হলঘরের লম্বা প্যানেল মিররের দিকে এগোল হেনডারসন। একটু উঁকিঝুঁকি মেরে সোজা হয়ে দাঁড়াল চৌকোনা আয়নার সামনে। পেছন থেকে আসা উজ্জ্বল আলোয় আয়নার কাঁচের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল সে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না।
আয়নার সামনে সে জলজ্যান্ত বিদ্যমান, অথচ প্রতিবিম্ব পড়েনি! এটা কী করে সম্ভব?
চোখ দুটো ডলে নিয়ে আবার তাকাল সে। ফল একই। প্রতিবিম্ব নেই।
চাপা গলায় হেসে উঠল হেনডারসন। তার কণ্ঠের গভীর থেকে বেরোল এই খলখলে হাসি। ফাঁকা আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রমেই উঁচুতে চড়ল হাসি। হাসিতে কুটিল আনন্দ।
ভালো নেশা ধরেছে, অফুটে বলল হেনডারসন। একটু আগে তবু ঝাপসা প্রতিবিম্ব দেখেছি, আর এখন তো দেখতেই পাচ্ছি না। নেশার জন্যেই চেহারাটা ভীষণ হয়েছে। ভয় পাচ্ছে সবাই।
প্লিজ, একটু সরে দাঁড়াবেন!
একটা সুরেলা কণ্ঠে চমক ভাঙে হেনডারসনের। ঝট করে পেছনে ফেরে সে। তার মতই কালো পোশাক মেয়েটির। ফর্সা গর্বিত মুখ। মাথায় ঝিকমিকি করছে রেশমের মত চুলগুলো। নীল চোখে অপার্থিব দ্যুতি। ঠোঁট জোড়া টুকটুকে লাল। স্বর্গের দেবী সেজেছে মেয়েটি।
হেনডারসন নরম কণ্ঠে শুধোল, কে আপনি?
শীলা ডারলি। দয়া করে সরে দাঁড়ালে নাকে একটু পাউডার ঘষতাম।
স্টিফেন হেনডারসন অবশ্যই সরে দাঁড়াবে, হাসল সে। পিছিয়ে এসে জায়গা ছেড়ে দিল মেয়েটিকে।
হেনডারসনকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি মুখ টিপে হেসে বলল, এর আগে কাউকে পাউডার নিতে দেখেননি?
দেখেছি, তবে প্রসাধনীর প্রতি স্বর্গ-সুন্দরীদের এরকম আসক্তির কথা জানতাম না। অবশ্যি স্বর্গের দেবীদের সম্পর্কে খুব কমই জানি। এখন থেকে বিশেষভাবে জানতে চেষ্টা করব তাদের। এই হচ্ছে মোক্ষম সুযোগ। হয়তো উৎসবের পুরোটা সময়ই আপনার পেছনে নোটবুক হাতে দেখতে পাবেন আমাকে।
ভ্যাম্পায়ারের হাতে নোটবুক!
হ্যাঁ, আমি খুব বুদ্ধিমান ভ্যাম্পায়ার-সেকেলে ট্রানসিলভেনিয়ানদের মত নই। এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি, আমার সঙ্গ ভালো লাগবে আপনার।
হুঁ আমারও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু স্বর্গের দেবীর সাথে রক্তচোষা-জুটিটা কেমন বেমানান হয়ে যাচ্ছে না!
সে আমরা মানিয়ে নেব, ভরসা দিল হেনডারসন। তা ছাড়া আপনার মাঝেও তো অশুভ ছায়া রয়েছে। ধরুন এই কালো আলখেল্লাটা। এটার জন্যেই আপনাকে মনে হচ্ছে ডার্ক-অ্যানজেল। যেন স্বর্গের বদলে আমার জায়গা থেকে এসেছেন।
রসালাপে মজে গেলেও হেনডারসনের মাথায় ঝড়োবেগে অন্য চিন্তা চলছে। অতীতের সেই বিতর্কের দিনগুলোকে স্মরণ করছে সে। গ্রীসের প্রাচীন দর্শনে কী প্রচণ্ড বিশ্বাস না ছিল তার!
একসময় হেনডারসন বন্ধুমহলে ঘোষণা দিয়েছিল, শুধু নাটক-নভেল ছাড়া বাস্তবে প্রথম দর্শনে প্রেম বলে কিছু নেই। সে বলে বেড়াত, নাটক-নভেল থেকে মানুষ প্রেম সম্পর্কে জানতে পারে এবং সেই অনুসারে সবার মনে প্রথম দর্শনে প্রেম নিয়ে একটা বিশ্বাস জন্মে, যখন সম্ভবত কামনাকে অনুভব করা যায়।
এবং এ মুহূর্তে শীলা-এই স্বর্ণকেশী সুন্দরী তার মন থেকে সব অসুস্থ চিন্তা, মদের নেশা, আয়নার ভেতরে বোকার মত উঁকিঝুঁকি একই সঙ্গে ঝেটিয়ে বিদেয় করেছে। তার চোখে এখন রঙিন স্বপ্ন। এক জোড়া লাল ঠোঁট, দ্যুতিময় নীল চোখ এবং পেলব দুটি বাহু উতলা করে তুলেছে তাকে।
হেনডারসনের চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনের খবর পেয়ে গেল মেয়েটা। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে, এখন থেকে আমরা দুজন একে অন্যের কাছে আর আপনি নই। তুমি!
এ তো আমার পরম সৌভাগ্য! তবে আমি চাই আরেকটু কাছে যেতে। স্বর্গের দেবী কি নাচবে আমার সাথে?
চতুর ভ্যাম্পায়ার! চলল, ও ঘরে যাই।
হাতে হাত রেখে পার্লারে ঢুকল ওরা। হাসি-আনন্দে ভরপুর উৎসব। ঘর জুড়ে নেশার তরলের ছড়াছড়ি। তবে নাচের প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না কারও। জোড়া জোড়া নারী-পুরুষ ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে খোশগল্পে মশগুল। উৎসবের রীতি অনুযায়ী ছদ্মবেশধারীরা ঘরের কোণে নানান রঙঢঙে মত্ত। হেনডারসন ঘরে ঢোকা মাত্রই ভারি হয়ে উঠল আনন্দমুখর পরিবেশ।
হেনডারসন যখন ভরা আসরের মাঝখানে গিয়ে আলখেল্লার প্রান্ত ঝটকা মেরে কাঁধে তুলল, অদ্ভুত একটা প্রতিক্রিয়া দেখা গেল সবার মাঝে। ধ্যান-গম্ভীর নীরবতা নেমে এল ঘরে। বড় বড় পা ফেলে এগোতে এগোতে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। হেনডারসনের জাকুটিপূর্ণ চেহারা। শীলাকে দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটাকে বিরাট একটা তামাশা হিসেবে নিয়েছে সে।
ওদের দেখিয়ে দাও, ভ্যাম্পায়ার কাকে বলে! ফিক করে হাসল শীলা। শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরল হেনডারসনের বাহু। উৎসাহে প্রভাবিত হলো হেনডারসন। যুগলদের দিকে শ্যেনদৃষ্টি হানতে হানতে এগিয়ে গেল সে। বিশেষ করে মেয়েদের। বিকট মুখভঙ্গি করে ভয় দেখাল। অতিথিদের ঝটিতি ঘাড় ফেরানো, তাৎক্ষণিক মৃদু আর্তনাদ-এসব বুঝিয়ে দিল হেনডারসনের উদ্দেশ্য কতটা সফল। মূর্তিমান বিভীষিকার মত লম্বা ঘর জুড়ে বিচরণ করছে সে। পেছন থেকে ক্রমাগত ফিসফাস্ আসছে তার কানে।
লোকটা কে?
আমাদের সাথেই এলিভেটরে এসেছে, এবং সে…
তার চোখ দুটো দেখেছ…
সাক্ষাৎ রক্তচোষা!
হ্যালো, ড্রাকুলা! মার্কাস লিণ্ডস্ট্রোম এবং ক্লিওপেট্রার বেশধারী এক গোমড়া মুখো শ্যামলা মেয়ে এগিয়ে এল হেনডারসনের দিকে। দুজনেই বেসামাল। ক্লাবে যখন লিণ্ডস্ট্রোম স্বাভাবিক থাকে, লোকটাকে তখন ভালোই লাগে হেনডারসনের। কিন্তু পার্টি বা উৎসবে লোকটাকে সহ্য করা মুশকিল। যেমন-এ মুহূর্তে তাকে আর যাই হোক দ্ৰ বলা যাবে না।