দুটোই থাকবে ওদের সাথে। দেখে নিয়ো।
খোলা নির্জন ছাদে বেরিয়ে এল দুজন। হেনডারসন আবারও অনুভব করল, আজ হ্যালোইনের রাত। নিচে লিণ্ডস্ট্রোম এবং তার সোসাইটি-বন্ধুরা আমোদ-ফুর্তি আর মদ্য পানে মগ্ন। আর এখানে আলো নেই, শব্দ নেই, পানাহার নেই। নিস্তব্ধ বিষণ্ণ একটি রাত। অন্যান্য রাতের মতই সাধারণ। তবু এ রাতের আলাদা একটা মর্ম আছে।
আকাশটা এ মুহূর্তে নীল নয়, কালো। কমলা চাঁদের চারদিকে ঘুরে বেড়ানো ধূসর মেঘগুলোকে দৈত্যের থোকা থোকা দাড়ির মত লাগছে। সাগরের ওদিক থেকে আসা ঠাণ্ডা বাতাসে মৃদু গুঞ্জন।
শীতও পড়েছে বটে!
আমার কাপড়টা দাও, মৃদুকণ্ঠে বলল শীলা।
পোশাকটা ফিরিয়ে দিল হেনডারসন। পাক খেয়ে ঝলমলে কালো কাপড়টার ভেতর ঢুকে পড়ল শীলা। তার ঠোঁট দুটো আবারও তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠল। হেনডারসন। উপেক্ষা করতে পারল না। জোড়া লেগে গেল দুজোড়া ঠোঁট।
শীতে মৃদু কাঁপছে হেনডারসন। শীলা দেখে বলল, আলখেল্লাটা পরে নাও।
হেনডারসনও আলখেল্লা গায়ে দেয়ার কথা ভাবছে। এটা পরে মেয়েটার দিকে তাকালে কামনা জেগে উঠবে তার। তারপর তৃষ্ণা। প্রথমে সে চুমু খাবে শীলাকে, তারপর ধীরে ধীরে পৌঁছুবে তার মসৃণ গলায়। ভালোবাসায় ভাসতে ভাসতে সানন্দে গলাটা এগিয়ে দেবে শীলা। তারপর
এটা পরো, ডার্লিং-কথা শোনো। শীলার অধৈর্য চোখে তীব্র একটা আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে।
উত্তেজনায় কেঁপে উঠল হেনডারসন। সত্যিই সে আঁধারের প্রতীক আলখেল্লাটা পরবে? কবরের গন্ধমাখা মৃত্যুর পোশাক গায়ে দিয়ে সাজবে রক্তচোষা?
দেখি, একটু ঘোয়রা তো।
শীলার শীর্ণ হাত দুটো আলখেল্লাটা কাঁধে চাপাল হেনডারসনের। মেয়েটা গভীর মমতায় হাত বোলাল তার গলায়। তারপর আটকে দিল আলখেল্লার বোতাম।
হেনডারসন টের পেল, বরফ-শীতল সেই পরশটা ক্রমেই ভয়ানক রকম উষ্ণতার দিকে যাচ্ছে। নিজেকে আগের চেয়ে আরও বেশি অনুভব করতে পারছে সে। চেহারার পরিবর্তন স্পষ্ট বুঝতে পারছে। এর নাম শক্তি। একটা অশুভ শক্তি!
সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির চোখে চাপা কৌতুক, প্রচ্ছন্ন আমন্ত্রণ। তার হাতির দাঁতের মত সাদা সরু গলাটার দিকে তাকাল হেনডারসন। একটু পরেই ওখানে পৌঁছুবে তার ঠোঁট। তারপর
না-এটা হতে পারে না। মেয়েটাকে সে ভালোবাসে। তার ভালোবাসা অবশ্যই এই পাগলামোকে জয় করবে। হ্যাঁ, এই পোশাক পরেই, এটার শক্তিকে হটিয়ে দিয়ে, শীলাকে বুকে টানবে সে। শয়তানের মত নয়, একজন মানুষের মত নিজের প্রেমিকাকে গ্রহণ করবে। এটা তার জন্যে একটা পরীক্ষা।
তোমাকে একটা ঘটনা বলব, শীলা।
চোখ বড় বড় করে শুনতে উন্মুখ হলো মেয়েটা।
আজ রাতের পত্রিকাটা পড়েছ?
হ্যাঁ।
আমি-আমি ওই দোকান থেকে এই আলখেল্লাটা কিনেছি। অদ্ভুত একটা আসুরিক শক্তি আছে এটার। তোমাকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। লিণ্ডস্ট্রোমকে কেমন ঠেসে ধরেছিলাম, তুমি তো দেখেছই। ওটা আসলে কিন্তু অভিনয় ছিল না। আমি সত্যিই দাঁত ফুটিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম ওর গলায়। এই পোশাকটা আমার ভেতর সত্যিকারের পিশাচের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি, শীলা।
আমি জানি। চাঁদের আলোতে চিকচিক করছে মেয়েটার চোখ।
আমি একটা পরীক্ষা করতে চাই। এই পোশাকে চুমু খাব তোমাকে। আমি প্রমাণ করতে চাই, ওই জিনিসের চেয়ে আমার ভালোবাসার শক্তি বেশি। যদি দুর্বল হয়ে পড়ি, ব্যর্থ হই, কথা দাও-দ্রুত পালিয়ে যাবে তুমি। আমাকে ভুল বুঝো না, লক্ষ্মীটি! ওই অশুভ শক্তির সাথে প্রাণপণ লড়ব আমি। আমার ভালোবাসা তোমার জন্যে নিখাদ এবং নিরাপদ হোক-এটাই তো আমি চাই। কী, ভয় পেলে?
না। শীলা এখনও তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। সে যেমন তাকিয়ে আছে মেয়েটার গলার দিকে। বেচারী যদি তার মনের খবর জানত!
তুমি আবার ভেবে বোসো না, মাথাটা আমার বিগড়ে গেছে, বোঝাবার ভঙ্গিতে বলল হেনডারসন। ওই দোকানে-এক বিরক্তিকর বেঁটে বুড়ো এই আলখেল্লাটা আমাকে দিয়ে বলল, এটা নাকি সত্যিকারের ভ্যাম্পায়ারের পোশাক। ভেবেছিলাম বুড়ো তামাশা করেছে। কিন্তু এই পোশাকে আয়নার সামনে দাঁড়ালে কোন প্রতিবিম্ব পড়ে না এবং এটার প্রভাবেই লিস্ট্রোমের গলার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। এমনকী তোমার প্রতিও। কাজেই আমাকে পরীক্ষাটা করতেই হবে।
শীলা তৈরি। চেহারায় চাপা কৌতুক। হেনডারসন তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকল। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল বিপরীত দুই অনুভূতির। কমলা চাঁদের ভৌতিক আলোতে মুহূর্তকাল মাত্র স্থির দেখা গেল তাকে। পরক্ষণে তার চোখে মুখে ফুটে উঠল কঠোর চেষ্টার চিহ্ন।
এবং মেয়েটা তাকে প্রলুব্ধ করল। তার লাল টুকটুকে ঠোঁটের ফাঁকে ঝিলিক দিল সাদা দাঁত। কালো আলখেল্লার ভেতর থেকে ফর্সা দুটি হাত এসে আস্তে করে পেঁচিয়ে ধরল হেনডারসনের গলা। মেয়েটা এবার মুখপিটে হেসে আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে বলে উঠল, আমি আগে থেকেই জানি, আমারটার মত তোমার আলখেল্লাটাও আসল। তুমি যেখান থেকে এনেছ, আমারটাও একই জায়গার। আয়নায় শুধু তোমার না, আমারও কোন প্রতিবিম্ব পড়ে না। বোকা, খেয়াল করোনি।
প্রচণ্ড বিস্ময়ে বরফের মত জমে গেল হেনডারসন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজোড়া চতুর ঠোঁট তার গলা স্পর্শ করল। কুট করে বিধে গেল সুতীক্ষ দাঁত। প্রথমে সূক্ষ্ম একটা বেদনা, তারপর আশ্চর্য সুখকর অনুভূতি। একটা সর্বগ্রাসী অন্ধকার ক্রমশ গিলে খেতে লাগল হেনডারসনকে।