.
অপেক্ষায় থেকে হাঁপিয়ে উঠল হেনডারসন। পেছনের ঘর থেকে আলো নিয়ে আসছে না কেউ। মিনিট কয়েক পর ধৈর্য হারিয়ে ফেলল সে। কাউন্টারে সজোরে হাত চাপড়ে চেঁচাল, কে আছ! এদিকে এসো!
প্রথমে নীরবতা, তারপর অস্পষ্ট একটা নড়াচড়ার শব্দ শোনা গেল পেছনে। কী বিচ্ছিরি! একটু পরেই নিচের সিঁড়িতে পৌঁছুল শব্দটা। থপ্ থপ্ থপ্ করে ভারি পা ফেলে উঠে আসছে কেউ। সহসাই হাঁ করে শ্বাস টানল হেনডারসন। কালোমত কী একটা বেরিয়ে আসছে মেঝে খুঁড়ে!
আসলে ওটা বেসমেন্টের ট্র্যাপডোর। এইমাত্র খুলল। ল্যাম্প হাতে এক লোক বেরিয়ে এসে কাউন্টারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। ল্যাম্পের আলোয় হলদেটে দেখাচ্ছে মুখ। ঘুম জড়ানো চোখে পাতা পড়ছে ঘন ঘন।
লোকটা মৃদু হেসে নরম কণ্ঠে বলল, দুঃখিত, একটু ঘুমোচ্ছিলাম। তা আপনার জন্যে কী করতে পারি, স্যার?
হ্যালোইনের কসটিউম খুঁজছি আমি।
ও, আচ্ছা। তা কী ধরনের কসটিউম চাই আপনার?
কণ্ঠস্বরটা ক্লান্ত, খুবই ক্লান্ত। হলুদ চেহারায় নিস্তেজ একটা ভাব। চোখ দুটোতে ঘুমের রেশ কাটেনি এখনও।
প্রচলিত সাইজের বাইরে একটা ছদ্মবেশ নিতে চাই আমি। মানে উৎসবে গিয়ে সবাইকে একটু ভড়কে দিতে চাই আর কী।
কিছু মুখোশ দেখাতে পারি আপনাকে।
আরে না, নেকড়ে মানব সাজার কোন শখ নেই আমার। আমি চাই এমন একটা পোশাক, যা দেখে লোকে ছদ্মবেশটাকেই আসল রূপ মনে করে ভয় পাবে।
তা হলে সত্যিকারের পোশাক চাইছেন আপনি!
হ্যাঁ। হেনডারসনের মনে ক্ষীণ একটা সন্দেহ উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল। সত্যিকারের পোশাক বলতে কী বোঝাতে চাইছে মাথামোটা লোকটা?
সেরকম একটা পোশাক বোধহয় দিতে পারব, সার। চোখ পিট পিট করে বলল সে। তার ঠোঁট জোড়ার ভাঁজে হাসির রেখা। জিনিসটা শুধু হ্যালোইনের জন্যেই।
কী রকম?
রক্তচোষা পিশাচের কথা ভেবেছেন কখনও?
ড্রাকুলার মত?
জ্বী, জ্বী ড্রাকুলা।
আইডিয়াটা মন্দ নয়। কিন্তু আমাকে ওই পোশাকে মানাবে তো?
আঁটো হাসি ফুটল লোকটার মুখে। হেনডারসনের আপাদমস্তক জরিপ করে বলল, খুব মানাবে।
বেঢপ প্রশংসা! বিদ্রুপের ভঙ্গিতে হাসল হেনডারসন। তা কোথায় সেই সাজ-পোশাক?
সাজ-পোশাক? এটা তো শুধুই একটা পোশাক। তাও রাতের।
রাতের?
জ্বী, এজন্যেই তো দিচ্ছি।
কী সেটা?
একটা আলখেল্লা। একেবারে আসল!
একটা আলখেল্লা-ব্যস, এই?
জ্বী, সার। শুধুই একটা আলখেল্লা। কিন্তু ওটা পরলে মনে হবে শবের কাফন। দাঁড়ান, নিয়ে আসছি।
নড়বড়ে পা দুটো টেনে টেনে আবার দোকানের পেছনে চলে গেল লোকটা। ট্র্যাপোর খুলে নেমে গেল নিচে। হেনডারসন দাঁড়িয়ে রইল অপেক্ষায়। নিচে আগের চেয়ে আরও বেশি খুটখাট দুমদাম্ হচ্ছে।
শিগগিরই ফিরে এল বুড়ো। হাতে একটি আলখেল্লা। অন্ধকারে ঝাঁকুনি দিয়ে আলখেল্লা থেকে ধুলো ঝাড়ল সে। তারপর বলল, এই নিন-আসল জিনিস।
আসল?
গায়ে দিলেই টের পাবেন। আশ্চর্য একটা ক্ষমতা আছে এটার-বিশ্বাস করুন!
ঠাণ্ডা, ভারি কাপড়টা কাঁধে চাপল হেনডারসনের। পেছনে এসে আয়নায় নিজেকে দেখার সময় ছত্রাকের পুরানো একটা অস্বস্তিকর গন্ধ পেল সে। আলখেল্লা থেকে আসছে। মৃদু আলো, তবু নিজের চেহারার অদ্ভুত পরিবর্তন নজর এড়াল না হেনডারসনের। তার লম্বাটে মুখটা আরও সরু দেখাচ্ছে, ফ্যাকাসে চেহারার মাঝে জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো। সমস্তই এই কালো পোশাকের জাদু। একটা বড়সড় কালো কাফন এটা।
নিখুঁত ছদ্মবেশ! বিড়বিড় করে বলল বুড়ো। আয়নায় কোন প্রতিবিম্ব পড়েনি বুডোর। নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকায় ব্যাপারটা টের পেল না হেনডারসন।
এটা নেব আমি, বলল হেনডারসন। বলল, কত দেব?
আমি নিশ্চিত, এই পোশাকে উৎসবে গেলে দারুণ মজা পাবেন।
আরে, দেব কত তাই বলল।
তা ডলার পাঁচেক দিলেই চলবে।
এই নাও।
ডলার পাঁচটা নিয়ে আলখেল্লাটা হেনডারসনের গা থেকে খুলে নিল বুড়ো। পোশাকটা কাঁধ থেকে নেমে যেতেই আবার স্বাভাবিক উষ্ণতা অনুভব করল হেনডারসন। দীর্ঘদিন বেসমেন্টের শীতল গহ্বরে ছিল বলেই হয়তো কাপড়টা অমন বরফের মত ঠাণ্ডা-ভাবল সে।
পোশাকটা ভাঁজ করে সহাস্যে হেনডারসনকে বুঝিয়ে দিল বুড়ো।
কালকেই এটা ফিরিয়ে দেব, প্রতিশ্রুতি দিল হেনডারসন।
দরকার নেই। এখন থেকে ওটা আপনার।
মানে?
খুব শিগগিরই ব্যবসা গোটাচ্ছি আমি। কাজেই পোশাকটা রেখে দিলে আমার চেয়ে আপনিই বেশি কাজে লাগাতে পারবেন।
কিন্তু–
কোন কিন্তু নয়, হেনডারসনকে থামিয়ে দিল বুড়ো। বিদায় জানাবার ভঙ্গিতে বলল, সন্ধেটা আপনার জন্যে আনন্দময় হয়ে উঠুক।
মনে একরাশ জড়তা নিয়ে রওনা হলো হেনডারসন। দরজা পর্যন্ত গিয়ে বুড়োকে বিদায় জানাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল সে। বুড়োর চোখের পাতা ধীরে লয়ে খুলছে, বন্ধ হচ্ছে। কাউন্টারের ওপাশ থেকে আরেক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে হেনডারসনের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সে দৃষ্টির আঁচ অনুভব করল না হেনডারসন। সে বুড়োকে শুভরাত্রি জানিয়ে দরজাটা ঝট করে ভিজিয়ে দিয়ে রাস্তায় নামল। যেতে যেতে অবাক হয়ে ভাবল, এ কোন্ পাগলামো করতে যাচ্ছে সে!
.
রাত আটটায় হেনডারসন টেলিফোনে লিণ্ডস্ট্রোমকে জানাল, পৌঁছুতে একটু দেরি হবে তার। আলখেল্লাটা গায়ে চাপাতেই আবার সেই ঠাণ্ডা ভাবটা চলে এল। নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার জন্যে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। তার দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে এল বার বার। আবছা একটা কায়া ছাড়া কিছু দেখতে পেল না আয়নায়। অল্প একটু ড্রিংক করার পর খানিকটা চাঙা বোধ করল হেনডারসন। গরম হয়ে উঠল গা। ড্রিংকস ছাড়া আর কিছু মুখে দিল না সে। ফ্লোর জুড়ে রক্তচোষা পিশাচের মহড়া দিয়ে বেড়াল কিছুক্ষণ। বাদুড়ে রূপান্তরিত হবার ভঙ্গিতে বার বার আলখেল্লার নিচের দিকটা ঝটকা মেরে কাঁধে তুলল ভ্রুকুটিপূর্ণ ভয়াল মূর্তিতে। এই ভয়ঙ্কর খেলায় প্রচুর আনন্দ পেল হেনডারসন। সত্যিই তাহলে একটা পিশাচ হতে যাচ্ছে সে!