ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও প্রশ্নটা করি- আপনার কি ধারণা সেবাই আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে? প্রশ্ন করল চেলসি।
ধারণা? আমি নিশ্চিত ওটা সেবা ছিল।
আপনি বলেছিলেন সেদিন হয়তো এসে হাজির হয়েছে। হ্যাঁ, এতদিন পরে অবশেষে মুক্তি ঘটতে পারে। মানে কী এ কথার? জানতে চাইল র্যাচেল।
আমার ধারণা অতৃপ্ত প্রেতাত্মাদের অসম্পূর্ণ কিছু কাজ থাকে, ব্যাখ্যা করল জ্যানেল। সে কাজ শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি পায় না তাদের আত্মা। সেবার আত্মাও অতৃপ্ত ছিল সে পলিকে রক্ষা করতে পারেনি বলে। একশ বছর ধরে তার আত্মা ঘুরে মরেছে অসমাপ্ত কাজটা সমাপ্ত করার জন্যে। তারপর চেলসির ঘটনাটা ঘটল। সে বোট থেকে পড়ে গেল। ডুবে মরতে যাচ্ছিল। সেবা এসে তাকে বাঁচাল। রক্ষা করল একটি বাচ্চা মেয়ের জীবন। আর পানিতে ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজন রইল না সেবার। তার আত্মা মুক্তি পেল এতদিন পরে।
কিন্তু কুকুরটাকে আমিও দেখেছি, বলল র্যাচেল। আর সেটা চেলসি উদ্ধার পাবার পরে।
আমার ধারণা তুমি যে সেবাকে দেখেছ সে ছিল ১০০ বছরের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া সেবা। একটা কথা জিজ্ঞেস করি? অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে কি ঘেউ ঘেউ করেছিল কুকুরটা?
জ্বি, জবাব দিল র্যাচেল।
তার মানে পৃথিবীর কাছ থেকে চির বিদায় নিয়েছে সে, বলল জ্যানেল। আর কেউ কোনোদিন দেখতে পাবে না তাকে। তার আত্মা এখন বাস করছে শান্তিতে।
আতংক
সারা হপ্তা ধরে উত্তুরে হাওয়া বইবার কথা বলছিল ওরা। বিষুদবার হামলে পড়ল ঝড়। বিকেল চারটার মধ্যে আট ইঞ্চি তুষার জমে উঠল রাস্তায়, থামার কোনও লক্ষণ নেই। আমরা অভ্যাসমত বিকেল পাঁচটা/ছটার দিকে হাজির হয়ে গেলাম হেনরির নাইট আউল-এ। ব্যাঙ্গোরের এই একটাই মাত্র দোকান যা ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় খোলে।
হেনরি কেউকেটা কোনও ব্যবসায়ী নয়, কলেজ ছাত্রদের কাছে বিয়ার আর মদ বিক্রি করে। আমাদের মত অকর্মার ধাড়িদের আড্ডার চমৎকার জায়গা হেনরির বার।
আজ বিকেলে হেনরি বসেছে কাউন্টারে। আমি, বিল পেলহ্যাম, বার্টি কনরস আর কার্ল লিটলফিল্ড ঘিরে বসেছি চুল্লি। বাইরে, ওহায়ো স্ট্রীটে কোনও গাড়ি চলছে না। বৈদ্যুতিক লাঙল দিয়েও জমাটবাধা তুষার কাটতে গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে লোকগুলো। শো শো শব্দে বইছে প্রবল হাওয়া। ডাইনোসরের মেরুদণ্ডের মত উঁচু আর স্কুপ হয়ে আছে তুষার বাড়িঘরের ছাদে।
হেনরির দোকানে আজ বিকেলে খদ্দের বলতে মোটে তিনজন-অবশ্য কানা এডিকে যদি এর কাতারে ফেলা যায়। এডির বয়স সত্তরের কাছাকাছি, পুরোপুরি অন্ধ নয় সে। হপ্তায় দুতিনদিন আসে সে এখানে। কোটের নিচে ব্রেড লুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায়, তোমাদেরকে আবার কেমন বোকা বানালাম এমন ভাব নিয়ে। হেনরি এডিকে পছন্দ করে বলে তার কাছ থেকে কখনোই রুটির দাম রাখে না।
আমরা বসে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল দরজা, ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাঁপটা নিয়ে। টলতে টলতে ভিতরে ঢুকল এক কিশোর। মেঝেতে পা ঠুকে জুতো থেকে বরফ ঝাড়ছে। ওকে দেখেই চিনে ফেললাম। রিচি গ্রেনাডাইনের ছেলে। চেহারায় তীব্র উৎকণ্ঠা। মুখ ফ্যাকাসে। কণ্ঠমণি ওঠানামা করছে, ঘন ঘন ঢোক গিলছে বলে।
মি, পার্মালি, হেনরির উদ্দেশে বলল সে, চোখের মণি ঘুরছে সকেটের মধ্যে। আপনাকে এখুনি একবার আসতে হবে। ওঁর জন্য বিয়ার নিয়ে যাব। আমি ও বাড়িতে আর ফিরতে চাই না। আমার ভয় লাগছে।
একটু সুস্থির হয়ে বসো, কসাইর সাদা অ্যাপ্রনটা খুলে রেখে কাউন্টার ঘুরে এল হেনরি। কী হয়েছে? তোমার বাবা মাতাল হয়ে গেছে?
হেনরির কথায় বুঝলাম রিচি বেশ কয়েকদিন ধরে ওর দোকানে আসছে না। প্রতিদিনই ওর একটা বিয়ার চাই, সবচেয়ে সস্তাটা কিনবে সে। বিশালদেহী, নোটকু রিচি বিয়ার খেতেও পারে। ক্লিফটনের করাতকলে কাজ করত সে। কিন্তু কী একটা ভুলের অপরাধে চাকরিটা চলে যায়। করাত-কল কোম্পানি অবশ্য ওকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। চাকরি ছাড়ার পর থেকে সারাদিন বিয়ার খেতে খেতে আরও ফুলেছে রিচি। এখন ছেলেকে পাঠায় বিয়ার কিনতে।
বাবা মাতাল হয়েছে, শুনতে পেলাম ছেলেটা বলছে। কিন্তু সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা…সমস্যা…ওহ্ ঈশ্বর, ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর!
হেনরি কার্লকে বলল, কার্ল, তুমি এদিকে দুমিনিট খেয়াল রাখতে পারবে?
অবশ্যই।
বেশ। টিমি স্টকরুমে চলো। শুনি কী হয়েছে।
ছেলেটাকে নিয়ে চলে গেল হেনরি। কার্ল কাউন্টারে এসে বসল হেনরির টুলে। কেউ কিছুক্ষণ কোনও কথা বলল না। আমরা হেনরির গভীর, ধীর গলা শুনতে পেলাম। টিমি উত্তেজিত ও দ্রুত কণ্ঠে কথা বলছে। তারপর ফুঁপিয়ে উঠল সে।
বিল পেলহ্যাম গলা খাঁকারি দিয়ে পাইপে তামাক ভরতে লাগল।
রিচিকে অনেকদিন দেখি না। বললাম আমি।
ঘোঁত ঘোঁত করে উঠল বিল, তাতে কিছু আসে যায় না।
অক্টোবরের শেষে একবার এসেছিল, জানাল কার্ল। হ্যালোউইনের সময়। এক কেস বিয়ার কিনল। দিনদিন ফুলে যাচ্ছিল ও।
তারপর আর কিছু বলার মত পেলাম না। ছেলেটা এখনও কাঁদছে। তবে কাঁদতে কাঁদতে কথাও বলছে। বাইরে গর্জন ছাড়ছে বাতাস, দরজা-জানালায় চাবুক কষাচ্ছে। রেডিওতে বলল সকালের মধ্যে আরও ছয় ইঞ্চি পুরু হয়ে বরফ পড়বে। এখন জানুয়ারির মাঝামাঝি। ভাবছিলাম অক্টোবরের পর থেকে রিচির চেহারা আদৌ কেউ দেখেছি কিনা।