বাড়িটি ধূসর রঙ করা। জানালায় হলুদ রঙ। ছাদটা ঢালু। পুরো বাড়িটিতে কেমন ভীতিকর একটা ব্যাপার আছে। নিতুর পেটের ভেতরটা শিরশির করছে। আবারও মনে হলো ভুল করে ফেলেছে ও। এখানে আসা উচিত হয়নি।
নিতুর দিকের দরজা খুলে গেল। মিসেস বারলফ দাঁড়িয়ে আছেন পাশে, চেহারায় অধৈর্য ভাব।
নেমে এসো, বললেন তিনি। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার স্বামী রাগ করবেন।
মহিলার কণ্ঠে কর্তৃত্বের সুর স্পষ্ট। আমি নামতে চাই না, কথাটা বলার সাহস হলো না নিতুর। দরজা খুলে নেমে পড়ল ও। মহিলার পেছনে পেছনে এগোল সদর দরজার দিকে। ভারী সেগুন কাঠের দরজা। বড়, কালো একটা চাবি বের করলেন তিনি, তালায় ঢুকিয়ে মোচর দিলেন। ক্লিক শব্দে খুলে গেল তালা।
একটা সরু হলঘরে ঢুকল নিতু। দেয়ালের কুলুঙ্গিতে মিটমিট করে জ্বলছে মোম। কালো, আর লাল ব্রোকেড পেপারে মোড়া দেয়ালে ভৌতিক ছায়া ফেলেছে। মাথায় উপর একটা ঝাড়বাতি জ্বেলে দিলেন মিসেস বারলফ। নিতুর শুকনো চেহারা লক্ষ করলেন।
তোমাকে কেমন চিন্তিত দেখাচ্ছে, হাসলেন তিনি। এখানে ভয়ের কিছু নেই। নিকোলাসের ঘর দোতলায়। রান্নাঘরটা বাড়ির পিছন দিকে। লাইব্রেরি আছে। সময় কাটাতে বই পড়তে পারো। তুমি বসো। আমি নিকোলাসকে একটু দেখে আসি।
মহিলা দোতলায় উঠে গেলেন। একটু পরে নেমে এলেন। নিকোলাস ঘুমাচ্ছে। জানালেন তিনি। আমার ফিরতে যদি দেরি হয়ে যায় ওকে কিন্তু খেতে দিতে ভুল কোরো না। আর হ্যাঁ, একটা কথা ভুলেও কিন্তু ওর ঘরের জানালার পর্দা খুলবে না।
তড়িঘড়ি চলে গেলেন মিসেস বারলফ, নিতুকে গুড় বাই বলারও সুযোগ দিলেন না। মোটর স্টার্ট নেয়ার শব্দ শুনল নিতু। গর্জন তুলে চলে গেল কালো গাড়ি। নিতু হঠাৎ উপলব্ধি করল এই অদ্ভুত বাড়িতে সে একা। সামনের দরজায় দ্রুত গেল ও। লাগিয়ে দিল ছিটকিনি।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল নিতু। বাচ্চার ঘরে যাবে। সিঁড়ি বেয়ে উঠছে, ধুকপুক শুরু হয়ে গেল বুকে। সামনের হলঘরটা ছায়াময়, অন্ধকার। পুরো বাড়িটাকেই ওর হরর সিনেমার ভৌতিক বাড়ির মত মনে হচ্ছে।
হলঘরের শেষ মাথায় চলে এল নিতু। একটা দরজা দেখতে পেল। ভেজানো। ধাক্কা মেরে খুলে ফেলল। উঁকি দিল।
লাল ডিম বাতি জ্বলছে ঘরে। লম্বা, কাঠের একটা দোলনা দেখতে পেল নিতু। নিঃশব্দে ওদিকে হেঁটে গেল ও। ঝুঁকল। ভারি সুন্দর একটি বাচ্চা শুয়ে আছে। দোলনায়। মুখখানা নিতুর দিকে ফেরানো। একমাথা ঘন কালো চুল। নিতুর আগমনে টের পেয়েই কিনা কে জানে, চোখ মেলে চাইল নিকোলাস। ঝাড়া এক মিনিট তাকিয়ে রইল ওর দিকে। সম্মোহিতের মত বাচ্চাটার দিকে চেয়ে রইল নিতু। চোখ বুজল নিকোলাস। ঘুমিয়ে পড়ল আবার। মিষ্টি, নিষ্পাপ মুখে স্মিত হাসি। মিসেস বারলফের শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটি নিতুর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিলেও বাচ্চাটাকে তার খুবই ভালো লেগেছে।
লাইব্রেরি ঘরটা কোন দিকে দেখিয়ে দিয়েছেন মিসেস বারলফ। ওই ঘরে ঢুকল নিতু। ঘরটা কালো কাঠের প্যানেলিং দিয়ে তৈরি। বড় বড় পিঠ উঁচু চেয়ার আর একজোড়া কালো চামড়ার কাউচ চোখে পড়ল নিতুর। চেয়ারের পাশে একটা বাতি। বাতি জ্বালিয়ে চেয়ারে বসল নিতু। বাতির আলোয় ঘরের অন্ধকার দূর হলো সামান্যই। তবে বই পড়া যাবে।
লাইব্রেরি ঘরে কয়েকটা কালো কাঠের আলমারি। তাতে প্রায় সবই ঢাউস সাইজের ইংরেজি বই। বাতির আলোয় দুএকটা বইয়ের নাম পড়তে পারল নিতু। ব্ল্যাক ম্যাজিক আর উইচক্রাফটের উপর লেখা। সঙ্গে একটা হরর বই তো আছেই। তাই ওদিকে আর নজর দিল না নীতু। নিজের আনা ভৌতিক গল্প সংকলনে মনোনিবেশ করল।
কড়-কড়-কড়াৎ! শব্দে বাজ পড়ল কোথাও। বুকের রক্ত ছলকে উঠল নিতুর। পরমুহূর্তে বিদ্যুতের আলো ঝলসে দিল ঘর। চেয়ার ছেড়ে উঠল ও। হেঁটে গেল লাল পর্দা ফেলা জানালার ধারে। ভারী পর্দা টেনে সরাল। মাঠের ধারের জঙ্গলে বাহু ছড়িয়ে নাচছে গাছের ডাল। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে আরও। হঠাৎ কারও সঙ্গে কথা বলার খুব ইচ্ছে জাগল নিতুর-বাবা, মা, বন্ধু, কিংবা অন্য কেউ। লাইব্রেরি ঘরে টেলিফোন খুঁজল নিতু। নেই। হলঘরেও পেল না।
অকস্মাৎ আতংক ভর করল নিতুর মনে। কুডাক ডাকছে মন। এক ছুটে বসার ঘরে ঢুকল। অন্ধকার। দেয়াল হাতড়াল বাতির সুইচের জন্য। হঠাৎ কীসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেল ও। নরম কী একটা ছুটে পালিয়ে গেল। চিৎকার করে উঠল নিতু। দৌড়ে চলে এল লাইব্রেরি ঘরে। লাল চেয়ারটাতে বসে পড়ল। পা মুড়ে নিল। হাত দিয়ে ঢাকল মুখ। তারপর ফোঁপাতে শুরু করল।
.
তীব্র কান্নার আওয়াজে জেগে গৈল নিতু। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। ভীত চোখে চাইল চারপাশে। এক মুহূর্তের জন্য বুঝতে পারল না কোথায় আছে। তারপর মনে পড়ে গেল সব। দোতলা থেকে ভেসে আসছে টা টা চিৎকার। লাইব্রেরি ঘরের গ্রাণ্ডফাদার কুক গম্ভীর ঢং ঢং সুরে জানান দিল বারোটা বাজে। এখন মাঝ রাত। খিদে পেয়েছে নিকোলাসের।
নিতুর অবাক লাগল ভেবে ঠিক বারোটার সময়ই কি খিদে পেয়ে যায় বাচ্চার? আর এভাবে তারস্বরে কাঁদতে থাকে? মিসেস বারলফ তো বললেন বারোটার আগেই ফিরবেন। কই এলেন না তো এখনও!
বাচ্চার কান্না তীব্রতর হলো। কানে বাড়ি খাচ্ছে দ্রিম দ্রিম। লাফ মেরে উঠে পড়ল নিতু, এক ছুটে চলে এল রান্নাঘরে। বাচ্চার কান্না প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সারা বাড়িতে।