মধ্যরাতের খাবার
ক্রি রি রিং। টেলিফোনের শব্দে চমকে উঠল নিতু। একা বাড়িতে ও। একটা ভূতের গল্প পড়ছিল। বাবা মা সিনেমা দেখতে গেছেন। রাত বারোটার আগে ফিরবেন না। ফোন বেজেই চলেছে। ধরছে না নিতু। জানে বাবা মার ফোন নয়। প্রয়োজন হলে নিতুর মোবাইলে তার ফোন করতেন। আজেবাজে কারও ফোন নয়তো? ইদানীং একটা ছেলে খুব জ্বালাচ্ছে পঞ্চদশী নিতুকে। যখন তখন মোবাইলে ফোন করে বলে বেশিরভাগ সময় সেল ফোন বন্ধ রাখে নিতু। তারপক্ষে নিতুদের বাড়ির নাম্বার জোগাড় করা কঠিন কিছু নয়। ধরবে না ধরবে না করেও রিসিভার তুলে নিল ও। ঝুন ঝুন শব্দটা চাপ সৃষ্টি করছে নার্ভে।
হ্যালো?
এক মহিলা কণ্ঠ। চিনতে পারল না নিতু। খুব দ্রুত কথা বলছেন। বললেন এ মুহূর্তে তার একজন বেবী-সিটার খুব দরকার। খুব জরূরী প্রয়োজনে এখুনি বাইরে যেতে হচ্ছে তাকে। নিতু যদি ঘণ্টা তিনেকের জন্য তার সাত মাসের বাচ্চাটাকে একটু দেখে রাখে খুবই কৃতজ্ঞবোধ করবেন তিনি।
জবাব দিতে ইতস্তত করল নিতু। স্কুলে গরমের ছুটিতে এবারই প্রথম ও বাইরে যায়নি। সময় কাটাতে প্রতিবেশী এক আন্টির ডে কেয়ার সেন্টারে বেবী সিটিং করছে। সন্দেহ নেই মহিলা ওখান থেকে জোগাড় করেছে নিতুর নাম্বার। কিন্তু সে তো দিনের বেলা কয়েক ঘণ্টার জন্য বেবী সিটিং করে। এখন বাজে রাত সাড়ে আটটা। এত রাতে যাওয়া কি ঠিক হবে?
নিতুর কণ্ঠে দ্বিধা লক্ষ করে মহিলা চট করে এমন একটা পারিশ্রমিকের প্রস্তাব দিলেন, যে কেয়ার সেন্টারের প্রায় আধা মাসের বেতনের সমান। এবার আর দ্বিধা করল না নিতু। তাছাড়া রাতে কখনও বেবী সিটিং করেনি ও। এর মধ্যে একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধও আছে। মহিলা নিতু রাজি হয়েছে জেনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন পনেরো মিনিটের মধ্যে নিতুদের বাসায় আসছেন ওকে তুলে নিতে। বাড়ির ঠিকানা তার জানাই আছে। ডে কেয়ার সেন্টারে নিতুর ফোন নাম্বারের সঙ্গে বাড়ির ঠিকানাও লেখা ছিল।
বাবাকে ফোন করল নিতু। মোবাইল অফ। মনে পড়ল সিনেমা হল-এ ছবি চলাকালীন মোবাইল বন্ধ রাখতে হয়। বাবা মা মেট্রো সিনেমা হল-এ হরর ছবি ভ্যান হেলসিং দেখতে গেছেন। ছবিটি নাকি রমরমা চলছে। সিনেমা দেখতে ভাল লাগে না নিতুর। সে কার্টুন ছবি দেখে আর বই পড়ে। বইয়ের মধ্যে নিজের একটা জগৎ সৃষ্টি করে নিয়েছে নিতু। বেবী সিটারের কাজটাও উপভোগ করে সে। নাদুসনুদুস গুটু গুটু বাচ্চাগুলোর সঙ্গে খেলা করে ভালোই কেটে যায় সময়।
কাঁটায় কাঁটায় পোনে নটায় নিতুদের বাড়িতে হাজির হয়ে গেলেন মহিলা। নিজের পরিচয় দিলেন মিসেস বারলফ বলে। কৈনসিংটন স্ট্রীটে থাকেন। হড়বড় করে বললেন হঠাৎ একটি জরুরী বিজনেস ডিনারে যেতে হচ্ছে তাকে। তার স্বামী আগেই চলে গেছেন ওখানে। ফোন করে মিসেস বারলফকে এখুনি যেতে বলেছেন। না গেলেই নয়। এতটুকু বাচ্চাকে ডিনারে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাই উপায় না দেখে নিতুকে ফোন করেছেন। নিতুর নাম শুনেছেন মিসেস ক্রিস্টির কাছে। নিতুর মনে পড়ল একটি সুপার মার্কেটে কর্মরত মিসেস ক্রিস্টি তার দুবছরের মেয়েটিকে সকালবেলা নিতুদের ডে কেয়ার সেন্টারে দিয়ে যান। কাজ শেষে নিয়ে যান।
কালো একটা গাড়িতে চড়ে এসেছেন মিসেস বারলফ। গাড়ি চলতে শুরু করার পর নিতুর মনে পড়ল মহিলার তড়বড়ানির চোটে সে মহিলার ফোন নাম্বার কিংবা বাড়ির ঠিকানা কোনও কিছুই বাসায় রেখে আসেনি। এমনকী তাড়াহুড়োয় মোবাইল ফোনটাও আনা হয়নি। মিসেস বারলফ আশ্বস্ত করলেন তাকে। বললের নিতুর বাবা মা বাসায় ফেরার আগেই তাকে নিজে বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। ডিনার শেষ হওয়া মাত্র নিজের বাসায় চলে আসবেন মিসেস বারলফ।
অ্যাডভেঞ্চারের লোভে বেবী সিটিংয়ের প্রস্তাবে তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হয়ে গেলেও এখন কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে নিতুর। বারবার মনে হচ্ছে কাজটা বোধহয় ঠিক করেনিও।
বৃষ্টি পড়ছে। শীতল হাওয়া আসছে খোলা জানালা দিয়ে। ঘুম ঘুম ভাব এসে গেল নিতুর। চটকা ভেঙে গেল মহিলার খসখসে কণ্ঠস্বরে।
আমার বাচ্চাটাকে তোমার ভালোই লাগবে, বললেন মিসেস বারলফ। মাত্র সাত মাস বয়স ওর। কিন্তু এখনই মাথায় ক্ষুরধার বুদ্ধি।
কী নাম ওর? জিজ্ঞেস করল নিতু। আপনার বাচ্চা কি জেগে আছে এখনও।?
না। না। নিকোলাস ঘুমিয়ে পড়েছে আরও ঘণ্টাখানেক আগে। হাসলেন মিসেস বারলফ। মহিলার ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। ভ্যাম্পায়ারের মত লাগছে।
নিতু জানল মহিলার বাচ্চা রাত বারোটায় ঘুম থেকে জেগে ওঠে। তখন তাকে দুধ খাওয়াতে হয়।
আপনার ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বাজবে নাকি? শঙ্কিত হলো নিতু।
আমি বারোটার আগেই ফিরে আসার চেষ্টা করব।, বললেন মিসেস বারলফ। পার্টির ব্যাপার। বোঝোই তো। তবে ভয় নেই। আমি নিজে পৌঁছে দিয়ে আসব তোমাকে বাসায়।
অন্ধকার রাত। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় নোক চলাচল নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি স্যাঁৎ করে ওদের গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে মুখে হেডলাইটের জোরালো আলো ফেলে।
কনসিংটন স্ট্রীটে ঢুকল কালো গাড়ি। মহিলা ভালোই ড্রাইভ করেন। মেইন রোড ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে বামে মোড় নিলেন তিনি। ঢুকে পড়লেন লম্বা, আঁকাবাকা একটা গলিতে। নিতু জায়গাটা চেনার চেষ্টা করল। ইলেকট্রিসিটি নেই। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না কিছু। হঠাৎ আরেকটা মোড় ঘুরলেন মিসেস বারলফ। প্রকাণ্ড, পুরানো একটা বাড়ির সামনে ব্রেক কষলেন। প্রকৃতি ফর্সা করে ঝিলিক দিল বিদ্যুৎ। সোনালি আলোতে বাড়িটির পেছনে একটা মাঠ দেখতে পেল নিতু। তার পরে জঙ্গল। জঙ্গল! নিউইয়র্ক শহরে জঙ্গল!! এ কোথায় এসেছে নিতু। ওর গা ছমছম করে উঠল। আশপাশে কোথাও বাতি না জ্বললেও দোতলা বিশাল বাড়িটিতে আলো দেখতে পেল। নিশ্চয় জেনারেটর চলছে। বাড়ির সামনে পুরানো আমলের দুটো গ্যাস ল্যাম্প জ্বলছে। মাটিতে অদ্ভুত ছায়া ফেলছে।