… আজ এক কসটিউম-শপে আগুন লাগে… আটটার পরপরই দমকলবাহিনী সেখানে পৌঁছে… আগুন আয়ত্তের বাইরে চলে যায়… সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত… ক্ষতির পরিমাণ… ভীষণ অদ্ভুত, মালিকের পরিচয় জানা যায়নি… কঙ্কালটা পাওয়া গেছে–
না! সশব্দে ফুঁপিয়ে উঠল হেনডারসন।
খবরটা আরেকবার পড়ল সে। আবার কঙ্কালটা পাওয়া গেছে দোকানের নিচে, সেলারে, একটা মাটির বাক্সে। আর বাক্সটা একটা কফিন। আরও দুটো বাক্স ছিল সেখানে। দুটোই খালি। কঙ্কালটা একটা আলখেল্লায় মোড়ানো ছিল। আগুন কোন ক্ষতি করতে পারেনি ওটার।
খবরের শেষে একটা বক্স এঁকে তাতে মোটা কালো কালো অক্ষরের শিরোনামসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের মন্তব্য ছাপা হয়েছে। পড়শীরা বড় ভয় পেত জায়গাটাকে। তাদের ধারণা হাঙ্গেরীর ওদিকে দোকানের মালিকের বাড়ি। অজানা অচেনা সব লোক আসত দোকানটায় ডাকিনী-বিদ্যার চর্চা, প্রেত-পূজা-এসব নাকি চলত ওখানে। প্রণয়োদ্দীপক পানীয়, জাদু-টোনার তাবিজ, রহস্যময় ভূতুড়ে পোশাক-কুসংস্কারমূলক বিভিন্ন জিনিসই ছিল দোকানটার পণ্য।
ভূতুড়ে পোশাক-পিশাচ-আলখেল্লা-একে একে সবই ধরা পড়ল হেনডারসনের চোখে। মনে পড়ে গেল বুড়োর সেই কথাগুলো একটা আলখেল্লা। একেবারে আসল!
তা ছাড়া বুড়ো আলখেল্লাটা ফেরতও নিতে চায়নি। বলেছে-দরকার নেই। এখন থেকে ওটা আপনার।
কথাগুলো ঘাই মারল হেনডারসনের মগজে। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। সেই প্যানেল মিররের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুহূর্ত মাত্র স্থির রইল সে। তারপরই আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে একটা হাত উঠে গেল চোখের সামনে। প্রতিবিম্ব পড়েনি আয়নায়। সহসাই ঝাঁ করে মনে পড়ে গেল, ভ্যাম্পায়ারদের কোন প্রতিফলন ঘটে না।
কোন সন্দেহ নেই কিছু একটা ভর করেছে তার ওপর। এই অশুভ শক্তি তাকে কোমল হাত আর মাংসল গলার দিকে টানছে। এজন্যেই লিস্ট্রোমকে জাপটে ধরেছিল সে। হায় ঈশ্বর!
ছাতলা পড়া এই কুচকুচে কালো আলখেল্লাটাই যত নষ্টের গোড়া। কোন সাধারণ মাটি নয়, কবরখানার মাটি লেগে আছে এটার সাথে। হিমশীতল এই পোশাকটাই তার মাঝে একটা খাঁটি রক্তচোষাকে জাগিয়ে তুলেছে। এখন ভাবতেই কেমন ঝিঁঝিম্ করছে মাথা-একসময় সত্যিকারের এক পিশাচের সম্পত্তি ছিল অভিশপ্ত পোশাকটা! এটার আস্তিনে যেমরচে-রঙা দাগ দেখা যাচ্ছে, নির্ঘাত শুকনো রক্ত।
রক্ত! দেখতে কী সুন্দর এই জিনিস! রক্তের উষ্ণতায় আছে প্রাণ, আছে প্রবহমান জীবন।
দূর, উন্মত্ত মাতালের মত কী যা তা ভাবছে সে!
ও, আমার ভ্যাম্পায়ার বন্ধুটি তাহলে এখানে! শীলা কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টেরই পায়নি হেনডারসন। বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয় তার। শীলার উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকাতেই সে টের পায়, মেয়েটির টুকটুকে ঠোঁট তাকে নীরব আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। উষ্ণ একটা ঢেউ অনুভব করে হেনডারসন। ঝলমলে কালো পোশাক ভেদ করে উঁচু হয়ে থাকা শীলার ধবধবে গলার দিকে তাকায় সে। আরেকটা উষ্ণতা জেগে ওঠে তার মাঝে। এই উষ্ণতায় রয়েছে ভালোবাসা, কামনা এবং একটি ক্ষুধা।
হেনডারসনের চোখের ভাষা বুঝে নেয় শীলা। তার চোখেও যে ওই আগুন। সেও ভালোবেসে ফেলেছে সামনে দাঁড়ানো পুরুষটিকে।
আবেগের তাড়নায় চট করে আলখেল্লাটা খুলে ফেলে হেনডারসন। বরফ শীতল ভার নেমে যায় গা থেকে। সে এখন অভিশপ্ত পোশাকটার নাগপাশ থেকে মুক্ত। শীলাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার তীব্র একটা ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু জড়তা এসে বাধা দেয়।
কী, ক্লান্ত হয়ে পড়েছ? শুধোয় শীলা। একই শিহরণ তাকেও দোলা দিচ্ছে। সেও খুলে ফেলে তার আলখেল্লা-অশুভ আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসে সত্যিকারের দেবী। অ্যানজেলের পোশাকে দারুণ লাগছে শীলাকে। সোনালি চুল এবং গর্বিত ভঙ্গিমার মাঝে ফুটে উঠেছে তার পূর্ণাঙ্গ নারীসত্তা। অজান্তেই প্রশংসা-ধ্বনি বেরোয় হেনডারসনের কণ্ঠ থেকে। সে ফিসফিস করে বলে, আমার স্বর্গ-সুন্দরী!
শীলাও সাড়া দেয়, আমার শয়তান!
পরমুহূর্তে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয় দুজন। শীলার আলখেল্লাটা চলে আসে হেনডারসনের হাতে। দুরন্ত আবেগে একাকার হয়ে যায় দুজোড়া ঠোঁট।
লিণ্ডস্ট্রোম এবং তার কজন সঙ্গীর আকস্মিক আগমন দুজনের দুর্বার ভালোবাসায় ছেদ ঘটাল। গল্প করতে করতে ঢুকে পড়েছে তারা।
হেনডারসনকে দেখেই কুঁকড়ে গেল লিণ্ডস্ট্রোম। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল, তু-তুমি এখনও আছ!
ভয় নেই, হাসল হেনডারসন। এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।
শীলাকে জড়িয়ে ধরে খালি এলিভেটরের দিকে এগোল হেনডারসন। তরাস খাওয়া লিণ্ডস্ট্রোমের ছাই-বরণ মুখের ওপর দড়াম করে বন্ধ হলো দরজা।
আমরা কি চলে যাচ্ছি? হেনডারসনের কাঁধে মাথা রেখে জানতে চাইল শীলা।
হ্যাঁ, যাচ্ছি। তবে মাটির ধরায় নয়। নিচে আমার জগতে না গিয়ে যাচ্ছি। ওপরে-তোমার ভুবনে।
ছাদের বাগানে?
হ্যাঁ গো, আমার স্বপ্নের রানী। স্বর্গের বাগানে বসে গল্প করব আমরা। মেঘের চুড়োয় বসে চুমু খাব তোমাকে। তারপর
শীলার ঠোঁট দুটো কথা শেষ করতে দিল না হেনডারসনকে। এলিভেটর উঠতে লাগল আপন গতিতে।
একসময় বিচ্ছিন্ন হলো দুজন। হেনডারসন বলল, দেবীর সাথে শয়তান। এ কেমন জুটি!
আমিও তাই বলেছি, মনে করিয়ে দিল শীলা। আমাদের সন্তানেরা স্বর্গীয় মহিমা, না শয়তানের শিঙ নিয়ে জন্মাবে?