসুবিধে হলে থাক।

ঠিক আছে, ওকে নিয়ে চলো। দেখি ওর সঙ্গে আবার নতুন করে ভাব করা যায় কিনা।

হাঁটতে শুরু করলাম আমরা গ্রেভসের সঙ্গে। ডন আমার পায়ের সঙ্গে সেঁটেই থাকল।

গ্রেভস, বললাম আমি। এইসব অশিক্ষিত গ্রামবাসী তোমাকে একঘরে করে রেখেছে এটা তোমার মন খারাপের কারণ নয়। অন্য কিছু একটা হয়েছে। কি সেটা? কোন খারাপ খবর?

আরে না,বলল সে।ও ঠিকই আসছে। এটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। তোমাকে আমি আস্তে আস্তে সব খুলে বলব। আমার ওপর রাগ কোরো না। আমি ঠিকই আছি।

কিন্তু তখন যে বললে ঘাসের জঙ্গলে কি ইন্টারেস্টিং একটা জিনিসের সন্ধান পেয়েছ?

পাথরের বিশাল একটি স্তম্ভ দেখেছি। জিনিসটা নিউ ইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিঙের মতই বড়। হাজার বছর আগের পুরানো, খোদাই করা। মেয়ে মানুষের মূর্তির মত। এছাড়াও অদ্ভুত ধরনের কিছু ঘাস চোখে পড়েছে তোমার কৌতূহল জাগবে। আমি তো আর তোমার মত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী নই, তাই ওগুলোকে আলাদাভাবে চিনতে পারিনি। ঘাসগুলোর নিচে লক্ষ লক্ষ ফুলও চোখে পড়ল… মানে কি বলব, এই জায়গাটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ জায়গা বলে মনে হয়েছে আমার।

দরজা খুলল গ্রেভস, একপাশে সরে দাঁড়াল আমাকে আগে যেতে দেয়ার জন্যে। আমি ভেতরে পা বাড়াতেই ঘেউ ঘেউ করে উঠল ডন।

শাট আপ, ডন!

ঠাস করে একটা থাবড়া বসলাম ওর নাকে। চুপ হয়ে গেল ডন, আমার সঙ্গে ভেতরে ঢুকল ভদ্র ছেলের মত। কিন্তু শরীর আড়ষ্ট হয়েই থাকল ওর।

.

গ্রেভসের বুকশেলফের ওপর জিনিসটাকে চোখে পড়ল আমার। হালকা বাদামী রঙের কাঠ দিয়ে তৈরি ওটা, রক্তচন্দন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, গোলাপি একটি আভাও রয়েছে। ফুটখানেক উঁচু, কাঠ দিয়ে খোদাই করা জিনিসটা একটি পনেরো ষোলো বছরের মেয়ের মূর্তি। খোদাইয়ের কাজ এত নিখুঁত যে মূর্তিটাকে দারুণ জীবন্ত লাগল আমার কাছে। এমন জিনিস পলিনেশিয়ান বা অন্য কোন দ্বীপে এ পর্যন্ত চোখে পড়েনি আমার।

মূর্তিটি নগ্ন। ওর চোখ দুটি ইস্পাত নীল। –আর চোখের পাতা ঠিক যেন রেশম, একদম রক্তমাংসের নারীর মত। মূর্তিটি এত বেশি জীবন্ত যে কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। ডনও চঞ্চল হয়ে উঠে চাপা গলায় গোঁ গোঁ শুরু করল। আমি তাড়াতাড়ি ওর ঘাড় চেপে ধরলাম। মূর্তিটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছে ওর একশো ভাগ।

মূর্তিটির দিকে চোখ তুলে তাকাতেই ভয়ের ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। ওটা কৌতূহল আর অবজ্ঞা নিয়ে তাকিয়ে আছে ডনের দিকে। তারপর ওটার ছোট, বাদামী বুক দুটো ফুলে উঠল, আবার সমান হলো, সবশেষে নাক দিয়ে সশব্দে একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।

আঁতকে উঠে একলাফে পিছিয়ে এলাম আমি, পড়লাম গিয়ে গ্রেভসের গায়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, মাই গড! ওটা জীবন্ত।

সুন্দর না। বলল গ্রেভস, ওকে আমি ঘাসের জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছি। ভয়ানক দুষ্টু আর চঞ্চল ও। তোমার বন্দুকের আওয়াজ শোনার পর ওকে ওখানে তুলে রেখেছি। যাতে দুষ্টুমি করতে না পারে। অত উঁচু থেকে ও লাফাতে পারবে না।

ওকে তুমি ঘাসের জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছ? রুদ্ধ কণ্ঠে বললাম আমি। ওখানে আরও এরকম আছে নাকি?

থকথক করছে কোয়েল পাখিদের মত। বলল সে। কিন্তু ওদের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। জিনিসটার দিকে তাকাল গ্রেভস, মুচকি হাসল। কিন্তু তুমি কৌতূহল চাপতে না পেরে বেরিয়ে এসেছিলে, তাই না, খুকি? তারপর তোমার ঘাড়টা কাক করে চেপে ধরে এখানে নিয়ে এলাম আমি। তুমি আমাকে কামড়াবার সুযোগই পাওনি।

ওটার ঠোঁট দুটো ফাঁক হলো। সাদা, ঝকঝকে একসারি দাঁত ঝিকিয়ে উঠল। গ্রেভসের দিকে তাকাল সে, কঠিন চোখ দুটিতে ফুটে উঠল নমনীয়তা। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম গ্রেভসকে সে খুবই পছন্দ করে।

ও এক অদ্ভুত পোষা প্রাণী, তাই না? বলল গ্রেভস।

অদ্ভুত? বললাম আমি। বরং বলো ভয়ঙ্কর। ওটাকে- ওটাকেও একঘরে করে রাখা উচিত। ডন ওটাকে মোটেই পছন্দ করেনি। জিনিসটাকে খুন করতে যাচ্ছিল সে।

ওকে দয়া করে জিনিস বলল না, অনুরোধ করল গ্রেভস। আর অমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্যও কোরো না। তোমার কথা বুঝতে পারলে খুবই মাইণ্ড করবে। তারপর সে ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করল ওটার সঙ্গে। ভাষাটা গ্রীক বলে মনে হলো। জিনিসটা কথা বলার সময় বারবার উঁচু গলায় হেসে উঠল। হাসিটা মিষ্টি, যেন ঘণ্টা বাজল টুং টাং করে।

তুমি ওর ভাষা জানো?
অল্প অল্প টং মা লাও?
আনা টন সাগ আটো।
নান টেন ডম উড লন আড়ি।

ফিসফিস করে, খুব নরম গলায় কথা বলছে ওরা। আমার দিকে ফিরল গ্রেভস। ও বলছে কুকুরটাকে সে ভয় পায় না। আর সে একা থাকতেই বেশি পছন্দ করবে। তোমার কুকুরটা যেন তাকে বিরক্ত না করে।

ডনের তেমন কোন ইচ্ছেও নেই, বললাম আমি। এখন দয়া করে বাইরে চলল। ওকে আমার মোটেও ভালো লাগছে না। ভয় পাচ্ছি আমি।

জিনিসটাকে শেলফ থেকে নিচে নামাল গ্রেভস, তারপর বেরিয়ে এল বাইরে।

গ্রেভস, বললাম আমি, তোমার ওই একমুঠি জিনিসটা কোন শুয়োর কিংবা বানর নয়, একটি মেয়ে। তুমি ওকে তার আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে অপহরণের মত মারাত্মক অপরাধ করেছ। এখন আমার পরামর্শ হচ্ছে যেখান থেকে ওকে এনেছ সেখানে ওকে রেখে এসো। তাছাড়া মিস চেস্টার ওকে দেখলেই বা কি ভাববেন?

ওকে নিয়ে আমি চিন্তিত নই, বলল গ্রেভস। কিন্তু আমি অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তায় আছি- খুবই চিন্তায় আছি। কথাটা কি এখন বলব নাকি লাঞ্চের পর?

না, এখন বলো।

শুরু করল গ্রেভস। তুমি চলে যাওয়ার পর আমিও উদ্ভিদ বিজ্ঞান সম্পর্কে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠি। তোমার জন্যে ঘাসের নমুনা সংগ্রহ করতে দুবার ওদিকে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার আমি একটি গভীর উপত্যকার মত জায়গায় ঢুকে পড়ি। ওখানকার ঘাসগুলো সব বুক সমান উঁচু। আর ওখানেই বিশাল এক পাথরের স্তম্ভ পড়ে থাকতে দেখি। একসঙ্গে আমার চোখে পড়ে কিছু জীবন্ত প্রাণী। ওরা আমাকে দেখে ছুটে পালাচ্ছিল। আমি ওদের পিছু ধাওয়া করি। ওখানে প্রচুর আলগা পাথর ছড়ানো ছিটানো ছিল। একটা পাথর হাতে তুলে নিই ওগুলোর কোনটাকে কজা করা যায় কিনা ভেবে। হঠাৎ দেখি কতগুলো ঘাসের আড়াল থেকে এক জোড়া ছোট, উজ্জ্বল চোখ উঁকি দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পাথরটা ছুঁড়ে মারি জিনিসটাকে লক্ষ্য করে। ধপাস করে পাথরটা ঘাসের মধ্যে পড়তেই গোঙানির আওয়াজ শুনতে পাই আমি। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যাই ওদিকে। তারপর ওকে দেখতে পাই আমি।

আমাকে দেখে তেড়ে কামড়াতে এসেছিল ও। আমি চট করে ওর ঘাড়টা দুআঙুল দিয়ে চেপে ধরতেই নিস্তেজ হয়ে যায়। তাছাড়া, পাথরের আঘাতে বেশ আহত হয়েছিল ও। আমার হাতে মরার মত পড়েছিল। ওকে ওভাবে মরতে দিতে মন চায়নি আমার। তাই ওকে বাড়িতে নিয়ে আসি। হপ্তাখানেক খুবই অসুস্থ ছিল। তারপর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। আমার সঙ্গে খেলতে থাকে। আমার টেবিলের নিচের দেরাজটা খুলে প্রায়ই ওটার মধ্যে লুকিয়ে থাকে ও। আর আমার রাবারের বুট জুতো জোড়াকে বানিয়েছে খেলনা বাড়ি। সঙ্গী হিসেবে ও পোষা বেড়াল, কুকুর কিংবা বানরের মতই ভালো। তাছাড়া ও এত ছোট যে ওকে আমি আমার পোষা একটি প্রাণী ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারি না। তো এই হচ্ছে ওর গল্প। এরকম ঘটনা যে কারও জীবনে ঘটতে পারে, পারে না?

হুম, তা পারে, বললাম আমি। কিন্তু প্রথম দর্শনেই যে মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয় তাকে পোর কোন মানে আছে বলে আমার মনে হয় না। আমার কথা যদি শোনো তাহলে বলব, ওকে যেখানে পেয়েছ সেখানে রেখে এসো।

চেষ্টা করেছিলাম, বলল গ্রেভস। কিন্তু ওকে ছেড়ে আসার পরদিন সকালেই দেখি আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে- চোখ দিয়ে জল পড়ছে না, কিন্তু কাঁদছে… তুমি অবশ্য একটা কথা ঠিকই বলেছ-ও শুয়োর কিংবা বানর নয়- একটি মেয়ে।

তুমি কি বলতে চাইছ ওটা তোমার প্রেমে পড়েছে? ঠাট্টার সুরে বললাম আমি।

সম্ভবত তাই।

গ্রেভস, এবার সিরিয়াস হলাম আমি। মিস চেস্টার সামনের ট্রিপের স্টীমারেই আসছেন। এর মধ্যে যা করার করতে হবে।

কি করব? অসহায় গলায় বলল গ্রেভস।

এখনও জানি না। তবে আমাকে ভাবতে দাও, বললাম আমি।

.

মিস চেস্টার আর সপ্তাহখানেক পরে আসবে। ইতিমধ্যে গ্রেভস বার দুই চেষ্টা করেছে বো-কে (ওটার নাম বো রেখেছে সে) ঘাসের জঙ্গলে ছেড়ে আসতে। কিন্তু দুইবারই তাকে পরদিন ভোরবেলা দেখা গেছে বারান্দায় বসে কাঁদতে। আমরা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি বো-র আত্মীয় স্বজনকে খুঁজে বের করতে। গ্রেভস ওকে নিজের জ্যাকেটের পকেটে পুরে বেরিয়েছে। কিন্তু কোনবারই সফল হইনি। বো ইচ্ছে করলেই পথ দেখাতে পারত। কিন্তু ইচ্ছে করেনি। খোঁজাখুঁজি পর্বের পুরো সময়টা আমরা তাকে দেখেছি গোমড়া মুখ করে থাকতে। গ্রেভস যে কবার তাকে মাটিতে নামিয়ে রাখতে চেয়েছে, ততবার সে গ্রেভসের জামার হাত ধরে ঝুলে থেকেছে। হাত থেকে তাকে ছোটাতে রীতিমত বেগ পেতে হয়েছে ওকে।

খোলা জায়গায় বো-র গতি ইঁদুরের মতই দ্রুত। আর তাকে ছুঁড়ে ফেলেও নিস্তার নেই, এক দৌড়ে ছুটে এসে ধরত সে আমাদের। কিন্তু ঘন ঘাসের মধ্যে ভালোভাবে চলতে পারত না। আমরা ওকে ফেলে দ্রুত চলে যাচ্ছি, এই সময় কাঁদতে শুরু করত বো। এই কান্না সহ্য করা সত্যি কঠিন।

আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না বো। কিন্তু আমার ওপর চড়াও হওয়ার সাহসও পায় না। কারণ সে দেখছে গ্রেভসের ওপর আমার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। আর আমিও বো-কে কখনও ঘাটাতে যাই না। মানুষ সাপ কিংবা বড় ইঁদুরকে যেমন ভয় পায়, বো-কে আমিও তেমনি ভয় পাই। এমনিতে বো-কে দেখলে যে কোন লোকেরই ভালো লাগবে। কিন্তু ও যখন লাফ মেরে মাছি কিংবা ঘাস ফড়িং ধরে কচকচিয়ে জ্যান্ত চিবিয়ে খায়, কিংবা ওর সঙ্গে একটু ইয়ার্কি করতে গেলেই ওর কান দুটো বেড়ালের মত মিশে যায় মাথার পেছনে এবং হিস হিস শব্দে দাঁত বেরিয়ে পড়ে, তখন দেখে খুবই ভয় লাগে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না।

ডনও বো-র সঙ্গে লাগতে যায় না। ইতিমধ্যে সে বুঝে গেছে তার প্রতিপক্ষ খুবই শক্তিশালী। বো তার দিকে কোন কারণে তেড়ে আসলে সে রুখে দাঁড়ায় না, বরং লেজ উল্টে পালায়। আমার মত ডনও বুঝতে পেরেছে বো-র মধ্যে সাংঘাতিক কিছু একটা আছে যা প্রকৃতি বিরুদ্ধ। সুতরাং ওকে না ঘটানোই ভালো।

একদিন ভোরবেলা, দিগন্ত রেখায় ধোয়া দেখতে পেলাম আমরা। গ্রেভস তাড়াতাড়ি তার রিভলভার বের করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। উদ্ভাসিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ওর স্টীমার আসছে।

হ্যাঁ, সায় দিয়ে বললাম আমি। তাই তো মনে হচ্ছে। তবে এখনই আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বো-র ব্যাপারে?

অবশ্যই। বো-কে দিন কয়েকের জন্য আমার কাছে রাখব। তোমরা দুজনে মিলে ঘরসংসার একটু সাজাও। তারপর মিসেস চেস্টার, মানে মিসেস গ্রেভার ঠিক করবেন কি করা যায়। তবে বো-কে এসব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আভাস দিয়ো না। ওকে আমার লঞ্চে নিয়ে এসো। তারপরের সব দায়িত্ব আমার।

খুশি মনে আমার পরামর্শ মেনে নিল গ্রেভস। বো-কে নিয়ে সে আমার লঞ্চে চলে এল। বো চারদিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। ওকে দ্রুত আমার কেবিনে পুরে বাইরে থেকে তালা মেরে দিলাম। যেই বুঝল ওকে বন্দী করা হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ ঘরের মধ্যে পাগলের মত ছোটাছুটি শুরু করল বো, কাঁদতে কাঁদতে।

গ্রেভসের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। শুকনো গলায় বলল, তাড়াতাড়ি চলো। আমার খুব খারাপ লাগছে।

অবশ্য মিস চেষ্টারকে দেখামাত্র মন ভালো হয়ে গেল গ্রেভসের। খানিক পর সম্ভবত সে ভুলেই গেল বো-র কথা।

মিস চেস্টারকে দেখে আবার মুগ্ধ হলাম আমি। ছবির চেয়েও সুন্দরী সে। এমন একটি মেয়ের স্বামী হতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। গ্রেভস নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান।

ওদের বিয়েটা খুব দ্রুত এবং ছিমছামভাবে হয়ে গেল। কন্যা সম্প্রদান করলেন স্টীমারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটি। ক্যাপ্টেন বিয়ে পড়ালেন। আর নাবিকরা সব সমস্বরে গাইল একটি মধুর বিয়ের গান। শ্যাম্পেন আর কেক দিয়ে সারা হলো সকালের নাস্তা। শ্বেতশুভ্র পোশাক পরা পরীর মত মিস চেস্টার তার স্বামীর হাত ধরে লাজুক হেসে তীরে বাঁধা নৌকায় উঠল খানিক সমুদ্র ভ্রমণ করে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখবার জন্যে। পরপর সাতাশবার পেতলের কামান দেগে অভিনন্দিত করা হলো নব দম্পতিকে। ওদেরকে নিয়ে নৌকা ভেসে পড়ল সমুদ্রে।

এত দ্রুত সবকিছু শেষ হয়ে গেল যে আমি খুবই নিঃসঙ্গবোধ করতে লাগলাম। ফিরে এলাম নিজের আস্তানায়। কোন কাজ নেই বলে বসে বসে রাইফেল আর রিভলভারটি পরিষ্কার করলাম। কিছুক্ষণ নোট লিখলাম দক্ষিণ সাগরের ঘাস সম্পর্কে। তারপরও কিছুই ভালো লাগছে না বলে ডনকে নিয়ে দিগম্বর হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সমুদ্রে। অনেকক্ষণ হুটোপুটি করলাম সাগর জলে। তীরে উঠে চিৎ হয়ে পড়ে থাকলাম উজ্জ্বল সূর্যের নিচে। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামল। উঠে পড়লাম আমরা। সোজা চলে এলাম লঞ্চে। ধীরে সুস্থে ডিনার খেলাম। তারপর আবার কেবিনে গিয়ে ঢুকলাম বো-র অবস্থা দেখতে।

বুনো বেড়ালের মত ছুটে এল বো আমার দিকে। ঝট করে সরে গিয়েছিলাম বলে রক্ষে, নইলে নির্ঘাত কামড় খেতাম। কিন্তু তারপরও আমার প্যান্টের কাপড় ছিঁড়ে নিয়েছে বো। বিদ্যুৎগতিতে কাজ করল আমার পা, ধাই করে লাথিটা গিয়ে লাগল ওর গায়ে, ছিটকে কেবিনের এক কোনায় গিয়ে পড়ল বো। তাড়াতাড়ি একটা মোমবাতি জ্বেলে নিলাম, সতর্ক একটা চোখ রেখেছি বো-র ওপর। ও একটা চেয়ারের নিচে গিয়ে ঢুকল। ভয়ঙ্কর কুদ্ধ দেখাচ্ছে। আমি আরেকটা চেয়ারে বসে কথা বলতে শুরু করলাম।

এতে কোন লাভ হবে না, বললাম আমি। তুমি বেহুদা আমাকে কামড়ে দিতে চাইছ। তুমি জানো তোমাকে এক লাথিতে আমি ভর্তা বানিয়ে ফেলতে পারি। কিন্তু তোমাকে আমি মারতে চাই না। তারচে আমার কাছে এসে বসো। এসো, আমরা বন্ধু হই। অবশ্য তুমি আমাকে পছন্দ করো না তা আমি জানি। আর আমিও যে তোমাকে দুচোখে দেখতে পারি না সে কথাও তোমার অজানা নয়। কিন্তু কিছুদিনের জন্যে আমাদের সহাবস্থান করতেই হবে। আর ওটা যাতে ভালোভাবে হয় সেই চেষ্টাই আমাদের করা উচিত। সুতরাং চেয়ারে নিচ থেকে বেরিয়ে এসো, আমার সঙ্গে দ্র ব্যবহার করো। আমি তোমাকে বাদাম খাওয়াব। বাদাম খাওয়ার লোভেই বোধহয় সে বেরিয়ে এল চেয়ারের তলা থেকে। আমি পকেট থেকে কিছু বাদাম বের করে মেঝেতে রাখলাম, ও দ্রুত এগিয়ে এল সামনে, কুটকুট করে খেতে লাগল ওগুলো।

এক মিনিটের মধ্যে বাদামগুলো সাবড়ে সে তাকাল আমার দিকে। তার চোখে অসীম বেদনা, যেন বলছে, আমি কি দোষ করেছি? আমাকে কেন তোমার সঙ্গে থাকতে হবে? আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই না। আমাকে গ্রেভসের কাছে যেতে দাও।

আমি ওকে ব্যাপারটা বোঝাতে চাইলাম। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন কাজ হলো না। তার চোখে আমার জন্যে উপচে পড়ছে ঘৃণা। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলাম। একটা বালিশ ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে। ইচ্ছে হলে ঘুমাবে। তারপর বেরিয়ে এলাম বাইরে। দরজা বন্ধ করতেই সে কান্না জুড়ে দিল। আমার খুব কষ্ট হতে লাগল। আবার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। খুব নরম গলায় ভালো ভালো ভালোবাসার কথা বলতে লাগলাম। কিন্তু সে আমার দিকে ফিরে তাকাল না পর্যন্ত। উপুড় হয়ে শুয়ে একভাবে কাঁদতেই থাকল।

এবার মেজাজ চড়ে গেল আমার। ঘাড় ধরে ওকে শূন্যে তুলে ফেললাম। মাথা ঘুরিয়ে ও আমাকে কামড়ে দেয়ার চেষ্টা করল। আমি লক্ষ করলাম ও কাঁদছে, কিন্তু চোখে এক বিন্দু জল নেই। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত। পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছে হলো। একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ওকে পরীক্ষা করতে লাগলাম। জলকণার চিহ্ন মাত্র নেই চোখের তারায়। ওর ঘাড়টা বোধহয় খুব জোরে চেপে ধরেছিলাম আমি, ব্যথা পেয়ে ওর ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে যেতে লাগল, বেরিয়ে পড়ল দাঁত।

এই সময় আমার গ্রেভসের গল্পটা মনে পড়ল। ঘাসের জঙ্গলে মৃত অবস্থায় যে মহিলাকে পাওয়া গিয়েছিল তার সমস্ত শরীর কালো হয়ে গিয়েছিল, দাঁতের দাগ ছিল পায়ের গোছের ওপর। ছোট ছোট দাঁত-বাচ্চাদের।

আমি জোর করে বো-র মুখ হাঁ করালাম। মোমবাতিটা দাঁড় করালাম মুখটার সামনে। কিন্তু ও এত বেশি শরীর মোচড়াচ্ছে যে বাধ্য হয়ে মোমবাতিটা মাটিতে রেখে ওর ঠ্যাং দুটো মুক্ত হাতটা দিয়ে চেপে ধরতে হলো। ইতিমধ্যে যা দেখার দেখে নিয়েছি আমি। সমস্ত শরীর আমার ঠাণ্ডা হয়ে গেল দ্রুত। একসারি ইঁদুরের দাঁতের দুই পাশে সঁচাল দুই ছেদক দন্ত নিয়ে যে শরীরটা আমার হাতের মধ্যে মোচড় খাচ্ছে আর হিস হিস শব্দ তুলছে, ওটা কোন নারী শরীর নয়-বিষাক্ত একটা সাপ!

.

ওটাকে আমি একটা সাবানের পরিত্যক্ত কাঠের বাক্সে ঢুকিয়ে ওপরে কাঠের ছিলকা মেরে দিলাম। ওকে আসলে উচিত লোহার বাক্সে পুরে সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়া। কিন্তু গ্রেভসের সঙ্গে কথা না বলে কাজটা করা ঠিক হবে না ভেবে প্ল্যানটাকে আপাতত দূরে সরিয়ে রাখলাম।

কোন দুর্ঘটনায় যাতে পড়তে না হয় সে জন্যে আগেভাগে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। কারণ কে বলতে পারে বো-র ভাই ব্রাদাররা সুযোগ পেলে প্রতিশোধ নিতে আসবে না। তাই পকেটে একটা তীক্ষ্ণধার ছুরি, রাবার ব্যাণ্ডেজ এবং এক বাক্স পারমাঙ্গানেট ক্রিস্টাল (সাপে কামড়ানো রুগীর ফার্স্ট এইডের মহৌষধ) পুরে ডেকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।

চমৎকার তারাজ্বলা রাত। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। ঘুমটা জমবে ভালো, কিন্তু ঘুমাবার আগে বো-র অবস্থাটা একবার দেখে আসা উচিত ভেবে উঠে পড়লাম। দরজা বন্ধ করতে নিশ্চই ভুলে গিয়েছিলাম আমি। কারণ ভেতরে ঢুকে দেখি বো নেই। পালিয়েছে। মাথা দিয়ে বাড়ি মেরেই বোধহয় সে নরম কাঠের বাক্সটা ভেঙেছে। ওর শারীরিক সামর্থ্যকে এতটা অবজ্ঞা করা উচিত হয়নি আমার।

লঞ্চের লোকজন লণ্ঠন জ্বেলে তন্ন তন্ন করে খুঁজল বো-কে। কিন্তু কোথাও ওর টিকিটিও দেখা গেল না। তার মানে জলে নেমে গেছে বো। অবশ্য সাপদের জন্য সাঁতার কাটা কোন সমস্যা নয়।

আমি ছোট একটা নৌকায় চড়ে দ্রুত তীরে চলে এলাম। ডনকে সঙ্গে করে, হাতে লোড করা শটগান নিয়ে হনহন করে হাঁটতে শুরু করলাম তীর ধরে। পথ শর্টকাট করার জন্যে ঘাসের একটা জঙ্গলে ঢুকে দ্রুত এগোতে থাকলাম। হঠাৎ ডন কাঁপতে শুরু করল, ঘাসের গায়ে নাক লাগিয়ে কি যেন শুঁকছে।

গুড ডন, চেঁচিয়ে উঠলামি আমি। গুড বয়, ওর পিছু নাও! খুঁজে বের করো ওকে!

প্রকৃতি পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। আমরা গ্রেভসের বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছি। দূর থেকে ওর বারান্দায় দুই ছায়ামূর্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দেখেই বুঝলাম গ্রেভস এবং তার বৌ। আমি ওকে সাবধান করার জন্যে মুখ খুলেছি, বলতে যাচ্ছি বো পালিয়ে গেছে এবং বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, এই সময় তীক্ষ্ণ এবং তীব্র একটা চিৎকার বিস্ফোরণের মত আঘাত হানল কানে। দেখলাম গ্রেভস বিদ্যুৎবেগে ঘুরে গেল তার স্ত্রীর দিকে। মেয়েটা পড়ে যাচ্ছে, দুহাতে জড়িয়ে ধরল তাকে।

মিসেস চেস্টার এখনও জ্ঞান হারায়নি, দাঁতে দাঁত চেপে আছে, ঘাম ফুটে উঠেছে কপালে। আমি তাড়াতাড়ি ওর পা থেকে খুলে ফেললাম মোজা। আঙুল এবং গোড়ালির মাঝের জায়গাটায় কামড় বসিয়েছে বো। বিষের ক্রিয়ার ইতিমধ্যে জায়গাটা কালো হয়ে ফুলে উঠেছে। ডাক্তারি ছুরিটা দিয়ে আমি ক্ষতচিহ্নটা চিরে ফেললাম, ওষুধ লাগিয়ে জায়গাটা ব্যাণ্ডেজ করে দিলাম।

গ্রেভস, ওকে একপাশে ডেকে নিয়ে বললাম। তোমার স্ত্রী জ্ঞান হারাতে শুরু করলে অল্প অল্প করে তাকে ব্র্যাণ্ডি খাইয়ে দিয়ো। তবে ভয়ের কিছু নেই বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ ঠিক সময়ই ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে। আর শোনো, ভুলেও বলতে যেয়ো না কেন এবং কিসে তাকে কামড়েছে…।

বলে আর দেরি করলাম না আমি। ডনকে বারান্দায় একটি থামের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলাম। ও খুবই অস্থির হয়ে উঠেছে। তাড়াতাড়ি ওর বাঁধন খুলে ছুটলাম বো-র পায়ের চিহ্ন লক্ষ্য করে।

উজ্জ্বল চাঁদ দিন করে রেখেছে চারদিক। বালির ওপর বো-র ছোট ছোট পায়ের দাগ স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। ডনকে শোকালাম ওই দাগ, তারপর তাড়া দিলাম, খোঁজো ওকে, ডন! শিগগির খুঁজে বের করো।

পায়ের দাগ ধরে আমরা ক্রমশ ঢুকে পড়লাম দ্বীপের ভেতরের অংশে। ঘাসের গন্ধ তীব্রভাবে নাকে ধাক্কা মারছে। ডনের চলার গতি হঠাৎ মন্থর হয়ে গেল, শরীর হয়ে উঠল আড়ষ্ট, তীক্ষ্ণ চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করল। আমি মাথা বাড়ালাম। কিছুই চোখে পড়ল না, এদিকে ডন তার লেজের ডগা বিপুল বেগে নাড়তে শুরু করেছে, শরীরটা ক্রমশ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে লাগল, ঘন এক গোছা ঘাসের দিকে মাথাটা এগিয়ে নিল। এক পা সামনে বাড়াল ডন, ওর ডান থাবাটা উঠে গেল শূন্যে, লেজ নাড়ানো থেমে গেল একই সঙ্গে। শক্ত, লোহার মত হয়ে উঠল ওটা।

দাঁড়াও, ডন! প্রায় ফিসফিস করে বললাম আমি। শটগানটা স্থির করলাম ঘন ঘাস গোছাকে লক্ষ্য করে, ট্রিগারে আঙুলের চাপ পড়ল…।

.

তোমার স্ত্রী এখন কেমন আছে?

আগের চেয়ে ভালো। পরপর দুটো গুলির শব্দ শুনলাম। শিকার মিলল কিছু?

 

 

 

প্রেতিনী

আমি বুঝতে পারছি না তুমি কেন ওখানে যেতে চাইছ না, বলল সোহানা রহমান। আমি সত্যি বুঝতে পারছি না।

আমরা ডিজনিওয়ার্ল্ডে যাব, বলল স্টিভ অস্টিন। ওখানে অনেক মজা আছে।

জাহান্নামে যাক ডিজনিওয়ার্ল্ড, মুখ ঝাঁপটে উঠল সোহানা। আমি ডিজনিওয়ার্ল্ডে বহুবার গেছি। আমি লেক দেখতে যাব।

না, সোহানা।

কেন নয়?

এখন ওখানে অনেক ঠাণ্ডা।

গরমের সময় যেতে চাইলাম, বললে এখন ওখানে খুব গরম।

শ্রাগ করল স্টিভ। আমি ও বাড়ি বিক্রি করে দেব। দালালের সঙ্গে কথাও বলেছি।

তোমার বাবা ওই বাড়িতে মারা গেছেন, ডায়মণ্ড লেকের তীরে চমৎকার একটি বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। আর তুমি ওটা আমাকে দেখতে পর্যন্ত দিতে চাইছ না!

ওখানে দেখার আছেটা কী! একটা লেক। কিছু জঙ্গল। আর কুৎসিত চেহারার ছোট একটি কেবিন।

অ্যালবামে ওই বাড়ির ছবি তুমি আমাকে দেখিয়েছ। ছবিতে তোমাকে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। বোঝাই যায় কৈশোরের দিনগুলো চমৎকার কেটেছে তোমার ও বাড়িতে।

আমার কৈশোর খুব একটা ভালো কাটেনি ও বাড়িতে, অন্ধকার ঘনাল স্টিভের চেহারায়। আমি ওখানে যাব না।

ঠিক আছে, স্টিভ, বলল সোহানা। তুমি ডিজনিওয়ার্ল্ডে ছুটি কাটাতে যাওগে। আমি ডায়মণ্ড লেকে বেরিয়ে আসব।

সোহানার জন্ম বাংলাদেশে। তবে এইচ.এস.সি পাশের পরে তাকে ইউএসও পাঠিয়ে দেয়া হয়। পড়াশোনার জন্য। ওর বাবা আজাদ রহমান জাতীয় সংসদের একজন প্রভাবশালী সদস্য। মা সমাজকর্মী। স্টিভের সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে সোহানা। পড়তে পড়তে ভালো লাগা। প্রেম থেকে পরিণয়। স্টিভ একটি ল ফার্মে চাকরি করে। সোহানা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। দুজনে মিলে দুহপ্তার ছুটি কাটাতে বেরিয়েছে।

তুমি মাঝে মাঝে এমন অযৌক্তিক সব দাবি করে বস। বিরক্ত হলো স্টিভ।

মোটেই না, বলল সোহানা। আমি যা করতে চাইছি তা অযৌক্তিক কিছু নয়। ডায়মণ্ড লেকে তোমার বাবার একটা কেবিন আছে। আমি সেখানে ছুটিটা কাটাতে চাইছি। কিন্তু আমি যখন বলেছি যাব। যাবই। তুমি গেলে যাবে না গেলে নাই।

ঠিক আছে। তুমিই জিতলে, চেহারা বাংলা পাঁচের মত হয়ে আছে স্টিভের তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ যাবে। আমি যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।

গুড, বলল সোহানা। আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলছি। কাল সকালেই বেরিয়ে পড়ব।

.

গন্তব্যে পৌঁছুতে প্রায় সারাটা দিন লেগে গেল ওদের। ইন্টারস্টেট ছেড়ে পাহাড়ি রাস্তায় ঢুকে পড়ল। মসৃণ, ঝকমকে রাস্তা। স্টিভ যখন ছোট ছিল ওই সময়ই চওড়া করা হয় হাইওয়ে। ওর বাবা যখন লেকের তীরে জমি কিনে কেবিন বানান, ওই সময় দুই লেনের রাস্তাটি ছিল আঁকাবাঁকা এবং বিপজ্জনক। কৈশোরে পাঁচ হাজার ফুট উঁচু ক্রেস্ট লাইন পাহাড়কে মনে হত আকাশ ছুঁয়েছে। এখন নতুন কেনা ক্রাইসলার ইমপেরিয়াল সাবলীলগতিতে পাহাড় বেয়ে চুড়োয় উঠে যাচ্ছে।

এই প্রথম ডায়মণ্ড লেকে যাচ্ছি, বলল সোহানা, আমাদের সেলিব্রেট করা উচিত। ঘন জঙ্গলে এলাকা দিয়ে ছুটছে গাড়ি। শ্যাম্পেন লাগবে আমার। লেকের আশপাশে শপিং সেন্টার নেই?

গ্রামে আছে, বলল স্টিভ, নার্ভাসভঙ্গিতে চেপে ধরে আছে হুইল। এ কদিন ভালোই কেটেছে দিন, কিন্তু এখানে আসার পরে… গায়ে একটি জেনারেল স্টোর আছে।

তোমার কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল সোহানা, এরকম শুকনো দেখাচ্ছে কেন চেহারা? আমি গাড়ি চালাব?

আমার কিছু হয়নি, জবাব দিল স্টিভ।

কিন্তু মিথ্যা বলেছে ও। ও ঠিক নেই।

এখানে ফিরে আসা উচিত হয়নি। মোটেই উচিত হয়নি।

এক গভীর অন্ধকার অপেক্ষা করছে ডায়মণ্ড লেকে।

.

গ্রামটির খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। শুধু বাক্স আকারের একটি মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল গড়ে উঠেছে, সঙ্গে স্পোর্টস ক্লদিং স্টোর এবং নতুন একটি গিফট শপ।

সোহানা ওয়েডস জেনারেল স্টোর থেকে এক কেজি গরুর মাংস আর এক বোতল শ্যাম্পেন কিনল। বুড়ো ওয়েড মারা গেছে বহুদিন, তার ছেলে এখন দোকান চালায়। বাপের সঙ্গে ছেলের চেহারায় অনেক মিল; এমন কী ছেলে বাপের মতই তারের চশমা পরে চোখে। আর চশমাটি ঝুলে থাকে নাকের ডগায়।

অনেকদিন পরে এলে, বলল সে স্টিভকে।

হু… অনেকদিন পর।

স্টিভ গাড়ি নিয়ে কেবিনের পথ ধরেছে, সোহানা বলল স্টিভ বুড়োর ছেলের সঙ্গে অমন শীতল ব্যবহার না করলেও পারত।

তাহলে কী করতে বলো আমাকে? ওর হাতে চুমু খাব?

অন্তত হাসিমুখে কথা বললেই পারতে। লোকটা তো তোমাকে হাসি মুখেই হ্যালো বলল।

আমার হাসি আসেনি।

এমন শক্ত হয়ে আছ কেন? একটু রিল্যাক্স করো না। বলল সোহানা। খোদা, কী সুন্দর!

ওদেরকে ঘিরে আছে ঘন পাইনের সারি, মাঝে মাঝে ফাঁক দিয়ে চমকাচ্ছে সবুজ তৃণভূমি, চকচকে গ্রানিট, যেন রঙের সাগরে কালো দাগ।

এখানে কী ধরনের ফুল জন্মায়, জানো?

বাবা এসব খবর রাখতেন, বলল স্টিভ। এদিকে আছে পূপিন, আইরিশ, বাগল ফ্লাওয়ার, কম্বাইন… বাবা ক্যামেরা নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। বুনো প্রকৃতির রঙিন ছবি তুলতেন। বিশেষ করে পাখির ছবি। লাল ঝুঁটিঅলা কাঠঠোকরার ছবি তুলতে খুব ভালোবাসতেন তিনি।

তুমি তোমার বাবার সঙ্গে বেরুতে না?

মাঝে মাঝে। বেশির ভাগ সময় মা-ই সঙ্গে যেত। শুধু বাবা আর মা। আমি তখন লেকে সাঁতার কাটতাম। বাবা জঙ্গল দারুণ পছন্দ করতেন। তবে মা মারা যাওয়ার পরে মাত্র দুবার এসেছি এখানে। চোদ্দ বছর বয়স যখন আমার, তারপর থেকে বাবার সঙ্গে আর আসা হয়নি। বাবাকে বাড়িটি বিক্রি করে দেয়ার জন্য। অনেকবার বলেছি। তিনি কানেই তোলেননি আমার কথা।

ভালোই করেছেন। তোমার কথা শুনলে আর এদিকে আসা হত না।

বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেলে বেঁচে যাই। গম্ভীর গলায় বলল স্টিভ।

কেন? স্বামীর দিকে ফিরল সোহানা। এ জায়গাটির প্রতি তোমার এত বিতৃষ্ণা কেন?

জবাব দিল না স্টিভ। ওরা লারসনের পুরানো মিল হুইল পাশ কাটাল। পনেরো বছর পরে আবার ডায়মণ্ড লেক ভেসে উঠল স্টিভের চোখের সামনে-গাছের ফাঁকে ঝিলিক দিল যেন রোদে ঝলসানো ইস্পাত। স্টিভের শিরদাঁড়া বেয়ে নামল বরফ জল। চোখ পিটপিট করছে ও। শুনতে পাচ্ছে দিড়িম দিড়িম ঢাকের বাজনা বাজাচ্ছে হৃৎপিণ্ড।

ওর এখানে আসা মোটেই ঠিক হয়নি।

.

যেমন দেখে গেছে ঠিক তেমনই আছে কেবিন-লম্বা, ঢালু ছাদ, রেডউডের তৈরি কাঠের বাড়ি। নুড়ি বিছানো পথ ধরে এগিয়ে গেল ওরা।

বাড়িটা একদম নতুনের মত লাগছে! বাচ্চা মেয়ের মত কলকল করে উঠল সোহানা। আমি ভেবেছি ভাঙাচোরা একটা বাড়ি দেখব।

বাবা বাড়ির যত্ন নেয়ার জন্য কেয়ারটেকার রেখেছিলেন। যার প্রয়োজন হত এ বাড়িতে দুএক রাত্তির কাটিয়ে যেত।

সামনের দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকল দুজনে।

বাহ্, ভারী সুন্দর তো! বলল সোহানা।

ঘোঁত ঘোঁত করল স্টিভ। ড্যাম্প পড়ে গেছে। বেডরুমে কেরোসিন তেলের একটা স্টোভ ছিল। রাতে স্টোভ জ্বালাতাম। রাতেরবেলা এদিকে খুব ঠাণ্ঠা পড়ে।

কেবিনের ভেতরটা কালো ওক কাঠে তৈরি। আসবাবগুলোও একই কাঠের, পাথরের একটি চুল্লিও আছে। লেকের দিকে মুখ ফেরানো কাঁচের জানালা। লেকের তীরে, পাহাড়ের দিকে দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে আছে লম্বা লম্বা পাইন। ভারী মনোহর দৃশ্য।

ভিউকার্ডের কোনও দৃশ্যের মধ্যে যেন চলে এসেছি আমি, বলল উদ্ভাসিত সোহানা। ঘুরল স্বামীর দিকে, হাত ধরল। কটা দিন এখানে সুন্দরভাবে থাকার চেষ্টা করা যায় না, স্টিভ?

চেষ্টা নিশ্চয় করা যায়, জবাব দিল স্টিভ।

.

রাতের বেলা চুল্লিতে আগুন জ্বালল স্টিভ। সোহানা রান্না করল। বাসমতি চালের ভাত, গরুর মাংসের রেজালা, ডাল আর সালাদ। ডেসার্ট হিসেবে থাকল ভ্যানিলা আইসক্রিম। চাল আর ডাল সে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। স্টিভ সোহানার হাতের গরুর মাংস আর ভাত খেতে বেশ পছন্দ করে।

খাওয়া শেষে শ্যাম্পনের গ্লাস টোস্ট করে সোহানা বলল, ডায়মণ্ড লেকের ছুটি সফল ও সার্থক হোক।

তবে স্টিভ কিছু বলল না। সে জানালার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে চুপচাপ মদ গিলল।

কৈশোরে এখানে তোমার নিশ্চয় অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল, বলল সোহানা।

ডানে-বামে মাথা নাড়ল স্টিভ। না…আমি একাকী থাকতেই ভালোবাসতাম।

তোমার গার্লফ্রেণ্ড ছিল না?

চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল স্টিভের। আমার বয়স তখন মাত্র চোদ্দ।

তো? তোমরা, আমেরিকানরা তো আরও আগেই মেয়েদের প্রেমে পড়ো। তোমার জীবনে বিশেষ কেউ ছিল না?

বললামই তো এখানে আমার জীবন খুব একটা ভালো কাটেনি। অন্য কথা বলো। এসব নিয়ে বলতে ভাল লাগছে না।

সিধে হলো সোহানা। বাসনগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে বলল, ঠিক আছে। তোমার ভালো না লাগলে এ প্রসঙ্গ থাক।

শোনো, শক্ত গলায় বলল স্টিভ। আমি এখানে আসতে চাইনি। তোমার চাপাচাপিতে আসতে হলো। এটুকুই যথেষ্ট নয় কী?

না। এটুকুই যথেষ্ট নয়, স্টিভের দিকে ফিরল সোহানা। তোমার হয়েছেটা কী? তখন থেকে দেখছি মুখটা রামগরুড়ের ছানা করে রেখেছে।

সোহানার কাছে হেঁটে এল স্টিভ, চুমু খেল গালে, ডান হাত আলতো ছুঁয়ে গেল স্ত্রীর ঘাড় এবং কাঁধ। দুঃখিত, সোহানা, বলল ও। এ জায়গাটা আমার ভালো লাগে না। আমি এখানে কোনও দিনই আসব না ভেবেছিলাম। এখানে এলে অতীত স্মৃতি মনে পড়ে যায়।

সোহানা আয়ত চোখ রাখল স্টিভের চোখে। এ জায়গা নিয়ে তোমার জীবনের কোনও খারাপ ঘটনা ঘটেছে, না?

আমি জানি না, ধীরে ধীরে বলল স্টিভ। আমি সত্যি জানি না কী ঘটেছিল…

জানালা দিয়ে বাইরে, লেকের কাঁচের মত স্বচ্ছ, কালো, তেলতেলে জলে তাকাল স্টিভ।কালো জলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এল রাতজাগা পাখির ডাক।

ভয়ার্ত এবং ব্যথাতুর আর্তনাদ।

.

পরদিন জোরে জোরে বাতাস বইতে লাগল। সোহানা ধরে বসল সে লেক ঘুরে দেখবে। এটা কেমন জায়গা আমি দেখতে চাই। রাজি হতেই হলো স্টিভকে। ওর বাবার ইঞ্জিনচালিত একটা রোবোট আছে। ওটায় চড়ে দুজনে ভেসে পড়ল লেকে। ইঞ্জিনের শব্দ খালি কেবিনে যেন প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে এল।

বিশাল লেকে শুধু ওরা দুজন। আর কেউ নেই।

এদিকে আর কাউকে দেখছি না কেন? জানতে চাইল সোহানা।

গরম শেষ হলে এদিকে আর কেউ পা মাড়ায় না। অক্টোবরে এদিকে এমন ঠাণ্ডা পড়ে, কেউ সাঁতার কাটা কিংবা বোট চালানোর কথা ভুলেও ভাবে না। আর আজ অক্টোবরের শেষ। ওর কথার সত্যতা প্রমাণ করতেই যেন বেড়ে গেল বাতাসের গতি, পাহাড় বেয়ে নেমে এল হাড় জমাট বাঁধা শীতল হাওয়া।

ফিরে যাই চলো, বলল সোহানা। পাতলা সোয়েটারে শীত মানছে না। জ্যাকেট নিয়ে আসা উচিত ছিল। স্ত্রীর কথা শুনছে না স্টিভ, স্থির দৃষ্টি পাথুরে তীরে। হাত তুলে দেখাল, ওখানে কে যেন বসে আছে,কাঁপা গলা ওর। পাথরের স্তূপের পাশে।

কই, আমি তো কাউকে দেখছি না।

ওই তো বসে আছে, ঢোক গিলল স্টিভ। আমাদেরকে দেখছে। নড়াচড়া করছে না।

স্টিভের কণ্ঠ কেমন ভৌতিক এবং অপার্থিব। অস্বস্তি লাগল সোহানার। কই আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। কথাটা পুনরাবৃত্তি করল সে।

ঈশ্বর! স্টিভ ঝুঁকে এল সোহানার দিকে। তুমি কি কানা? ওই তো…পাথরের ওপরে। তীরের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে স্টিভ।

আমি শুধু পাথর দেখতে পাচ্ছি। তবে, বাতাসে হয়তো কোনও কিছু উড়ে এসে পড়েছে

চলে গেছে, সোহানার কথা কানে যায়নি স্টিভের। এখন কেউ নেই ওখানে।

আউটবোর্ডের থ্রটল সামনের দিকে ঠেলে দিল স্টিভ, লেকের কাকচক্ষু জলের বুক চিরে তীরে অভিমুখে ছুটল বোট।

জলের ওপর দিয়ে উড়ে গেল একটি বাজপাখি, শিকারের সন্ধানে।

গাঢ় ধূসর আকাশের কফিনে শুয়ে বিশ্রাম নিতে চলেছে ক্লান্ত সূর্য।

আজ রাত হবে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার একটি রাত। রাত একটার দিকে, আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ, কেবিনে ঘুমাচ্ছে সোহানা, স্টিভ নিঃশব্দে দরজা খুলে চলে এল লেকের ধারে, বোল্ডারগুলোর পাশে। পরনের ভেড়ার চামড়ার জ্যাকেট ভেদ করে চামড়ায় ধারাল ছুরির পোচ বসাচ্ছে কনকনে উত্তুরে বাতাস।

তবে বাইরের ঠাণ্ডা কাবু করতে পারেনি স্টিভকে, ভেতরের হিমধরা ভয় ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপ্টে রেখেছে সাপের কুণ্ডলীর মত।

ভয় পাচ্ছে স্টিভ কারণ ভয় পাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গ্রনিট পাথরে নিশ্চল যে মূর্তিটি ও দেখেছিল, তার সঙ্গে ডায়মণ্ড লেককে নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠার নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে।

মনে মনে যা ভেবেছিল স্টিভ, তাই ঘটল। আবার আবির্ভূত হলো সেই মূর্তি। পাইনের জঙ্গলের ঘন আঁধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক নারী, কুড়ি/একুশ হবে বয়স, লম্বা, কোমর ছাপানো চুল, শিকারের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার উন্মুখ ভঙ্গি দেহে, দীঘির অতল জলের মতই মিশমিশে কালো, জ্বলজ্বলে চোখ। তার পরনে লম্বা, সাদা গাউন। জোছনায় রুপোর মত ঝলমল করছে। সে এগিয়ে এল স্টিভের দিকে।

লেকের তীরে মুখোমুখি হলো দুজন।

জানতাম একদিন না একদিন তুমি ফিরে আসবেই, নারীমূর্তি হাসল স্টিভের দিকে তাকিয়ে। তার কণ্ঠ মার্জিত, হাসিমাখা, তাতে উষ্ণতা অনুপস্থিত।

স্থির চোখে মেয়েটিকে দেখছে স্টিভ। কে তুমি?

তোমার অতীতের একটা অংশ। হাত বাড়িয়ে দিল নারী। খুলল মুঠো। তালুতে ব্রোঞ্জের একটি চেইন, তাতে ছোট্ট মুক্তো বসানো। শেষ যেবার তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয় তারপর থেকে আমি এটা গলায় পরে আছি। তখন আমি সবে তেরোতে পা দিয়েছি। আর তুমি চৌদ্দ।

ভেনেট, ফিসিফিস করে নামটা উচ্চারণ করল স্টিভ, নারীর গভীর কালো চোখের মাঝে যেন হারিয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। ভীত হয়ে উঠল পরক্ষণে। জানে না কেন তবে মেয়েটি তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।

তুমি আমাকে চুমু খেয়েছিলে, স্টিভি, বলল সে। আমি তখন ছোট্ট লাজুক একটি গেঁয়ো মেয়ে। আর আমার জীবনে তুমিই প্রথম পুরুষ যে আমাকে চুমু। খেয়েছো।

মনে আছে আমার, বলল স্টিভ।

আর কী মনে আছে তোমার? জিজ্ঞেস করল তরুণী। মনে পড়ে এখানে, এই পাথরের ওপর বসে তুমি আমাকে চুম্বন করেছিলে? সেটা ছিল গ্রীষ্মের এক রাত। লাখ লাখ তারা জ্বলছিল আকাশে। লেক ছিল শান্ত এবং সুন্দর। মনে পড়ে, স্টিভি?

আ…আ আমার মনে পড়ছে না, তোতলাচ্ছে স্টিভ।

তুমি ওই স্মৃতি কবর দিয়ে রেখেছ, বলল মেয়েটি। তোমার মন সে রাতের। স্মৃতির ওপর পর্দা ফেলে রেখেছে তোমাকে রক্ষা করার জন্য। বেদনা থেকে দূরে রাখার জন্য।

আমি তোমাকে নেকলেস দেয়ার পরে, ধীরে ধীরে বলল স্টিভ, উপযুক্ত হাতড়ে বেড়াচ্ছে, মনে করার চেষ্টা করছে, আমি… তোমাকে স্পর্শ করি… তুমি তোমার শরীর আমাকে ছুঁতে দিতে চাওনি, কিন্তু আমি–

তুমি আমাকে ধর্ষণ করেছিলে, মেয়েটির কণ্ঠ যেন হিমশীতল সিল্ক। আমি কাঁদছিলাম, তারস্বরে চিৎকার করছিলাম, তোমাকে মিনতি করছিলাম থামার জন্য, কিন্তু তুমি আমার কথা শোনননি। তুমি আমার পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছিলে, আমাকে ব্যথা দিয়েছ। অনেক অনেক ব্যথা দিয়েছ।

সে রাতের প্রতিটি দৃশ্য পরিষ্কার ফুটল স্টিভের মনছবিতে। ভেনেটের অনাঘ্রাতা কুমারী শরীরে প্রবেশ করার পরে কিশোরী তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিল… তবে এরপরে কী ঘটেছে মনে নেই ওর।

আমি চিৎকার করছিলাম বলে তুমি রেগে গিয়েছিলে, তরুণী মনে করিয়ে দিল স্টিভকে। কী রাগ সেদিন তোমার! আমি চিৎকার করছি আর তুমি আমার চিৎকার বন্ধ করার জন্য একের পর এক ঘুসি মেরে আমার মুখটাকে থেতলে দিয়েছ।

আমি দুঃখিত, বলল স্টিভ। খুবই দুঃখিত… আ-আমার মাথাটা বোধহয় সেদিন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

এরপরে কী ঘটেছিল মনে আছে তোমার?

মাথা নাড়ল স্টিভ। না…কিছু মনে পড়ছে না।

আমি, বলব কী ঘটেছিল?

হ্যাঁ, নিচু গল্লায় বলল স্টিভ, মেয়েটি যা বলবে নিশ্চয় সুখকর কিছু নয়। তবু ও জানতে চায়।

তুমি একটি পাথর তুলে নিয়েছিলে। বড় একখণ্ড পাথর। বলল ভেনেট। তারপর পাথর দিয়ে বাড়ি মেরে আমার মাথাটাকে প্রায় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিলে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর তুমি আমাকে তোমার বাবার বোটে তুলে নাও… ওই বোটটা, রো বোটটা হাত তুলে দেখাল সে। বোট নিয়ে চলে এসেছিলে লেকের ঠিক মাঝখানে। বোটে লোহার নোঙর এবং কিছু রশি ছিল। তুমি রশি দিয়ে আমাকে বেঁধে ফেললে যাতে সাঁতার কাটতে না পারি। তারপর

না! হাপরের মত ওঠানামা করছে স্টিভের বুক। বিস্ফারিত চোখ। আমি ওটা করিনি! গডড্যাম ইট, আমি ওই কাজ করিনি!

নিরুত্তাপ স্বরে বলে চলল তরুণী, তুমি আমাকে বোটের পাশ দিয়ে পানিতে ঠেলে ফেলে দিলে, পায়ে নোঙর বাঁধা। আমি তলিয়ে যাই পাতালে। আর উঠতে পারিনি। লেকে সলিল-সমাধি ঘটে আমার।

মিথ্যা কথা! তুমি বেঁচে আছ। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছ। জ্যান্ত!

আমি দাঁড়িয়ে আছি বটে তবে বেঁচে নেই। যদি বেঁচে থাকতাম তাহলে এখন এতটাই বড় হতাম আমি। এরকমই চেহারা থাকত আমার।

এসব–স্টিভের গলা কাঁপছে। তুমি নিশ্চয় আশা করছ না যে আমি বিশ্বাস করব

-যে তেরো বছরের একটি কিশোরীকে তুমি খুন করতে পার? কিন্তু ঠিক এক কাজটাই তুমি করেছ। তুমি দেখবে ওরা যখন আমাকে লেক থেকে তুলল ওই সময় আমাকে কেমন দেখাচ্ছিল…? রশির বাঁধন আলগা হয়ে যাওয়ার পরে আমি পানির ওপরে ভেসে উঠি।

কদম বাড়াল তরুণী। কাছিয়ে এল। আরও কাছে।

কাছে এসো না। খবরদার! চেঁচিয়ে উঠল স্টিভ, ঝট করে এক কদম পিছাল। চলে যাও!

স্টিভের সামনে এখন একটি কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে। হাসছে। তার মাথার বামদিকের হাড় ভেঙে চুরচুর হয়ে গেছে, চাঁদের আলোয় বীভৎস সাদা দেখাচ্ছে, শরীরটা ফুলে ঢোল, কুচকুচে কালো। তার একটা চোখ অদৃশ্য, খেয়ে ফেলেছে। জলজ কোনও প্রাণী, পরনের পোশাক ভেজা, পচা, কাদামাখা।

.

হাই, স্টিভি, খনখনে গলায় ডাকল সে।

ভৌতিক দেহটার সামনে থেকে চরকির মত ঘুরেই দৌড় দিল স্টিভ। প্রচণ্ড আতঙ্কে উন্মাদের মত ছুটছে। সর্বশক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছে। অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে প্রাণপণে ছুটছে। পালিয়ে যাচ্ছে লেকের তীর এবং ভয়ঙ্কর ওই জিনিসটার কাছ থেকে। ছুটতে ছুটতে বেদম হাঁফিয়ে গেল স্টিভ, গলা আগুনের মত জ্বলছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, পা আর টানতে চাইছে না শরীর। দম নিতে দাঁড়িয়ে পড়ল স্টিভ। একহাতে জড়িয়ে ধরে থাকল পাইনের গুঁড়ি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত স্টিভ আস্তে আস্তে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। জোছনায় প্লাবিত এ নিবিড় অরণ্যে ওর ঘনঘন নিঃশ্বাস নেয়া এবং দম ফেরার শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। তারপর, আস্তে আস্তে, যখন স্বাভাবিক হয়ে আসছে দম, মাথা তুলে চাইল স্টিভ এবং…ওহ গড, ওহ ক্রাইস্ট…

ওই যে সে!

ভেনেটের বিকটভাবে ফুলে থাকা বিশ্রী মুখটা স্টিভের কাছ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। মাংস গলে গলে পড়া, সাদা হাড় বেরিয়ে থাকা হাতটা বাড়িয়ে দিল প্রেতিনী, স্পর্শ করল স্টিভের গাল….

.

দুই বছর পরে, সোহানা ডায়মণ্ড লেকের বাড়িটি বিক্রি করে চলে এল বাংলাদেশে। জাভেদ চৌধুরী নামে এক সুদর্শন যুবকের প্রেমে পড়ল সে। জাভেদ একদিন কথায় কথায় জানতে চাইল সোহানার প্রথম স্বামীর খবর। ভাবলেশশূন্য মুখে সোহানা বলল, ও ডুবে মরেছে। ফ্লোরিডার ডায়মণ্ড লেকে।

 

ফোবিয়া

একেকজন মানুষের একেক রকম ফোবিয়া থাকে-এ এমন এক অস্বাভাবিক ভয় যার ওপর লোকের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কেউ মাকড়সা দেখলে অজ্ঞান হয়ে যায় ভয়ে, কারও রয়েছে তেলাপোকা ভীতি। তবে ইলেন ইঁদুর দেখলেই ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। আর ইঁদুর নিয়ে সে রাতে ওর জীবনে যে ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটল…।

.

ছোট রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার খেয়ে বেরুতে বেরুতে রাত আটটা বেজে গেল। রেস্টুরেন্টটি বড় পার্কটির এক কোণে। গরমের রাত। ইলেন সিদ্ধান্ত নিল হেঁটেই বাড়ি ফিরবে। ওর বাসা বেশি দূরে নয়, পার্ক থেকে মাত্র কয়েকশো গজ।

ইলেন ঢুকে পড়ল পার্কে। মাথার ওপর ডালপালা নিয়ে ঝুঁকে আছে গাছ। রাস্তাটা নির্জন এবং একটু যেন বেশিই অন্ধকার। গা কেমন ছমছম করে ওঠে ইলেনের। কদম দ্রুত হলো ওর। এ পার্ক নিয়ে নানা অদ্ভুতুড়ে গল্প শুনেছে ইলেন। যদিও বিশ্বাস করেনি সেসব কাহিনি।

অন্ধকার রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভোলা একটা জায়গায় চলে এল ইলেন। আধখানা চাঁদ উঠেছে আকাশে। এদিকটাতে অল্প জোছনা। চলার গতি কমিয়ে দিল সে, যদিও মন থেকে অস্বস্তি ভাবটা দূর হচ্ছে না।

পার্কের মাঝখানে বড়সড় একটি লেক। যে রাস্তা ধরে হাঁটছে ইলেন, ওটা সোজা লেকের দিকে চলে গেছে। এ রাস্তার মাথায় আরেকটা পথ দেখতে পেল ইলেন। ওখানে কেউ নেই। পেছন ফিরে তাকাল ও, ভাবছে ফিরতি পথ ধরবে কিনা। কিন্তু ও পার্কের মাঝামাঝিতে চলে এসেছে। এখন আবার ফিরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।

রাস্তায় পাতার খসখস ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। বাতাসে দুলছে ডাল, খসখস শব্দ তুলছে পাতায়। ব্যস্ত শহরের দূরের কোলাহল পার্কের নীরবতা ভঙ্গ করতে পারেনি। ইলেন হাঁটছে, রাতের বাতাসে পাতার ফিসফিসানি। মনে হচ্ছে ও যেন সভ্যতা থেকে হাজার মাইল দূরে। হঠাৎ আরেকটা শব্দে খাড়া হয়ে গেল। কান। পাতা বা অন্য কিছুর শব্দ নয়, ভিন্ন একটা আওয়াজ। পায়ের শব্দ। আমারই পায়ের শব্দ, নিজেকে বোঝাতে চাইল ইলেন।

না, সিমেন্টের রাস্তায় যে শব্দটা উঠেছে ওটা ইলেনের পায়ের আওয়াজ নয়। অন্য কারও পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনি তুলছে। ভয় ঢুকে গেল ইলেনের মনে। ধড়াশ ধড়াশ লাফাতে লাগল কলজে। চলার গতি বেড়ে গেল।

ইলেনের ভয় পাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ পেছনের পায়ের শব্দটা হচ্ছে ওর পা ফেলার শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ইলেন জোরে হাঁটলে পেছনের জনও জোরে হাঁটছে।

ঝেড়ে দৌড় দেয়ার ইচ্ছেটা বহু কষ্টে দমন করল ইলেন। ওর পেছনে যে-ই থাকুক, তাকে বুঝতে দেয়া যাবে না ও ভয় পেয়েছে। ইচ্ছে করে হাঁটার গতি মন্থর করল ইলেন। কিন্তু অনুসরণকারী মোটেই গতি কমাল না। দ্রুত হয়ে উঠল তার পদশব্দ।

নিজের ওপর আর নিয়ন্ত্রণ রইল না ইলেনের। দৌড় দিল ও। ছুটতে লাগল রাস্তা ধরে। কয়েক সেকেণ্ড পেছনে কোনও শব্দ পেল না ইলেন। তারপর, ওর হৃৎপিণ্ডের দিড়িম দিড়িম ঢাকের শব্দ ছাড়িয়ে পেভমেন্টে ভেসে এল দ্রুত এবং ছন্দবদ্ধ ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ।

লেক সোজা যে রাস্তাটি চলে গেছে, ওটাতে উঠে এল ইলেন। অনেকেই পার্কে হাওয়া খেতে এসে লেকের ধারে বসে থাকে। ইলেন আশা করল এমন কাউকে দেখতে পাবে। ছোট একটি টিলা বেয়ে নেমে লেক অভিমুখে ছুটল ও। মোড় ঘুরল। দপ করে নিভে গেল আশার আলো। লেকের রাস্তায় জন-মানুষের চিহ্নমাত্র নেই। ইলেন টের পেল টিলা বেয়ে নেমে আসছে তার অনুসরণকারী পায়ের শব্দ : হচ্ছে। থপ থপ থপ থপ। ওকে এই ধরল বলে!

উন্মাদের মত চারপাশে চোখ বুলাল ইলেন। বামে বেশ ঘন ঝোঁপ আর কতগুলো গাছ দেখতে পেল। ছুটে গেল ওদিকে, চট করে লুকিয়ে পড়ল ঝোঁপের আড়ালে।

এদিকে গাছপালার সারি। ঘন বলে চাঁদের আলোর অবাধ প্রবেশের সুযোগ নেই। ডাল আর পাতার আবরণী ভেদ করে যেটুকু আলো প্রকৃতির বুকে পৌঁছেছে। তাতে অন্ধকার দূর হয়েছে সামান্যই। ইলেন প্রথমে পায়ের শব্দ শুনতে পেল তারপর দেখতে পেল পায়ের মালিককে।

লোকটা ইলেনের লুকানো জায়গা থেকে কুড়ি ফুট দুরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। ইলেনের দিকে পেছন ফেরা। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর পা বাড়াল লেকের ধারের বেঞ্চিতে। বসল।

ঝোঁপের আড়ালে বসে ঘেমে ভিজে একাকার ইলেন। ওর এখানে লুকিয়ে পড়া মোটেই উচিত হয়নি। লোকটা নিশ্চয় টের পেয়েছে ও কোথায় লুকিয়েছে। লোকটা কি অপেক্ষা করছে কখন ইলেনের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে এবং আড়াল ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে? অবশ্য ইলেনের ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে পার্কের ভ্রমণকারীরা হাঁটতে হাঁটতে এদিকে চলে আসতে পারে। ও তখন লাফ মেরে বেরিয়ে আসবে ঝোঁপের আড়াল থেকে, লোকের ভিড়ে মিশে গিয়ে বেরিয়ে পড়বে পার্ক থেকে।

বেঞ্চিতে বসা লোকটার দিকে আবার তাকাল ইলেন। সে চুপচাপ বসেই আছে, স্থির দৃষ্টি লেকে। হঠাৎ কী যেন একটা নজর কাড়ল ইলেনের। পানির ধারে কীসের একটা ছায়া, এগিয়ে আসছে। বিরতি দিল। এবারে ওটাকে পরিষ্কার দেখতে পেল ইলেন। বড় একটা ইঁদুর। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লাফ মেরে উঠতে গেল ইলেন নিজেকে দমন করল বেঞ্চির লোকটার কথা ভেবে। গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া চিৎকারটাকেও একই সঙ্গে গলা টিপে মারল।

যেন দুঃস্বপ্ন দেখছে ইলেন, বড়টার সঙ্গে আরও তিনটে ইঁদুর যোগ দিল। চাঁদের আলোয় ওদের বিকট ছায়া এবং কুৎসিত মুখগুলো দেখতে পাচ্ছে ইলেন। সিমেন্টের রাস্তায় প্রাণীগুলোর থাবার আওয়াজ উঠল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করল ইলেনের, মন চাইল ছুট দেয়। কিন্তু বেঞ্চিতে বসা লোটার ভয়ে কিছুই করতে পারল না।

লোকটা পাথরের মূর্তি হয়ে বসে আছে বেঞ্চে, ইঁদুরগুলো তার কাছ থেকে তিন হাত দূরেও নেই। ওগুলোকে নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছে সে, ভাবল ইলেন। কিন্তু তার। মাঝে কোনও ভাবান্তর নেই। কেমন লোক এ?

ইঁদুরের দিকে চোখ ফেরাল ইলেন। ওরা যেন সম্মোহন করেছে ওকে। ঝোপে, দুই ফুট দূরে খস খস একটা শব্দ হলো। চিৎকার বন্ধ করার জন্য মুখে সোয়েটার চেপে ধরল ইলেন। যদি ওর দিকে ছুটে আসে কোনও ইঁদুর? ধারাল নখ বাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে?

এমন সময় তীব্র আতংক নিয়ে ইলেন দেখল লেকের ধারের চারটে ইঁদুর ওকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে। ওদের ধারাল মুখগুলো যেন উঁচিয়ে আছে ইলেনের দিকেই। লম্বা লেজ নড়ছে ডানে-বামে।

চিৎকার দিল ইলেন। উঠে দাঁড়াল বেঞ্চির লোকটা। ঝোঁপের দিকে আসছে। হাঁচড়ে পাঁচড়ে সিধে হলো ইলেন। পিছিয়েছে এক কদম, একটা পা গিয়ে পড়ল গভীর একটা গর্তে। এটা ইঁদুরের গর্ত। ডজন খানেক ইঁদুরের বাচ্চা ব্যথা এবং ভয়ে কিকি করে উঠল। পিলপিল করে বেরিয়ে এল গর্ত ছেড়ে। ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। এক ঝটকায় গর্ত থেকে পা বের করে আনল ইলেন। আবার পিছিয়েছে, ওর পা চাপা পড়ে ভর্তা হয়ে গেল একটি বাচ্চা ইঁদুরের নরম শরীর। মরণ যন্ত্রণায় কিইইচ করে উঠল ওটা। ইলেন গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল।

লোকটা ক্রমে কাছিয়ে আসছে। ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে পড়ার প্রাণপণ চেষ্টা করল ইলেন। কিন্তু প্রচণ্ড ভয়ে জমে যাওয়া দুর্বল হাঁটু যেন সাড়া দিতে চাইছে না। কোনও মতে ঘন ঝোঁপঝাড় ঠেলে বেরিয়ে এল ও, পা রাখল রাস্তায়।

লোকটা দেখে ফেলেছে ইলেনকে। আরও কাছে চলে এসেছে সে। চাঁদের স্নান আলোয় তার মুখ দেখতে পেল ইলেন। ভয়ে শরীরের সব কটা রোম দাঁড়িয়ে গেল। ওটা মোটেই মানুষের মুখ নয়! ওটা একটা ইঁদুরের মস্ত মুখ, মুখটা নড়ছে, সেইসঙ্গে নড়ছে মুখের দুপাশের গোঁফ।

ঘুরেই ছুট দিল ইলেন। প্রচণ্ড ভয়ে দিশাহারা হয়ে দৌড়াতে লাগল ও। পেছনে ভেসে এল অসংখ্য ইঁদুরের ভয়ঙ্কর কিকি নিনাদ।

ছুটতে ছুটতে পার্কের এক্সিট লেখা গেটের প্রায় কাছাকাছি এসে গেল ইলেন। আর মাত্র দশ গজ। তারপরই ওর মুক্তি। আশ্চর্য! গেটের কাছে কেউ নেই। একজন ভ্রমণকারীও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তাতে কী? ইলেন তো এখনই বেরিয়ে পড়বে। হঠাৎ ওর কলজে হিম হয়ে গেল ঠিক ওর পেছনে তীব্র কিইইচ শব্দ হতে। আঁতকে উঠে পাই করে ঘুরল ও। ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইঁদুর-মানব। জ্বলজ্বল করছে চোখ। দৃষ্টিতে বিকট উল্লাস। কই, দানবটার ছুটে আসার শব্দ তো পায়নি ও। ইলেনের মুখ হাঁ হয়ে গেল, চিৎকার দেবে। লম্বা, ধারাল থাবা আছড়ে পড়ল মুখে। চিৎকারটা আর মুখ ফুটে বেরুতে পারল না। তার আগেই আঁধার হয়ে এল ইলেনের দুনিয়া।

 

 

 

 

 

 

ভ্যাম্পায়ার

রক্তলাল রঙ ছড়িয়ে পাহাড়ের ওপারে ডুব দিচ্ছে সূর্য। ধারাল বাতাসের তাড়া খেয়ে ঝরে পড়া শুকনো পাতাগুলো পশ্চিমে এমনভাবে ধেয়ে যাচ্ছে, যেন সূর্যের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে যাচ্ছে ওগুলো।

নিজেকে জড়বুদ্ধির লোক বলে তিরস্কার করল হেনডারসন। থমকে দাঁড়িয়ে মগ্ন হলো ভাবনায়। আঁধার নামতে আর বেশি দেরি নেই। সস্তা কল্পনায় গা ভাসিয়ে কী লাভ?

মাথামোটা? আবার বলল হেনডারসন।

চিন্তাটা সম্ভবত দিনের বেলায়ই তার মাথায় আসে, এবং তখন থেকেই সে আনমনা। হ্যালোইনের ভয়াল রাত আজ। পৃথিবীর সব গোরস্থানে জেগে উঠবে মৃতেরা। আত্মাগুলো বেরিয়ে আসবে কবর ছেড়ে।

অন্যান্য দিনের মতই আরেকটা ঠাণ্ডা, পচা দিন আজ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল হেনডারসন। এমন একটা সময় ছিল, আপনমনে ভাবল সে, যখন এ রাত আসা মানেই ছিল ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার। অশুভ আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠত গোটা অন্ধকার ইউরোপ। অজানা ত্রুর হাসির উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত হত এই সন্ধে। অশুভ দর্শনার্থীদের ভয়ে রুদ্ধ হত একটার পর একটা দরজা, একান্ত প্রার্থনায় বিভোর হত অগণিত মানুষ, ঘরে ঘরে জ্বলে উঠত লক্ষ লক্ষ মোম। চিন্তাভাবনায় জাকাল একটা ব্যাপার ছিল তখন, গভীরভাবে উপলব্ধি করল হেনডারসন। রোমাঞ্চে পরিপূর্ণ ছিল সেই জীবন। মধ্যরাতের পথচারীরা সিটিয়ে থাকত আতঙ্কে, না জানি কী আছে সামনের বাঁকটায়। ভূত-পিশাচ আর অপদেবতার জগতে বাস করে আত্মাকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করত তারা। সে সময় বিশেষ একটা তাৎপর্য ছিল মানুষের আত্মার। এখন দিন বদলেছে। নাস্তিক্য এসে দূরে ঠেলে দিয়েছে আগের সেই ধারনাকে। মানুষ আগের মত আর শ্রদ্ধা করে না তার আত্মাকে। তবু এই বিংশ শতাব্দীতেও ছাড়া ছাড়া কিছু ঠুনকো বিশ্বাস আঁকড়ে আছে মানুষ, যেগুলো তাদের কল্পনার ডানা মেলতে গিয়ে বার বার হোঁচট খায়।

বেকুব! সম্পূর্ণ অজান্তেই আবার বলে উঠল হেনডারসন। আসলে তার মানব সত্তাকে হটিয়ে দিয়ে ভিন্ন একটা সত্তা ঠাঁই নিয়েছে মাথায়। পাছে প্রেতলোকের ওই জীবগুলো তার গোপন পরিকল্পনার কথা জেনে ফেলে, এই ভয়ে বার বার নিজেকে ভর্ৎসনা করছে সে। ওদের রক্তচক্ষু ফাঁকি দেয়ার একটা প্রাণপণ চেষ্টা আর কী।

রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কসটিউমের একটা দোকান খুঁজছে হেনডারসন। জমকালো একটা পোশাক চাই তার। আজ রাতের ছদ্মবেশ-উৎসবে পরতে হবে। দেরি হলে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্যে হ্যালোইন নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করতে রাজি নয় সে।

সরু গলির দুপাশে সার বেঁধে দাঁড়ানো দালানগুলোতে তীক্ষ্মদৃষ্টিতে অনুসন্ধান করছে হেনডারসন। আঁধার ক্রমশ ছায়া ফেলছে দালানগুলোর গায়ে। ফোন-বুকে টানা হাতে লেখা ঠিকানাটার দিকে আবার তাকাল সে। কিন্তু আলোর স্বল্পতায় পড়তে পারল না। বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকাল হেনডারসন। সন্ধে নামা সত্ত্বেও হতচ্ছাড়ার দল দোকানগুলোতে আলো দিচ্ছে না কেন? এই দরিদ্র ঘিঞ্জি এলাকায় খোঁজাখুঁজি করতে আসাটাই একটা ঝক্কির ব্যাপার, কিন্তু তবু

হঠাৎ করেই সেই দোকানটা পেয়ে গেল হেনডারসন। রাস্তার ঠিক ওপারেই। রাস্তা পেরিয়ে দোকানের জানালায় গিয়ে দাঁড়াল সে। উঁকি দিল ভেতরে। অস্তগামী সূর্যের শেষ আলো এসে দালানের কপালে তির্যকভাবে পড়ে সড়াৎ করে নেমে এসেছে জানালা আর ডিসপ্লেতে। চেপে রাখা ধারাল শ্বাসটুকু টেনে নিল হেনডারসন।

একটা কসটিউমের দোকানের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে সে-নরকের কোন ফাটল দিয়ে নয়। তা হলে ডিসপ্লেটা অমন গনগনে লাল দেখাচ্ছে কেন? থরে থরে সাজানো মুখোশগুলো কী ভীষণ দেখাচ্ছে এই আলোতে! যেন একদল পিশাচ দাঁত বের করে হাসছে।

গোধূলির রঙ, নিজেকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল হেনডারসন। আসলে মুখোশগুলোর সাজানোর ঢঙই এরকম। তবু গা ছমছম করতে থাকে কল্পনাপ্রবণ লোকটার। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে সে।

জায়গাটা অন্ধকার এবং নীরব। ঘরের বাতাসে একাকীত্বের গন্ধ-যে গন্ধ নিরন্তর বিরাজ করে পৃথিবীর সব সমাধি, গভীর অরণ্য, আর দুর্গম পাহাড়ের গুহায় গুহায়। এবং-ধুশ-শালা! নিজের ওপর আবার রুষ্ট হলো হেনডারসন। আজ কী হয়েছে তার? ফাঁকা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে হাসল সে। নিজেকে সান্তনা দিল, এটা আর কিছু নয়, কসটিউম-শপের গন্ধ। গন্ধটা তাকে কলেজের সেই শখের নাটকের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। এই ন্যাপথালিন, জীর্ণ পশম, তেল আর রঙের গন্ধের সাথে তার পরিচয় অনেকদিনের। হ্যামলেট নাটকে অভিনয়ের সেই দৃশ্যগুলো মনে করতে করতে অজান্তেই একটা দাঁত কেলানো মাথার খুলি তুলে নিল সে।

সংবিৎ ফিরতেই খুলিটা তার মাথায় চমকপ্রদ একটা ফন্দি যোগাল। এই হ্যালোইনের রাতে অন্য সবার মত রাজা, তুর্কীবীর কিংবা জলদস্যু সেজে উৎসবে যাবার ইচ্ছে নেই তার। সাধারণ ছদ্মবেশে লিস্ট্রোমের ওখানে গেলে কেউ তাকে পাত্তাই দেবে না। তাছাড়া লিণ্ডস্ট্রোমও মনঃক্ষুণ্ণ হবে। কারণ তার সোসাইটির বন্ধুরা আসবে দামী পোশাকে ছদ্মবেশ নিয়ে। হেনডারসন অবশ্যি লিওস্ট্রোমের ওই কৃত্রিম বন্ধুদের তেমন একটা তোয়াক্কা করে না। আসবে তো সব মেয়েলি স্বভাবের পুরুষ, আর মণি-মুক্তোখচিত ভারি গয়না পরা ঘোড়াটা রমণীরা। তাদের ভড়কে দিয়ে হ্যালোইনের প্রাণসঞ্চার করতে ভয়ঙ্কর একটা কিছু সাজবে না কেন সে?

.

অপেক্ষায় থেকে হাঁপিয়ে উঠল হেনডারসন। পেছনের ঘর থেকে আলো নিয়ে আসছে না কেউ। মিনিট কয়েক পর ধৈর্য হারিয়ে ফেলল সে। কাউন্টারে সজোরে হাত চাপড়ে চেঁচাল, কে আছ! এদিকে এসো!

প্রথমে নীরবতা, তারপর অস্পষ্ট একটা নড়াচড়ার শব্দ শোনা গেল পেছনে। কী বিচ্ছিরি! একটু পরেই নিচের সিঁড়িতে পৌঁছুল শব্দটা। থপ্ থপ্ থপ্ করে ভারি পা ফেলে উঠে আসছে কেউ। সহসাই হাঁ করে শ্বাস টানল হেনডারসন। কালোমত কী একটা বেরিয়ে আসছে মেঝে খুঁড়ে!

আসলে ওটা বেসমেন্টের ট্র্যাপডোর। এইমাত্র খুলল। ল্যাম্প হাতে এক লোক বেরিয়ে এসে কাউন্টারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। ল্যাম্পের আলোয় হলদেটে দেখাচ্ছে মুখ। ঘুম জড়ানো চোখে পাতা পড়ছে ঘন ঘন।

লোকটা মৃদু হেসে নরম কণ্ঠে বলল, দুঃখিত, একটু ঘুমোচ্ছিলাম। তা আপনার জন্যে কী করতে পারি, স্যার?

হ্যালোইনের কসটিউম খুঁজছি আমি।

ও, আচ্ছা। তা কী ধরনের কসটিউম চাই আপনার?

কণ্ঠস্বরটা ক্লান্ত, খুবই ক্লান্ত। হলুদ চেহারায় নিস্তেজ একটা ভাব। চোখ দুটোতে ঘুমের রেশ কাটেনি এখনও।

প্রচলিত সাইজের বাইরে একটা ছদ্মবেশ নিতে চাই আমি। মানে উৎসবে গিয়ে সবাইকে একটু ভড়কে দিতে চাই আর কী।

কিছু মুখোশ দেখাতে পারি আপনাকে।

আরে না, নেকড়ে মানব সাজার কোন শখ নেই আমার। আমি চাই এমন একটা পোশাক, যা দেখে লোকে ছদ্মবেশটাকেই আসল রূপ মনে করে ভয় পাবে।

তা হলে সত্যিকারের পোশাক চাইছেন আপনি!

হ্যাঁ। হেনডারসনের মনে ক্ষীণ একটা সন্দেহ উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল। সত্যিকারের পোশাক বলতে কী বোঝাতে চাইছে মাথামোটা লোকটা?

সেরকম একটা পোশাক বোধহয় দিতে পারব, সার। চোখ পিট পিট করে বলল সে। তার ঠোঁট জোড়ার ভাঁজে হাসির রেখা। জিনিসটা শুধু হ্যালোইনের জন্যেই।

কী রকম?

রক্তচোষা পিশাচের কথা ভেবেছেন কখনও?

ড্রাকুলার মত?

জ্বী, জ্বী ড্রাকুলা।

আইডিয়াটা মন্দ নয়। কিন্তু আমাকে ওই পোশাকে মানাবে তো?

আঁটো হাসি ফুটল লোকটার মুখে। হেনডারসনের আপাদমস্তক জরিপ করে বলল, খুব মানাবে।

বেঢপ প্রশংসা! বিদ্রুপের ভঙ্গিতে হাসল হেনডারসন। তা কোথায় সেই সাজ-পোশাক?

সাজ-পোশাক? এটা তো শুধুই একটা পোশাক। তাও রাতের।

রাতের?

জ্বী, এজন্যেই তো দিচ্ছি।

কী সেটা?

একটা আলখেল্লা। একেবারে আসল!

একটা আলখেল্লা-ব্যস, এই?

জ্বী, সার। শুধুই একটা আলখেল্লা। কিন্তু ওটা পরলে মনে হবে শবের কাফন। দাঁড়ান, নিয়ে আসছি।

নড়বড়ে পা দুটো টেনে টেনে আবার দোকানের পেছনে চলে গেল লোকটা। ট্র্যাপোর খুলে নেমে গেল নিচে। হেনডারসন দাঁড়িয়ে রইল অপেক্ষায়। নিচে আগের চেয়ে আরও বেশি খুটখাট দুমদাম্ হচ্ছে।

শিগগিরই ফিরে এল বুড়ো। হাতে একটি আলখেল্লা। অন্ধকারে ঝাঁকুনি দিয়ে আলখেল্লা থেকে ধুলো ঝাড়ল সে। তারপর বলল, এই নিন-আসল জিনিস।

আসল?

গায়ে দিলেই টের পাবেন। আশ্চর্য একটা ক্ষমতা আছে এটার-বিশ্বাস করুন!

ঠাণ্ডা, ভারি কাপড়টা কাঁধে চাপল হেনডারসনের। পেছনে এসে আয়নায় নিজেকে দেখার সময় ছত্রাকের পুরানো একটা অস্বস্তিকর গন্ধ পেল সে। আলখেল্লা থেকে আসছে। মৃদু আলো, তবু নিজের চেহারার অদ্ভুত পরিবর্তন নজর এড়াল না হেনডারসনের। তার লম্বাটে মুখটা আরও সরু দেখাচ্ছে, ফ্যাকাসে চেহারার মাঝে জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো। সমস্তই এই কালো পোশাকের জাদু। একটা বড়সড় কালো কাফন এটা।

নিখুঁত ছদ্মবেশ! বিড়বিড় করে বলল বুড়ো। আয়নায় কোন প্রতিবিম্ব পড়েনি বুডোর। নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকায় ব্যাপারটা টের পেল না হেনডারসন।

এটা নেব আমি, বলল হেনডারসন। বলল, কত দেব?

আমি নিশ্চিত, এই পোশাকে উৎসবে গেলে দারুণ মজা পাবেন।

আরে, দেব কত তাই বলল।

তা ডলার পাঁচেক দিলেই চলবে।

এই নাও।

ডলার পাঁচটা নিয়ে আলখেল্লাটা হেনডারসনের গা থেকে খুলে নিল বুড়ো। পোশাকটা কাঁধ থেকে নেমে যেতেই আবার স্বাভাবিক উষ্ণতা অনুভব করল হেনডারসন। দীর্ঘদিন বেসমেন্টের শীতল গহ্বরে ছিল বলেই হয়তো কাপড়টা অমন বরফের মত ঠাণ্ডা-ভাবল সে।

পোশাকটা ভাঁজ করে সহাস্যে হেনডারসনকে বুঝিয়ে দিল বুড়ো।

কালকেই এটা ফিরিয়ে দেব, প্রতিশ্রুতি দিল হেনডারসন।

দরকার নেই। এখন থেকে ওটা আপনার।

মানে?

খুব শিগগিরই ব্যবসা গোটাচ্ছি আমি। কাজেই পোশাকটা রেখে দিলে আমার চেয়ে আপনিই বেশি কাজে লাগাতে পারবেন।

কিন্তু–

কোন কিন্তু নয়, হেনডারসনকে থামিয়ে দিল বুড়ো। বিদায় জানাবার ভঙ্গিতে বলল, সন্ধেটা আপনার জন্যে আনন্দময় হয়ে উঠুক।

মনে একরাশ জড়তা নিয়ে রওনা হলো হেনডারসন। দরজা পর্যন্ত গিয়ে বুড়োকে বিদায় জানাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল সে। বুড়োর চোখের পাতা ধীরে লয়ে খুলছে, বন্ধ হচ্ছে। কাউন্টারের ওপাশ থেকে আরেক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে হেনডারসনের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সে দৃষ্টির আঁচ অনুভব করল না হেনডারসন। সে বুড়োকে শুভরাত্রি জানিয়ে দরজাটা ঝট করে ভিজিয়ে দিয়ে রাস্তায় নামল। যেতে যেতে অবাক হয়ে ভাবল, এ কোন্ পাগলামো করতে যাচ্ছে সে!

.

রাত আটটায় হেনডারসন টেলিফোনে লিণ্ডস্ট্রোমকে জানাল, পৌঁছুতে একটু দেরি হবে তার। আলখেল্লাটা গায়ে চাপাতেই আবার সেই ঠাণ্ডা ভাবটা চলে এল। নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার জন্যে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। তার দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে এল বার বার। আবছা একটা কায়া ছাড়া কিছু দেখতে পেল না আয়নায়। অল্প একটু ড্রিংক করার পর খানিকটা চাঙা বোধ করল হেনডারসন। গরম হয়ে উঠল গা। ড্রিংকস ছাড়া আর কিছু মুখে দিল না সে। ফ্লোর জুড়ে রক্তচোষা পিশাচের মহড়া দিয়ে বেড়াল কিছুক্ষণ। বাদুড়ে রূপান্তরিত হবার ভঙ্গিতে বার বার আলখেল্লার নিচের দিকটা ঝটকা মেরে কাঁধে তুলল ভ্রুকুটিপূর্ণ ভয়াল মূর্তিতে। এই ভয়ঙ্কর খেলায় প্রচুর আনন্দ পেল হেনডারসন। সত্যিই তাহলে একটা পিশাচ হতে যাচ্ছে সে!

কিছুক্ষণ পর লবিতে গিয়ে একটা ক্যাব ডাকল হেনডারসন। এগিয়ে এল ক্যাব। আলখেল্লা গুটিয়ে অপেক্ষা করছিল হেনডারসন, ক্যাবের চালক সেটা দেখামাত্র কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

ভাড়া যাবে? নিচু কণ্ঠে শুধোল হেনডারসন।

কো-কো কোথায়? ভয়ে গলা থেকে বেসুরো স্বর বেরোল তার।

প্রচণ্ড হাসি পেল হেনডারসনের। কিন্তু ছাড়ল না হাসিটা। বহু কষ্টে চেপে গিয়ে ভুরু কুঁচকে তীর্যক কটাক্ষ হানল লোকটার দিকে। আলখেল্লার নিচের প্রান্ত ঝটকা মেরে পেছনে তুলল।

যা-যা-যা-যাব! আসুন!

যেন পালাতে পারলে বাঁচে ড্রাইভার। হেনডারসন বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল।

কোথায় যাব, ব-বস্-মানে, সা-সার? তোতলাতে তোতলাতে জানতে চাইল সে।

কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব ফাসাসে বানিয়ে ঠিকানাটা বলল হেনডারসন। তারপর গাড়ির পেছনে গিয়ে বসল। ভীত ড্রাইভার ভুলেও আর তার দিকে তাকাল না।

একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করল ক্যাব। ড্রাইভারের ভয়চকিত ভাব দেখে। হাসি আর চেপে রাখতে পারল না হেনডারসন। তার অট্টহাসি শুনে আরও ঘাবড়ে গেল ড্রাইভার। সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি ছোটাল সে। তার কাণ্ড দেখে হেনডারসনের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার যোগাড়। আর ওদিকে ড্রাইভার বেচারা রীতিমত কাঁপতে শুরু করেছে। হেনডারসনকে জায়গামত পৌঁছে দিয়ে হাঁফ ছাড়ল সে। ভাড়া না নিয়েই কেটে পড়ল দ্রুত।

যাক, খাসা হয়েছে ছদ্মবেশটা! মনে মনে আত্মতৃপ্তি লাভ করল হেনডারসন। উৎসবে বেশ সাড়া জাগানো যাবে। ফুরফুরে মেজাজে এলিভেটরে গিয়ে উঠল সে। এগিয়ে চলল লিণ্ডস্ট্রোমের ঢালু ছাদের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে।

এলিভেটরে হেনডারসন একা নয়, আরও তিন-চারজন আছে। লিণ্ডস্ট্রোমের অ্যাপার্টমেন্টে এর আগেও এদের দেখেছে সে। কিন্তু একজনও তাকে চিনতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে না। উৎসাহ বেড়ে গেল হেনডারসনের। তার মেকি মুখভঙ্গি এবং অদ্ভুত আলখেল্লাটা আমূল বদলে দিয়েছে তাকে। আর এদের দেখো। দামী জবড়জঙ্গ পোশাকে একেকজনের ছদ্মবেশের কী বাহার! স্প্যানিশ ব্যালেরিনা সেজেছে এক মহিলা, এক লোক পরেছে বুল-ফাইটারের পোশাক, অন্য দুজন পুরুষ-মহিলারও ভিন্নরকম সাজ। তা যে বেশই ধরুক তারা, আসল চেহারা ঢাকতে পারেনি কেউ। হেনডারসন ভালো করেই জানে, ছদ্মবেশটা আসলে তাদের কাছে তেমন কিছু নয়। উৎসবে হাজির হওয়াটাই বড়। বেশিরভাগ মানুষই কসটিউম পার্টিতে আসে তাদের অবরুদ্ধ ক্ষুধার্ত বাসনাগুলোর বাস্তবায়ন ঘটাতে। মেয়েরা আসে তাদের অঙ্গসৌষ্ঠব দেখাতে, পুরুষেরা দেখাতে চায় পৌরুষ-বুল-ফাইটার কিংবা সার্কাসের ভাড়েরা যেমন দেখায়। এসব একদম বিচ্ছিরি লাগে হেনডারসনের। বাপুরা, বীরগিরী দেখাবে ভালো কথা। তা ঘরের ভেতর কেন? সাহস থাকে তো রাস্তায় নামো। তখন অত ভয় কীসের?

সবার ওপর একপলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল হেনডারসন। প্রত্যেকেই নিঃসন্দেহে দেখতে সুন্দর। চমৎকার স্বাস্থ্য এবং প্রাণ প্রাচুর্যেরও কমতি নেই। তাদের আছে উপযুক্ত সতেজ গলা এবং ঘাড়। পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির পেলব হাত দুটির দিকে তাকাল হেনডারসন। কোন কারণ ছাড়াই একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। তারপর সবিৎ ফিরতেই দেখে এলিভেটরের আরোহীরা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এককোণে। যেন তার সাজ পোশাক আর অভিব্যক্তি দেখে তারা আতঙ্কিত। তাদের কথাবার্তা বন্ধ। সবাই কেমন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে। পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু যেন বলতে চায় সে। কিন্তু তার আগেই এলিভেটরের দরজা খুলে গেল। একে একে বেরিয়ে এল সবাই।

একধরনের অস্বস্তি খচখচ করছে হেনডারসনের মনে। কোথাও ভুল হচ্ছে না তো। প্রথমে ড্রাইভার তরস্ত হলো, তারপর এরা। পানের মাত্রাটা কি বেশি হয়ে গেছে?

কিন্তু এ নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবতে পারল না হেনডারসন। মার্কাস লিস্ট্রোম তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির। হাতে একটা গ্লাস ধরিয়ে দিতে চাইছে সে।

আমরা তাহলে এই করতে এসেছি? হালকা সুরে বিদ্রূপ করল হেনডারসন। আরে, তুমি তো টলছ!

লিণ্ডস্ট্রোম যে মদের নেশায় চুর, একবার তাকিয়েই যে কেউ বুঝবে। মোটা মানুষটা অ্যালকোহলে সাঁতার কাটছে।

ড্রিংক নাও, হেনডারসন। আমি আর নেব না। তবে তোমার সাজগোজ দেখে চমকে গেছি ভাই। কোত্থেকে এমন মেক-আপ নিলে?

মেক-আপ? আমি তো মুখে কিছুই মাখিনি।

ওহ্, তাই তো। কী বোকা আমি!

লিণ্ডস্ট্রোমও ঘাবড়ে গেল নাকি? তার চোখ দুটোও কি শঙ্কায় পরিপূর্ণ? অবাক হয়ে গেল হেনডারসন-এতই ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে তাকে!

দাঁড়াও, ওদিকে একটু ঘুরে আসি, খানিকটা ইতস্তত করে দ্রুত সটকে পড়ল লিস্ট্রোম। ব্যস্ত হয়ে পড়ল অন্যান্য অতিথিদের নিয়ে। তার ঘাড়ের পেছনটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল হেনডারসন। কী পুরু আর সাদা! চামড়ার ভাঁজ ঝুলে পড়েছে। কলারের ওপর দিয়ে। একটা নীল শিরা ফুটে আছে ভীত লিণ্ডস্ট্রোমের ঘাড়ে।

হেনডারসন বাইরের ঘরে একাকী দাঁড়িয়ে। ভেতর থেকে গান-বাজনা আর হাসির শব্দ আসছে। বেশ কোলাহলমুখর উৎসব। ভেতরে ঢুকতে একটু দ্বিধা হচ্ছে হেনডারসনের। হাতের গ্লাসটাতে চুমুক দিল সে। বাকর্ডি রাম। কড়া পানীয়। সহজেই নেশা ধরে যায়। চুমুক দিতে দিতে ব্যাপারটা তলিয়ে দেখল হেনডারসন। সে ভয়াল একটা রূপ ধরতে চেয়েছে ঠিকই, কিন্তু সবাই এভাবে আতঙ্কে সিঁটিয়ে যাক-এতটা চায়নি। সত্যিই এই পোশাকের বিশেষ কোন ক্ষমতা আছে? পিশাচের আসল রূপ ফুটে উঠেছে তার মাঝে? লিওস্ট্রোম পর্যন্ত চমকে উঠে মেক-আপের কথা বলেছে। আচ্ছা, চেহারাটাই আগে দেখা যাক।

হলঘরের লম্বা প্যানেল মিররের দিকে এগোল হেনডারসন। একটু উঁকিঝুঁকি মেরে সোজা হয়ে দাঁড়াল চৌকোনা আয়নার সামনে। পেছন থেকে আসা উজ্জ্বল আলোয় আয়নার কাঁচের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল সে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না।

আয়নার সামনে সে জলজ্যান্ত বিদ্যমান, অথচ প্রতিবিম্ব পড়েনি! এটা কী করে সম্ভব?

চোখ দুটো ডলে নিয়ে আবার তাকাল সে। ফল একই। প্রতিবিম্ব নেই।

চাপা গলায় হেসে উঠল হেনডারসন। তার কণ্ঠের গভীর থেকে বেরোল এই খলখলে হাসি। ফাঁকা আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রমেই উঁচুতে চড়ল হাসি। হাসিতে কুটিল আনন্দ।

ভালো নেশা ধরেছে, অফুটে বলল হেনডারসন। একটু আগে তবু ঝাপসা প্রতিবিম্ব দেখেছি, আর এখন তো দেখতেই পাচ্ছি না। নেশার জন্যেই চেহারাটা ভীষণ হয়েছে। ভয় পাচ্ছে সবাই।

প্লিজ, একটু সরে দাঁড়াবেন!

একটা সুরেলা কণ্ঠে চমক ভাঙে হেনডারসনের। ঝট করে পেছনে ফেরে সে। তার মতই কালো পোশাক মেয়েটির। ফর্সা গর্বিত মুখ। মাথায় ঝিকমিকি করছে রেশমের মত চুলগুলো। নীল চোখে অপার্থিব দ্যুতি। ঠোঁট জোড়া টুকটুকে লাল। স্বর্গের দেবী সেজেছে মেয়েটি।

হেনডারসন নরম কণ্ঠে শুধোল, কে আপনি?

শীলা ডারলি। দয়া করে সরে দাঁড়ালে নাকে একটু পাউডার ঘষতাম।

স্টিফেন হেনডারসন অবশ্যই সরে দাঁড়াবে, হাসল সে। পিছিয়ে এসে জায়গা ছেড়ে দিল মেয়েটিকে।

হেনডারসনকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি মুখ টিপে হেসে বলল, এর আগে কাউকে পাউডার নিতে দেখেননি?

দেখেছি, তবে প্রসাধনীর প্রতি স্বর্গ-সুন্দরীদের এরকম আসক্তির কথা জানতাম না। অবশ্যি স্বর্গের দেবীদের সম্পর্কে খুব কমই জানি। এখন থেকে বিশেষভাবে জানতে চেষ্টা করব তাদের। এই হচ্ছে মোক্ষম সুযোগ। হয়তো উৎসবের পুরোটা সময়ই আপনার পেছনে নোটবুক হাতে দেখতে পাবেন আমাকে।

ভ্যাম্পায়ারের হাতে নোটবুক!

হ্যাঁ, আমি খুব বুদ্ধিমান ভ্যাম্পায়ার-সেকেলে ট্রানসিলভেনিয়ানদের মত নই। এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি, আমার সঙ্গ ভালো লাগবে আপনার।

হুঁ আমারও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু স্বর্গের দেবীর সাথে রক্তচোষা-জুটিটা কেমন বেমানান হয়ে যাচ্ছে না!

সে আমরা মানিয়ে নেব, ভরসা দিল হেনডারসন। তা ছাড়া আপনার মাঝেও তো অশুভ ছায়া রয়েছে। ধরুন এই কালো আলখেল্লাটা। এটার জন্যেই আপনাকে মনে হচ্ছে ডার্ক-অ্যানজেল। যেন স্বর্গের বদলে আমার জায়গা থেকে এসেছেন।

রসালাপে মজে গেলেও হেনডারসনের মাথায় ঝড়োবেগে অন্য চিন্তা চলছে। অতীতের সেই বিতর্কের দিনগুলোকে স্মরণ করছে সে। গ্রীসের প্রাচীন দর্শনে কী প্রচণ্ড বিশ্বাস না ছিল তার!

একসময় হেনডারসন বন্ধুমহলে ঘোষণা দিয়েছিল, শুধু নাটক-নভেল ছাড়া বাস্তবে প্রথম দর্শনে প্রেম বলে কিছু নেই। সে বলে বেড়াত, নাটক-নভেল থেকে মানুষ প্রেম সম্পর্কে জানতে পারে এবং সেই অনুসারে সবার মনে প্রথম দর্শনে প্রেম নিয়ে একটা বিশ্বাস জন্মে, যখন সম্ভবত কামনাকে অনুভব করা যায়।

এবং এ মুহূর্তে শীলা-এই স্বর্ণকেশী সুন্দরী তার মন থেকে সব অসুস্থ চিন্তা, মদের নেশা, আয়নার ভেতরে বোকার মত উঁকিঝুঁকি একই সঙ্গে ঝেটিয়ে বিদেয় করেছে। তার চোখে এখন রঙিন স্বপ্ন। এক জোড়া লাল ঠোঁট, দ্যুতিময় নীল চোখ এবং পেলব দুটি বাহু উতলা করে তুলেছে তাকে।

হেনডারসনের চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনের খবর পেয়ে গেল মেয়েটা। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে, এখন থেকে আমরা দুজন একে অন্যের কাছে আর আপনি নই। তুমি!

এ তো আমার পরম সৌভাগ্য! তবে আমি চাই আরেকটু কাছে যেতে। স্বর্গের দেবী কি নাচবে আমার সাথে?

চতুর ভ্যাম্পায়ার! চলল, ও ঘরে যাই।

হাতে হাত রেখে পার্লারে ঢুকল ওরা। হাসি-আনন্দে ভরপুর উৎসব। ঘর জুড়ে নেশার তরলের ছড়াছড়ি। তবে নাচের প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না কারও। জোড়া জোড়া নারী-পুরুষ ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে খোশগল্পে মশগুল। উৎসবের রীতি অনুযায়ী ছদ্মবেশধারীরা ঘরের কোণে নানান রঙঢঙে মত্ত। হেনডারসন ঘরে ঢোকা মাত্রই ভারি হয়ে উঠল আনন্দমুখর পরিবেশ।

হেনডারসন যখন ভরা আসরের মাঝখানে গিয়ে আলখেল্লার প্রান্ত ঝটকা মেরে কাঁধে তুলল, অদ্ভুত একটা প্রতিক্রিয়া দেখা গেল সবার মাঝে। ধ্যান-গম্ভীর নীরবতা নেমে এল ঘরে। বড় বড় পা ফেলে এগোতে এগোতে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। হেনডারসনের জাকুটিপূর্ণ চেহারা। শীলাকে দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটাকে বিরাট একটা তামাশা হিসেবে নিয়েছে সে।

ওদের দেখিয়ে দাও, ভ্যাম্পায়ার কাকে বলে! ফিক করে হাসল শীলা। শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরল হেনডারসনের বাহু। উৎসাহে প্রভাবিত হলো হেনডারসন। যুগলদের দিকে শ্যেনদৃষ্টি হানতে হানতে এগিয়ে গেল সে। বিশেষ করে মেয়েদের। বিকট মুখভঙ্গি করে ভয় দেখাল। অতিথিদের ঝটিতি ঘাড় ফেরানো, তাৎক্ষণিক মৃদু আর্তনাদ-এসব বুঝিয়ে দিল হেনডারসনের উদ্দেশ্য কতটা সফল। মূর্তিমান বিভীষিকার মত লম্বা ঘর জুড়ে বিচরণ করছে সে। পেছন থেকে ক্রমাগত ফিসফাস্ আসছে তার কানে।

লোকটা কে?

আমাদের সাথেই এলিভেটরে এসেছে, এবং সে…

তার চোখ দুটো দেখেছ…

সাক্ষাৎ রক্তচোষা!

হ্যালো, ড্রাকুলা! মার্কাস লিণ্ডস্ট্রোম এবং ক্লিওপেট্রার বেশধারী এক গোমড়া মুখো শ্যামলা মেয়ে এগিয়ে এল হেনডারসনের দিকে। দুজনেই বেসামাল। ক্লাবে যখন লিণ্ডস্ট্রোম স্বাভাবিক থাকে, লোকটাকে তখন ভালোই লাগে হেনডারসনের। কিন্তু পার্টি বা উৎসবে লোকটাকে সহ্য করা মুশকিল। যেমন-এ মুহূর্তে তাকে আর যাই হোক দ্ৰ বলা যাবে না।

প্রিয় বন্ধুগণ, ঘোষণা দেয়ার ভঙ্গিতে চেঁচাল লিণ্ডস্ট্রোম। এই হ্যালোইনের রাতে আমার অত্যন্ত প্রিয় এক বন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি আপনাদের সাথে। কাউন্ট ড্রাকুলা এবং তার মেয়েকে দাওয়াত করেছিলাম। তারাই এখন আপনাদের সামনে উপস্থিত। কাউন্টের দাদীকেও আসতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি জেমিমা ফুপুকে নিয়ে আরেকটা পার্টিতে গেছেন। আসুন, কাউন্ট, আমার ছোট্ট খেলার সাথীটির সাথে কথা বলুন।

ওহ, ড্রাকুলা! অবাক হবার ভান করল মেয়েটি। কী বড় বড় চোখ আপনার! কত বড় বড় দাঁত! ও-ওহ

অন্য কোন সময় হলে লিওস্ট্রোমের চোয়ালে ধাই করে একটা ঘুসি মেরে বসত হেনডারসন। কিন্তু এই হাসিখুশি পরিবেশে এতগুলো লোকের সামনে এমন কাজ করাটা মোটেও সমীচিন হবে না। তাছাড়া শীলা আছে পাশে। এরচে উজবুক লোকটার স্থূল রসিকতায় তাল দেয়াই ভালো। হ্যাঁ, সে পিশাচই একটা!

মেয়েটার দিকে ফিরে মুচকি হাসল হেনডারসন। তারপর ঋজুভঙ্গিতে সমবেত অতিথিবৃন্দের দিকে তাকিয়ে কুটি করল সে। হাত দুটো ঘষল আলখেল্লায়। আশ্চর্য, কাপড়টা এখনও ঠাণ্ডা! নিচের দিকে তাকাতেই প্রথমবারের মত তার নজর পড়ল, আলখেল্লার শেষ প্রান্তে ময়লা লেগে আছে। জমাট ধুলো কিংবা কাদা। ভালো করে দেখার জন্যে আলখেল্লার নিচের দিকটা লম্বা একটা হাত দিয়ে দিয়ে। টেনে তুলল সে। কিন্তু বুক পর্যন্ত তোলার পর পিছল ঠাণ্ডা সিল্ক হাত ফস্কে পড়ে গেল। বেশ অনুপ্রাণিত দেখাল তাকে। তার চোখ দুটো আরেকটু বড় এবং জুলজুলে হলো। ফাঁক হয়ে গেল মুখ। অদ্ভুত একটা ইন্দ্রিয়শক্তি ভর করল তার ওপর। মার্কাস লিণ্ডস্ট্রোমের নরম, মোটা গলার দিকে তাকাল সে। সাদা চামড়ায় নীল শিরা ফুটে আছে। ঘর-ভর্তি লোক তাকিয়ে আছে তার দিকে। অনুভূতিটা এবার পুরোপুরি গ্রাস করল তাকে। ভজ ভাঁজ চামড়ার গলার ওপর চোখ দুটো স্থির হলো। একজন মোটা মানুষের তুলতুলে গলা!

হেনডারসনের হাত দুটো বেরিয়ে এসেছে। লিস্ট্রোম ভীত ইঁদুরের মত চি চি করে উঠল। তেল চচ্চকে নাদুসনুদুস হঁদুরের মত লাগছে লোকটাকে। রক্তে ঠাসা শরীর। পিশাচেরা রক্ত পছন্দ করে। কিচমিচ্ করা ধাড়ি ইঁদুরের গলার শিরা থেকে বের হওয়া রক্ত!

উষ্ণ রক্ত! মনের প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দিল হেনডারসন। কণ্ঠের গভীর থেকে বেরোল কথাটা।

হাত দুটো ইতিমধ্যে লিস্ট্রোমের গলায় গিয়ে পৌচেছে। কী উষ্ণ গলা! পাগলের মত শিরা খুঁজে বের করল সে। মুখটা এগিয়ে যাচ্ছে গলার দিকে। নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করল লিস্ট্রোম। কিন্তু হেনডারসনের বজ্রমুঠি আরও চেপে বসল গলায়। লালচে হয়ে গেল লিস্ট্রোমের চেহারা। রক্ত সব উঠে আসছে। মাথায়। এই তো চাই। রক্ত!

মুখটা আরও বড় হলো হেনডারসনের। শিরশির করে উঠল দাঁত। মোটা গলাটা স্পর্শ করল মুখ। তারপর

থামো! যথেষ্ট হয়েছে! শীতল কণ্ঠ শীলার। হেনডারসনের হাত ধরে টানছে সে। মাথা তুলে তাকাল হেনডারসন। নিজের কাণ্ড দেখে নিজেই হতবাক। লিণ্ডস্ট্রোমকে ছেড়ে দিল সে। হাঁ করে হাঁপাচ্ছে বেচারা। বিস্ময়ে গোল হয়ে গেছে দর্শকদের মুখ।

হেনডারসনের কানের কাছে ফিসফিস করল শীলা, এটা কী করলে! ভয়ে তো বেচারা আধমরা!

নিজের মাঝে ফিরে আসার চেষ্টা করল হেনডারসন। সবার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে হাসল। বলল, ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়গণ, আমাদের উৎসবের আয়োজক আমার সম্পর্কে যা বলেছেন, তার ছোট্ট একটা প্রমাণ দেখালাম আপনাদের। আমি সত্যিই একটা রক্তচোষা। তবে আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন, দ্বিতীয়বার আর এমন দৃশ্য দেখতে হবে না। এখানে যদি কোন ডাক্তার থাকেন, তা হলে অবশ্যি রক্ত বদলের একটা আয়োজন করতে পারি।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সবাই। গোল মুখগুলোতে হাসির হুল্লোড় উঠল। বেশিরভাগই হাসল হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মত। হেনডারসন তৃপ্ত। কিন্তু মার্কাস লিওস্ট্রোমের মুখে হাসি নেই। সে ভয়-বিহ্বল চোখে হেনডারসনের দিকে তাকিয়ে। হেনডারসন ভালো করেই জানে, তার ভয়টা কীসের।

জটলা ভেঙে যে যার মত ছড়িয়ে পড়ল আবার। এলিভেটর থেকে এক তাড়া খবরের কাগজ নিয়ে বেরিয়ে এল একজন। রঙ মেখে চেহারাটা ঢেকে ফেলেছে সে। মাথায় ক্যাপ আর গায়ে অ্যাপ্রোন চাপিয়ে নিউজ-বয় সেজেছে। পত্রিকা হাতে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এল সে, গরম খবর! তাজা খবর! পড়ুন সবাই। হ্যালোইনের বড় চমক! বাড়তি আকর্ষণ!

কলহাস্যরত অতিথিরা কিনতে লাগল পত্রিকা। এক মহিলা এগিয়ে এল শীলার দিকে। শীলাকে যেতে বলল তার সাথে। বিমূঢ় একটা ভাব নিয়ে তার সাথে এগোল শীলা। হেনডারসনকে শুধু বলল, যাই, আবার দেখা হবে।

শীলার অবজ্ঞা গায়ে জ্বালা ধরাল হেনডারসনের। মেয়েটা মনে মনে খেপে গেছে তার ওপর। কিন্তু সে নিজেই তো বুঝতে পারছে না, লিস্ট্রোমকে ওভাবে চেপে ধরেছিল কেন! উঃ, কী ভয়ানক সেই অনুভূতি! কেন এমন হয়েছিল?

নকল নিউজবয় সামনে দিয়ে যাবার সময় অনেকটা অজান্তেই একটা পত্রিকা কিনে ফেলল হেনডারসন। দেখাই যাক, হ্যালোইনের বড় চমকটা কী?

প্রথম পৃষ্ঠায় আঁতিপাতি করে খুঁজেও কোন চমক আবিষ্কার করতে পারল না হেনডারসন। পাতা উল্টে শেষ পৃষ্ঠায় চলে এল সে। পাওয়া গেল কাক্ষিত শিরোনাম। শুধু চমকই নয়, খবরটা হেনডারসনের জন্যে একটা রোমহর্ষক ব্যাপার। পড়তে পড়তে আতঙ্কের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছুল সে।

… আজ এক কসটিউম-শপে আগুন লাগে… আটটার পরপরই দমকলবাহিনী সেখানে পৌঁছে… আগুন আয়ত্তের বাইরে চলে যায়… সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত… ক্ষতির পরিমাণ… ভীষণ অদ্ভুত, মালিকের পরিচয় জানা যায়নি… কঙ্কালটা পাওয়া গেছে–

না! সশব্দে ফুঁপিয়ে উঠল হেনডারসন।

খবরটা আরেকবার পড়ল সে। আবার কঙ্কালটা পাওয়া গেছে দোকানের নিচে, সেলারে, একটা মাটির বাক্সে। আর বাক্সটা একটা কফিন। আরও দুটো বাক্স ছিল সেখানে। দুটোই খালি। কঙ্কালটা একটা আলখেল্লায় মোড়ানো ছিল। আগুন কোন ক্ষতি করতে পারেনি ওটার।

খবরের শেষে একটা বক্স এঁকে তাতে মোটা কালো কালো অক্ষরের শিরোনামসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের মন্তব্য ছাপা হয়েছে। পড়শীরা বড় ভয় পেত জায়গাটাকে। তাদের ধারণা হাঙ্গেরীর ওদিকে দোকানের মালিকের বাড়ি। অজানা অচেনা সব লোক আসত দোকানটায় ডাকিনী-বিদ্যার চর্চা, প্রেত-পূজা-এসব নাকি চলত ওখানে। প্রণয়োদ্দীপক পানীয়, জাদু-টোনার তাবিজ, রহস্যময় ভূতুড়ে পোশাক-কুসংস্কারমূলক বিভিন্ন জিনিসই ছিল দোকানটার পণ্য।

ভূতুড়ে পোশাক-পিশাচ-আলখেল্লা-একে একে সবই ধরা পড়ল হেনডারসনের চোখে। মনে পড়ে গেল বুড়োর সেই কথাগুলো একটা আলখেল্লা। একেবারে আসল!

তা ছাড়া বুড়ো আলখেল্লাটা ফেরতও নিতে চায়নি। বলেছে-দরকার নেই। এখন থেকে ওটা আপনার।

কথাগুলো ঘাই মারল হেনডারসনের মগজে। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। সেই প্যানেল মিররের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুহূর্ত মাত্র স্থির রইল সে। তারপরই আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে একটা হাত উঠে গেল চোখের সামনে। প্রতিবিম্ব পড়েনি আয়নায়। সহসাই ঝাঁ করে মনে পড়ে গেল, ভ্যাম্পায়ারদের কোন প্রতিফলন ঘটে না।

কোন সন্দেহ নেই কিছু একটা ভর করেছে তার ওপর। এই অশুভ শক্তি তাকে কোমল হাত আর মাংসল গলার দিকে টানছে। এজন্যেই লিস্ট্রোমকে জাপটে ধরেছিল সে। হায় ঈশ্বর!

ছাতলা পড়া এই কুচকুচে কালো আলখেল্লাটাই যত নষ্টের গোড়া। কোন সাধারণ মাটি নয়, কবরখানার মাটি লেগে আছে এটার সাথে। হিমশীতল এই পোশাকটাই তার মাঝে একটা খাঁটি রক্তচোষাকে জাগিয়ে তুলেছে। এখন ভাবতেই কেমন ঝিঁঝিম্ করছে মাথা-একসময় সত্যিকারের এক পিশাচের সম্পত্তি ছিল অভিশপ্ত পোশাকটা! এটার আস্তিনে যেমরচে-রঙা দাগ দেখা যাচ্ছে, নির্ঘাত শুকনো রক্ত।

রক্ত! দেখতে কী সুন্দর এই জিনিস! রক্তের উষ্ণতায় আছে প্রাণ, আছে প্রবহমান জীবন।

দূর, উন্মত্ত মাতালের মত কী যা তা ভাবছে সে!

ও, আমার ভ্যাম্পায়ার বন্ধুটি তাহলে এখানে! শীলা কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টেরই পায়নি হেনডারসন। বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয় তার। শীলার উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকাতেই সে টের পায়, মেয়েটির টুকটুকে ঠোঁট তাকে নীরব আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। উষ্ণ একটা ঢেউ অনুভব করে হেনডারসন। ঝলমলে কালো পোশাক ভেদ করে উঁচু হয়ে থাকা শীলার ধবধবে গলার দিকে তাকায় সে। আরেকটা উষ্ণতা জেগে ওঠে তার মাঝে। এই উষ্ণতায় রয়েছে ভালোবাসা, কামনা এবং একটি ক্ষুধা।

হেনডারসনের চোখের ভাষা বুঝে নেয় শীলা। তার চোখেও যে ওই আগুন। সেও ভালোবেসে ফেলেছে সামনে দাঁড়ানো পুরুষটিকে।

আবেগের তাড়নায় চট করে আলখেল্লাটা খুলে ফেলে হেনডারসন। বরফ শীতল ভার নেমে যায় গা থেকে। সে এখন অভিশপ্ত পোশাকটার নাগপাশ থেকে মুক্ত। শীলাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার তীব্র একটা ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু জড়তা এসে বাধা দেয়।

কী, ক্লান্ত হয়ে পড়েছ? শুধোয় শীলা। একই শিহরণ তাকেও দোলা দিচ্ছে। সেও খুলে ফেলে তার আলখেল্লা-অশুভ আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসে সত্যিকারের দেবী। অ্যানজেলের পোশাকে দারুণ লাগছে শীলাকে। সোনালি চুল এবং গর্বিত ভঙ্গিমার মাঝে ফুটে উঠেছে তার পূর্ণাঙ্গ নারীসত্তা। অজান্তেই প্রশংসা-ধ্বনি বেরোয় হেনডারসনের কণ্ঠ থেকে। সে ফিসফিস করে বলে, আমার স্বর্গ-সুন্দরী!

শীলাও সাড়া দেয়, আমার শয়তান!

পরমুহূর্তে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয় দুজন। শীলার আলখেল্লাটা চলে আসে হেনডারসনের হাতে। দুরন্ত আবেগে একাকার হয়ে যায় দুজোড়া ঠোঁট।

লিণ্ডস্ট্রোম এবং তার কজন সঙ্গীর আকস্মিক আগমন দুজনের দুর্বার ভালোবাসায় ছেদ ঘটাল। গল্প করতে করতে ঢুকে পড়েছে তারা।

হেনডারসনকে দেখেই কুঁকড়ে গেল লিণ্ডস্ট্রোম। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল, তু-তুমি এখনও আছ!

ভয় নেই, হাসল হেনডারসন। এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।

শীলাকে জড়িয়ে ধরে খালি এলিভেটরের দিকে এগোল হেনডারসন। তরাস খাওয়া লিণ্ডস্ট্রোমের ছাই-বরণ মুখের ওপর দড়াম করে বন্ধ হলো দরজা।

আমরা কি চলে যাচ্ছি? হেনডারসনের কাঁধে মাথা রেখে জানতে চাইল শীলা।

হ্যাঁ, যাচ্ছি। তবে মাটির ধরায় নয়। নিচে আমার জগতে না গিয়ে যাচ্ছি। ওপরে-তোমার ভুবনে।

ছাদের বাগানে?

হ্যাঁ গো, আমার স্বপ্নের রানী। স্বর্গের বাগানে বসে গল্প করব আমরা। মেঘের চুড়োয় বসে চুমু খাব তোমাকে। তারপর

শীলার ঠোঁট দুটো কথা শেষ করতে দিল না হেনডারসনকে। এলিভেটর উঠতে লাগল আপন গতিতে।

একসময় বিচ্ছিন্ন হলো দুজন। হেনডারসন বলল, দেবীর সাথে শয়তান। এ কেমন জুটি!

আমিও তাই বলেছি, মনে করিয়ে দিল শীলা। আমাদের সন্তানেরা স্বর্গীয় মহিমা, না শয়তানের শিঙ নিয়ে জন্মাবে?

দুটোই থাকবে ওদের সাথে। দেখে নিয়ো।

খোলা নির্জন ছাদে বেরিয়ে এল দুজন। হেনডারসন আবারও অনুভব করল, আজ হ্যালোইনের রাত। নিচে লিণ্ডস্ট্রোম এবং তার সোসাইটি-বন্ধুরা আমোদ-ফুর্তি আর মদ্য পানে মগ্ন। আর এখানে আলো নেই, শব্দ নেই, পানাহার নেই। নিস্তব্ধ বিষণ্ণ একটি রাত। অন্যান্য রাতের মতই সাধারণ। তবু এ রাতের আলাদা একটা মর্ম আছে।

আকাশটা এ মুহূর্তে নীল নয়, কালো। কমলা চাঁদের চারদিকে ঘুরে বেড়ানো ধূসর মেঘগুলোকে দৈত্যের থোকা থোকা দাড়ির মত লাগছে। সাগরের ওদিক থেকে আসা ঠাণ্ডা বাতাসে মৃদু গুঞ্জন।

শীতও পড়েছে বটে!

আমার কাপড়টা দাও, মৃদুকণ্ঠে বলল শীলা।

পোশাকটা ফিরিয়ে দিল হেনডারসন। পাক খেয়ে ঝলমলে কালো কাপড়টার ভেতর ঢুকে পড়ল শীলা। তার ঠোঁট দুটো আবারও তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠল। হেনডারসন। উপেক্ষা করতে পারল না। জোড়া লেগে গেল দুজোড়া ঠোঁট।

শীতে মৃদু কাঁপছে হেনডারসন। শীলা দেখে বলল, আলখেল্লাটা পরে নাও।

হেনডারসনও আলখেল্লা গায়ে দেয়ার কথা ভাবছে। এটা পরে মেয়েটার দিকে তাকালে কামনা জেগে উঠবে তার। তারপর তৃষ্ণা। প্রথমে সে চুমু খাবে শীলাকে, তারপর ধীরে ধীরে পৌঁছুবে তার মসৃণ গলায়। ভালোবাসায় ভাসতে ভাসতে সানন্দে গলাটা এগিয়ে দেবে শীলা। তারপর

এটা পরো, ডার্লিং-কথা শোনো। শীলার অধৈর্য চোখে তীব্র একটা আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে।

উত্তেজনায় কেঁপে উঠল হেনডারসন। সত্যিই সে আঁধারের প্রতীক আলখেল্লাটা পরবে? কবরের গন্ধমাখা মৃত্যুর পোশাক গায়ে দিয়ে সাজবে রক্তচোষা?

দেখি, একটু ঘোয়রা তো।

শীলার শীর্ণ হাত দুটো আলখেল্লাটা কাঁধে চাপাল হেনডারসনের। মেয়েটা গভীর মমতায় হাত বোলাল তার গলায়। তারপর আটকে দিল আলখেল্লার বোতাম।

হেনডারসন টের পেল, বরফ-শীতল সেই পরশটা ক্রমেই ভয়ানক রকম উষ্ণতার দিকে যাচ্ছে। নিজেকে আগের চেয়ে আরও বেশি অনুভব করতে পারছে সে। চেহারার পরিবর্তন স্পষ্ট বুঝতে পারছে। এর নাম শক্তি। একটা অশুভ শক্তি!

সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির চোখে চাপা কৌতুক, প্রচ্ছন্ন আমন্ত্রণ। তার হাতির দাঁতের মত সাদা সরু গলাটার দিকে তাকাল হেনডারসন। একটু পরেই ওখানে পৌঁছুবে তার ঠোঁট। তারপর

না-এটা হতে পারে না। মেয়েটাকে সে ভালোবাসে। তার ভালোবাসা অবশ্যই এই পাগলামোকে জয় করবে। হ্যাঁ, এই পোশাক পরেই, এটার শক্তিকে হটিয়ে দিয়ে, শীলাকে বুকে টানবে সে। শয়তানের মত নয়, একজন মানুষের মত নিজের প্রেমিকাকে গ্রহণ করবে। এটা তার জন্যে একটা পরীক্ষা।

তোমাকে একটা ঘটনা বলব, শীলা।

চোখ বড় বড় করে শুনতে উন্মুখ হলো মেয়েটা।

আজ রাতের পত্রিকাটা পড়েছ?

হ্যাঁ।

আমি-আমি ওই দোকান থেকে এই আলখেল্লাটা কিনেছি। অদ্ভুত একটা আসুরিক শক্তি আছে এটার। তোমাকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। লিণ্ডস্ট্রোমকে কেমন ঠেসে ধরেছিলাম, তুমি তো দেখেছই। ওটা আসলে কিন্তু অভিনয় ছিল না। আমি সত্যিই দাঁত ফুটিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম ওর গলায়। এই পোশাকটা আমার ভেতর সত্যিকারের পিশাচের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি, শীলা।

আমি জানি। চাঁদের আলোতে চিকচিক করছে মেয়েটার চোখ।

আমি একটা পরীক্ষা করতে চাই। এই পোশাকে চুমু খাব তোমাকে। আমি প্রমাণ করতে চাই, ওই জিনিসের চেয়ে আমার ভালোবাসার শক্তি বেশি। যদি দুর্বল হয়ে পড়ি, ব্যর্থ হই, কথা দাও-দ্রুত পালিয়ে যাবে তুমি। আমাকে ভুল বুঝো না, লক্ষ্মীটি! ওই অশুভ শক্তির সাথে প্রাণপণ লড়ব আমি। আমার ভালোবাসা তোমার জন্যে নিখাদ এবং নিরাপদ হোক-এটাই তো আমি চাই। কী, ভয় পেলে?

না। শীলা এখনও তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। সে যেমন তাকিয়ে আছে মেয়েটার গলার দিকে। বেচারী যদি তার মনের খবর জানত!

তুমি আবার ভেবে বোসো না, মাথাটা আমার বিগড়ে গেছে, বোঝাবার ভঙ্গিতে বলল হেনডারসন। ওই দোকানে-এক বিরক্তিকর বেঁটে বুড়ো এই আলখেল্লাটা আমাকে দিয়ে বলল, এটা নাকি সত্যিকারের ভ্যাম্পায়ারের পোশাক। ভেবেছিলাম বুড়ো তামাশা করেছে। কিন্তু এই পোশাকে আয়নার সামনে দাঁড়ালে কোন প্রতিবিম্ব পড়ে না এবং এটার প্রভাবেই লিস্ট্রোমের গলার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। এমনকী তোমার প্রতিও। কাজেই আমাকে পরীক্ষাটা করতেই হবে।

শীলা তৈরি। চেহারায় চাপা কৌতুক। হেনডারসন তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকল। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল বিপরীত দুই অনুভূতির। কমলা চাঁদের ভৌতিক আলোতে মুহূর্তকাল মাত্র স্থির দেখা গেল তাকে। পরক্ষণে তার চোখে মুখে ফুটে উঠল কঠোর চেষ্টার চিহ্ন।

এবং মেয়েটা তাকে প্রলুব্ধ করল। তার লাল টুকটুকে ঠোঁটের ফাঁকে ঝিলিক দিল সাদা দাঁত। কালো আলখেল্লার ভেতর থেকে ফর্সা দুটি হাত এসে আস্তে করে পেঁচিয়ে ধরল হেনডারসনের গলা। মেয়েটা এবার মুখপিটে হেসে আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে বলে উঠল, আমি আগে থেকেই জানি, আমারটার মত তোমার আলখেল্লাটাও আসল। তুমি যেখান থেকে এনেছ, আমারটাও একই জায়গার। আয়নায় শুধু তোমার না, আমারও কোন প্রতিবিম্ব পড়ে না। বোকা, খেয়াল করোনি।

প্রচণ্ড বিস্ময়ে বরফের মত জমে গেল হেনডারসন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজোড়া চতুর ঠোঁট তার গলা স্পর্শ করল। কুট করে বিধে গেল সুতীক্ষ দাঁত। প্রথমে সূক্ষ্ম একটা বেদনা, তারপর আশ্চর্য সুখকর অনুভূতি। একটা সর্বগ্রাসী অন্ধকার ক্রমশ গিলে খেতে লাগল হেনডারসনকে।

 

 

Exit mobile version