হঠাৎ একটা বুদ্ধি এল মাথায়। কাজটা ভয়ঙ্কর কিন্তু এ ছাড়া তিতলিকে থামাবার কোনও উপায় নেই।
আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলাম বিছানায়। মোটামুটি যখন নিশ্চিত হলাম এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে তিতলি, পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলাম নিজের কামরা থেকে। আমার পাশের ঘরটাই তিতলির বেডরুম। ওর ঘরে ঢুকলাম বুকে হৃৎপিণ্ডের ধড়াশ ধড়াশ নিয়ে। সোজা চলে গেলাম তিতলির ওয়াস্রোবের সামনে। লুকানো জায়গা থেকে বের করে নিলাম সিগার বক্স।
চাঁদের আলোয় মলি চাচী লেখা দেশলাইয়ের বাক্সটি তুলে নিলাম। বাক্সের ভেতরে মলি চাচীর কয়েক গাছি চুল।
আমি নিঃশব্দ পায়ে চলে এলাম আমার ঘুমন্ত বোনের শিয়রে। ড্রেসিং গাউনের পকেটে আগেই নিয়ে আসা ছোট, ধারালো কাঁচিটি বের করে অত্যন্ত সাবধানে তিতলির এক গোছা চুল কেটে নিলাম। চাচী এবং তিতলি দুজনের চুলই কুচকুচে কালো। খুব ভালোভাবে লক্ষ না করলে বোঝা যাবে না কার চুল কোটা।
চাচীর চুল দেশলাই বাক্স থেকে বের করে ফেলে দিলাম। ওখানে ভরে রাখলাম তিতলির চুল। তারপর চুপচাপ সিগার বক্স যথাস্থানে রেখে বেড়ালের পায়ে ফিরে এলাম নিজের ঘরে। সে রাতে আর ঘুম হলো না আমার। সারারাত কাঁদলাম চাচার জন্য এবং তিতলির জন্য। আমি এরকম কিছু করতে চাইনি। কিন্তু মলি চাচীকে বাঁচাতে এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না।
পরদিন সকালে উঠে তিতলির পায়ে ধরলাম যেন সে মলি চাচীর কোনও ক্ষতি না করে। কিন্তু আমার কথা কানেই তুলল না। সে ইতিমধ্যে পুতুলের গায়ে সেলোটেপ দিয়ে জড়িয়ে দিয়েছে চুল।
আয়, বলল তিতলি, এক সঙ্গে উপভোগ করি মজা।
মলি চাচী ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন। তাকিয়ে আছেন দেয়ালের একটি বাঁধানো ফটোগ্রাফের দিকে। চাচী আর চাচার বিয়ের রঙিন ছবি। আমাদের দিকে পেছন ফেরা। তবে থেকে থেকে পিঠটা কেঁপে উঠছে বলে বোঝা যায় চাচী কাঁদছেন।
তিতলি পিন ঠেকাল ভুডু পুতুলের মাথায়।
প্লীজ, আপু…প্লীজ, ফিসফিস করলাম আমি, আমাকে গ্রাহ্য করল না তিতলি। মলি চাচীর দিকে তাকিয়ে অশুভ, ভয়ঙ্কর একটা হাসি ফুটল মুখে।
তারপর সে পিনটা আমূল বসিয়ে দিল পুতুলের মাথায়।
বিস্মিত, যন্ত্রণাকাতর একটা দৃষ্টি ফুটল তিতলির চোখে। হাত থেকে খসে পড়ে গেল পুতুল। গগনবিদারী একটা চিৎকার দিল তিতলি। তারপর পুতুলের মত সে-ও চেয়ার থেকে পড়ে গেল মেঝেতে। বাঁকা-তেড়া হয়ে শুয়ে রইল।
আমি লাফ মেরে মেঝে থেকে তুলে নিলাম পুতুল, একটানে খুলে নিলাম পিন।
কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে…
.
স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো তিতলি আপুকে। ও বেঁচে আছে। তবে ডাক্তাররা বলেছেন ওর ভয়ানক ব্রেন হ্যাঁমারেজ হয়েছে। বাকি জীবনটা হাসপাতালেই কাটাতে হবে। মেশিনের সাহায্যে বেঁচে থাকবে ও, তবে মানুষ হিসেবে নয়। একটা ভেজিটেবল হয়ে।
আমি মলি চাচীর সঙ্গে আছি। বড্ড নিষ্প্রাণ আমাদের জীবন। চাচাকে হারিয়ে চাচীর মুখ থেকে সেই যে নিভে গেছে হাসি, ফিরে আসেনি আর।
আমরা প্রতি বিষুদবার তিতলি আপুকে দেখতে হাসপাতালে যাই। ও আমাদেরকে চিনতে পারে না।
আর ভুডু পুতুল? ওটা এখন আমার জিম্মায়। ওটা মানুষের যে ক্ষতি করেছে, আমি চাই না ওকে অন্য কেউ আবার ব্যবহার করার সুযোগ পাক… শুধু আমি ছাড়া!