(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
রক্তলাল রঙ ছড়িয়ে পাহাড়ের ওপারে ডুব দিচ্ছে সূর্য। ধারাল বাতাসের তাড়া খেয়ে ঝরে পড়া শুকনো পাতাগুলো পশ্চিমে এমনভাবে ধেয়ে যাচ্ছে, যেন সূর্যের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে যাচ্ছে ওগুলো।
নিজেকে জড়বুদ্ধির লোক বলে তিরস্কার করল হেনডারসন। থমকে দাঁড়িয়ে মগ্ন হলো ভাবনায়। আঁধার নামতে আর বেশি দেরি নেই। সস্তা কল্পনায় গা ভাসিয়ে কী লাভ?
মাথামোটা? আবার বলল হেনডারসন।
চিন্তাটা সম্ভবত দিনের বেলায়ই তার মাথায় আসে, এবং তখন থেকেই সে আনমনা। হ্যালোইনের ভয়াল রাত আজ। পৃথিবীর সব গোরস্থানে জেগে উঠবে মৃতেরা। আত্মাগুলো বেরিয়ে আসবে কবর ছেড়ে।
অন্যান্য দিনের মতই আরেকটা ঠাণ্ডা, পচা দিন আজ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল হেনডারসন। এমন একটা সময় ছিল, আপনমনে ভাবল সে, যখন এ রাত আসা মানেই ছিল ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার। অশুভ আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠত গোটা অন্ধকার ইউরোপ। অজানা ত্রুর হাসির উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত হত এই সন্ধে। অশুভ দর্শনার্থীদের ভয়ে রুদ্ধ হত একটার পর একটা দরজা, একান্ত প্রার্থনায় বিভোর হত অগণিত মানুষ, ঘরে ঘরে জ্বলে উঠত লক্ষ লক্ষ মোম। চিন্তাভাবনায় জাকাল একটা ব্যাপার ছিল তখন, গভীরভাবে উপলব্ধি করল হেনডারসন। রোমাঞ্চে পরিপূর্ণ ছিল সেই জীবন। মধ্যরাতের পথচারীরা সিটিয়ে থাকত আতঙ্কে, না জানি কী আছে সামনের বাঁকটায়। ভূত-পিশাচ আর অপদেবতার জগতে বাস করে আত্মাকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করত তারা। সে সময় বিশেষ একটা তাৎপর্য ছিল মানুষের আত্মার। এখন দিন বদলেছে। নাস্তিক্য এসে দূরে ঠেলে দিয়েছে আগের সেই ধারনাকে। মানুষ আগের মত আর শ্রদ্ধা করে না তার আত্মাকে। তবু এই বিংশ শতাব্দীতেও ছাড়া ছাড়া কিছু ঠুনকো বিশ্বাস আঁকড়ে আছে মানুষ, যেগুলো তাদের কল্পনার ডানা মেলতে গিয়ে বার বার হোঁচট খায়।
বেকুব! সম্পূর্ণ অজান্তেই আবার বলে উঠল হেনডারসন। আসলে তার মানব সত্তাকে হটিয়ে দিয়ে ভিন্ন একটা সত্তা ঠাঁই নিয়েছে মাথায়। পাছে প্রেতলোকের ওই জীবগুলো তার গোপন পরিকল্পনার কথা জেনে ফেলে, এই ভয়ে বার বার নিজেকে ভর্ৎসনা করছে সে। ওদের রক্তচক্ষু ফাঁকি দেয়ার একটা প্রাণপণ চেষ্টা আর কী।
রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কসটিউমের একটা দোকান খুঁজছে হেনডারসন। জমকালো একটা পোশাক চাই তার। আজ রাতের ছদ্মবেশ-উৎসবে পরতে হবে। দেরি হলে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্যে হ্যালোইন নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করতে রাজি নয় সে।
সরু গলির দুপাশে সার বেঁধে দাঁড়ানো দালানগুলোতে তীক্ষ্মদৃষ্টিতে অনুসন্ধান করছে হেনডারসন। আঁধার ক্রমশ ছায়া ফেলছে দালানগুলোর গায়ে। ফোন-বুকে টানা হাতে লেখা ঠিকানাটার দিকে আবার তাকাল সে। কিন্তু আলোর স্বল্পতায় পড়তে পারল না। বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকাল হেনডারসন। সন্ধে নামা সত্ত্বেও হতচ্ছাড়ার দল দোকানগুলোতে আলো দিচ্ছে না কেন? এই দরিদ্র ঘিঞ্জি এলাকায় খোঁজাখুঁজি করতে আসাটাই একটা ঝক্কির ব্যাপার, কিন্তু তবু
হঠাৎ করেই সেই দোকানটা পেয়ে গেল হেনডারসন। রাস্তার ঠিক ওপারেই। রাস্তা পেরিয়ে দোকানের জানালায় গিয়ে দাঁড়াল সে। উঁকি দিল ভেতরে। অস্তগামী সূর্যের শেষ আলো এসে দালানের কপালে তির্যকভাবে পড়ে সড়াৎ করে নেমে এসেছে জানালা আর ডিসপ্লেতে। চেপে রাখা ধারাল শ্বাসটুকু টেনে নিল হেনডারসন।
একটা কসটিউমের দোকানের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে সে-নরকের কোন ফাটল দিয়ে নয়। তা হলে ডিসপ্লেটা অমন গনগনে লাল দেখাচ্ছে কেন? থরে থরে সাজানো মুখোশগুলো কী ভীষণ দেখাচ্ছে এই আলোতে! যেন একদল পিশাচ দাঁত বের করে হাসছে।
গোধূলির রঙ, নিজেকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল হেনডারসন। আসলে মুখোশগুলোর সাজানোর ঢঙই এরকম। তবু গা ছমছম করতে থাকে কল্পনাপ্রবণ লোকটার। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে সে।
জায়গাটা অন্ধকার এবং নীরব। ঘরের বাতাসে একাকীত্বের গন্ধ-যে গন্ধ নিরন্তর বিরাজ করে পৃথিবীর সব সমাধি, গভীর অরণ্য, আর দুর্গম পাহাড়ের গুহায় গুহায়। এবং-ধুশ-শালা! নিজের ওপর আবার রুষ্ট হলো হেনডারসন। আজ কী হয়েছে তার? ফাঁকা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে হাসল সে। নিজেকে সান্তনা দিল, এটা আর কিছু নয়, কসটিউম-শপের গন্ধ। গন্ধটা তাকে কলেজের সেই শখের নাটকের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। এই ন্যাপথালিন, জীর্ণ পশম, তেল আর রঙের গন্ধের সাথে তার পরিচয় অনেকদিনের। হ্যামলেট নাটকে অভিনয়ের সেই দৃশ্যগুলো মনে করতে করতে অজান্তেই একটা দাঁত কেলানো মাথার খুলি তুলে নিল সে।
সংবিৎ ফিরতেই খুলিটা তার মাথায় চমকপ্রদ একটা ফন্দি যোগাল। এই হ্যালোইনের রাতে অন্য সবার মত রাজা, তুর্কীবীর কিংবা জলদস্যু সেজে উৎসবে যাবার ইচ্ছে নেই তার। সাধারণ ছদ্মবেশে লিস্ট্রোমের ওখানে গেলে কেউ তাকে পাত্তাই দেবে না। তাছাড়া লিণ্ডস্ট্রোমও মনঃক্ষুণ্ণ হবে। কারণ তার সোসাইটির বন্ধুরা আসবে দামী পোশাকে ছদ্মবেশ নিয়ে। হেনডারসন অবশ্যি লিওস্ট্রোমের ওই কৃত্রিম বন্ধুদের তেমন একটা তোয়াক্কা করে না। আসবে তো সব মেয়েলি স্বভাবের পুরুষ, আর মণি-মুক্তোখচিত ভারি গয়না পরা ঘোড়াটা রমণীরা। তাদের ভড়কে দিয়ে হ্যালোইনের প্রাণসঞ্চার করতে ভয়ঙ্কর একটা কিছু সাজবে না কেন সে?
© 2023 BnBoi - All Right Reserved
© 2023 BnBoi - All Right Reserved