তিতলি আপু হাতের পুতুলটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওর চাউনিটা কেমন অদ্ভুত। আমার গা শিরশির করে উঠল।
আমার দিকে চোখ তুলে চাইল আপু। জানিস, ওই বইটা পড়ার পরে আমার বহুবার মনে সাধ জেগেছে। ইস, ওরকম একটা পুতুল যদি সত্যি পেতাম! স্বপ্নটা আজ পূরণ হলো।
লেখকরা বানিয়ে অনেক কিছু লেখে। তা কখনও সত্যি হয় নাকি? ঠোঁট ওল্টালাম আমি।
তুই ভুডু পুতুল সম্পর্কে কিছুই জানিস না। তাই গাধার মত কথা, বলছিস, দাবড়ি দিল আপু। ভুডু সত্যি নাকি মিথ্যা তার প্রমাণ তোকে দেখিয়ে দিচ্ছি।
পুতুল নিয়ে নিচে নেমে এল তিতলি আপু। ওর পড়ার টেবিলের পিন কুশন থেকে একটা পিন নিল। বিড় বিড় করে বলল, এটা কার ওপর ব্যবহার করা যায় ভাবছি। হঠাৎ চোখ পড়ল বুড়ো মালী বারেক দাদুর ওপর। শুনেছি এ বাড়িতে বহুদিন ধরে আছে মানুষটা। তার একমাত্র কাজ বাগানের যত্ন নেয়া। মাঝে মধ্যে বাড়ির ফাইফরমাশও খাটে। তবে বেশিরভাগ সময় তাকে দেখি নাক ডেকে ভোসভোস করে ঘুমাচ্ছে। লোকটা অলস এবং ফাঁকিবাজ।
বারেক দাদুকে দিয়েই এক্সপেরিমেন্টটা হয়ে যাক! উৎসাহী গলায় বলল তিতলি আপু।
বুড়ো লোকটাকে আমার তেমন পছন্দ হয় না। কাজেই তাকে দিয়ে আপু ভুডু এক্সপেরিমেন্ট করবে শুনে আমি সোৎসাহে আপুর কথায় সায় দিলাম। তাছাড়া সত্যি এতে কাজ হয় কিনা দেখার কৌতূহলও হচ্ছিল বেশ।
বারেক দাদু বারান্দার কাঠের টুলে বসে ঝিমোচ্ছিল। তিতলি আপু বলল, আমাদের শুধু যা করতে হবে তা হলো এ পুতুলটাকে ভাবতে হবে বারেক দাদু। পণ্ডিতি ভঙ্গিতে আমার ওপর লেকচার ঝাড়ছে ও। পুতুলের গায়ে যে-ই পিনের খোঁচা দেব, দেখবি দাদু বাবারে মারে করে চিৎকার দিয়ে উঠেছে।
আমরা পুতুলটার দিকে তাকিয়ে এক মনে ভাবতে লাগলাম, এটা বারেক দাদু। তারপর তিতলি পুতুলের পিঠে ঢুকিয়ে দিল পিন।
কিন্তু কিছুই ঘটল না।
বলেছিলাম না এসব ভুয়া, হি হি করে হেসে উঠলাম আমি।
চুপ! এটা ভুয়া না, ঠোঁট কামড়াল আপু, এটা দিয়ে তো কাজ হবার কথা ছিল। হয়তো আমি কোনও ভুল করে ফেলেছি।
আমার বড় বোনের মাথায় একবার কোনও মতলব ঢুকলে ওটা সে হাসিল করে ছাড়বেই।
আয় আমার সঙ্গে, হুকুম দিল আপু। ওর পেছন পেছন চললাম চাচার লাইব্রেরিতে। চাচা বইয়ের সাংঘাতিক পোকা। হাজার হাজার বই আছে তাঁর। আমি অবশ্য গল্পের বইটই তেমন পড়ি না। তিতলি আপু পড়ে। তবে বেশিরভাগ হরর গল্প। এজন্যই বোধহয় ওর মাথায় সবসময় হরর চিন্তা গিজগিজ করে।
চাচার বিশাল লাইব্রেরির একটা আলমারি বোঝাই শুধু সেবা প্রকাশনীর বই। মাসুদ রানা, অনুবাদ, ওয়েস্টার্ন, তিন গোয়েন্দা। আরও কত কী! তিতলি আপু আলমারি খুলে একটা বই বের করল।
বইয়ের নাম ভুডু লেখক অনীশ দাস অপু। আপু বইয়ের পাতা খুলে মনোযোগ দিয়ে কী যেন পড়ল কিছুক্ষণ। তারপর লাফিয়ে উঠল, ইয়েস! পেয়ে গেছি!
কী পেয়েছো?
এখানে লিখেছে ভুডু পুতুল দিয়ে ভূতের ওঝারা যার ক্ষতি করতে চাইত, আগে ওই লোকের শরীর থেকে কিছু একটা সংগ্রহ করে নিত।
কী রকম?
ধর চুল-টুল জাতীয় কিছু।
আমরা চলে এলাম বারান্দায়। এখন আর বৃষ্টি পড়ছে না। বেশ ঠাণ্ডা একটা হাওয়া বইছে। শীতল বাতাসে বারেক দাদু রীতিমত নাক ডাকতে লেগেছে।
বুড়োর মাথা থেকে কীভাবে চুল আনা যায় বল তো?
ফিসফিস করল আপু।
গিয়ে বলব নাকি দাদু তোমার এক গাছি চুল দেবে? আমাদের খুব দরকার।
আরে ছাগল, ভৎর্সনার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল তিতলি। তাহলে তো বুড়ো সন্দেহ করে বসবে। হঠাৎ কী দেখে যেন ওর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পেয়ে গেছি।!।
কী পেয়েছে?
বুড়োর টুপি। ওর টুপিতে নিশ্চয় চুল লেগে আছে। আঙুল বাড়িয়ে বারেক দাদুর মাথার টুপিতে ইঙ্গিত করল আপু। যা, টুপিটা খুলে নিয়ে আয়! আদেশ করল ও।
আমি পারব না বাপু! সভয়ে এক কদম পিছিয়ে গেলাম। যদি জেগে যায়?
যতসব ভীতুর ডিম, আমার দিকে রোষকষায়িত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তিতলি আপু। তারপর পা টিপে টিপে এগোল বারেক দাদুর দিকে। পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল মিনিটখানেক। আমি দশ হাত দূরে দাঁড়িয়েও বুড়োর নাসিকা গর্জন শুনতে। পাচ্ছি। মনে হচ্ছে বোমা ফাটালেও এ ঘুম ভাঙবে না। দেখলাম আপু আলগোছে দাদুর মাথা থেকে সাদা টুপিটি খুলে নিল। টুপির ভিতরে চালিয়ে দিল আঙুল। তারপর আবার আগের জায়গায় ফিরে গেল টুপি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বুড়ো আঙুল তুলে দেখাল আপু। তারপর বেড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে ফিরে এল। মুঠো খুলে দেখাল। কয়েক গোছ সাদা চুল হাতে।
টেপ দিয়ে চুলের গোছা ভুডু পুতুলের গায়ে লাগিয়ে দিল তিতলি আপু। ফিরে এলাম বারান্দায়। দাঁড়ালাম একটা থামের আড়ালে। হাতে আলপিন নিয়ে আপু বলল, নে, এবার আবার আগের মত ভাবতে শুরু কর।
আমরা আবার ভাবতে লাগলাম পুতুলটা অন্য কেউ নয়, স্বয়ং বারেক দাদু। তারপর ওটার নিতম্বে পিন ফুটিয়ে দিল আপু।
বিকট একটা চিৎকার দিয়ে টুল থেকে লাফিয়ে উঠল বুড়ো, পাছায় হাত ঘষছে। চেহারায় যন্ত্রণা এবং হতবিহ্বল ভাব।
হিসহিস করে উঠল আপু, কাজ হয়েছে!
এটা কাকতালীয়ভাবেও ঘটতে পারে, বললাম আমি।
ঘটনা দেখে অবাক হলেও আমি বিস্ময়ের ভাবটুকু গোপন করেছি। কারণ চাই না আপু বুঝে ফেলুক তার কর্মকাণ্ডে আমি মুগ্ধ এবং তাজ্জব।