আসল জায়গায় এসে পড়েছি নাকি? আধ বোজা চোখে একবার চারপাশে দেখল হ্যারিসন, গলা থেকে কোলা ব্যাঙের ডাক বেরিয়েছে।
হ্যাঁ, জবাব দিল ক্লার্ক। লিম চং আপনাকে ভেতরে নিয়ে যাবে। আমি এখানে আছি। ওসব জিনিস আগেও দেখেছি। আর দেখতে চাই না।
বিড়বিড় করে কি বলল হ্যারিসন বোঝা গেল না, বুড়ো চাইনিজকে অনুসরণ করল। কাছের একটা কুটিরের দিকে হাঁটছে লিম চং, তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে হ্যারিসনের। ঘরের ভেতর সে ঢুকতেও পারল না, তার আগেই মেঝের ওপর পড়ে গেল জ্ঞান হারিয়ে।
জ্ঞান ফিরে পাবার পরে ওয়েন হ্যারিসন প্রথমেই নিজেকে ধিক্কার দিল কেন বোকার মত সে স্থানীয় চোলাই মদকে পাত্তা দিতে চায়নি। এগুলোর সাংঘাতিক তেজ বোঝাই যাচ্ছে। হ্যাংওভার কাটেনি এখনও। তালুটা ফেটে যেতে চাইছে। সে একটা হাত তুলে কপালটা চেপে ধরতে চাইল, পারল না। অজানা একটা ভয়ে গায়ে কাঁটা দিল। ভয়টাকে দূর করতে হ্যারিসন ভাবতে লাগল সে কোথায়। এসেছে। মাথাটা কাজ করছে না ঠিকমত, আর চোখেও ভালো দেখতে পাচ্ছে না। অন্ধকারে ডুবে আছে ও, নিজের হাত-পাও ঠাহর হচ্ছে না। দোরগোড়ায় একটা মাটির প্রদীপ জ্বলছে বটে কিন্তু ওটার আয়ু প্রায় শেষ। কারণ একেবারে মিটমিটে আলো। হঠাৎ বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা লাফ দিয়ে উঠল হ্যারিসনের প্রদীপটাকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। কেউ একজন প্রদীপটা হাতে তুলে নিয়েছে, যদিও দেখা যাচ্ছে না তাকে। অবশ্য একটু পরেই লোকটাকে দেখা গেল আলোটা উজ্জ্বল হয়ে উঠতে। তেল দেয়া হয়েছে প্রদীপে। সেই বুড়ো লিম চং। বুড়ো সলতেটা উস্কে দিল, লাফিয়ে উঠল আগুন, হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখ কুঁচকে গেল হ্যারিসনের।
এসব হচ্ছেটা কি? চেঁচিয়ে উঠল ও। ক্লার্ক কোথায়?
লিম চং প্রদীপটাকে কাঠের একটা পায়ার ওপর রেখে দিল, তারপর এগিয়ে গেল হ্যারিসনের দিকে।
মি. ক্লার্ক কাছে পিঠেই আছেন, বলল সে নরম গলায়।
বুড়োর মুখ থেকে বিকট গন্ধ আসছে, মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল হ্যারিসন। পারল না। পরমুহূর্তে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল ও। সাথে সাথে জমে গেল আতঙ্কে। ওকে ভারী একটা কাঠের নেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে, মাথাটা ঢোকানো হয়েছে কাঠেরই তৈরি সঁশির মত একটা যন্ত্রের ভেতরে। যন্ত্রটা এমনভাবে ওর মাথা চেপে আছে, ডানে বা বায়ে ফিরে তাকানোর উপায় নেই। একটা ঘোরের ভেতর এতক্ষণ ছিল বলে হ্যারিসন বুঝতে পারেনি আসলে সে কাঠের চেয়ারটাতে বন্দী হয়ে আছে। কিন্তু কেন? কারণটা বুঝতে না পারলেও অজানা সেই ভয়টা আবার ফিরে এল ওর মাঝে।
তোমরা কি চাও আমার কাছে? টাকা? তাহলে যা আছে নিয়ে যাও। দয়া করে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করে দাও! চিৎকার করে উঠল হ্যারিসন, তবে কাজ হলো কোন।
লিম চং ঘুরে ওর পেছনে চলে এল, মুখ খুলতে সেই পচা গন্ধটা নাকে ধাক্কা মারল হ্যারিসনের।
না, স্যার। আপনার টাকার দরকার নেই আমাদের।
একটু পরেই ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল হ্যারিসন। বুড়ো ক্ষুরের মত ধারাল কিছু একটা জিনিস বসিয়ে দিয়েছে ওর কপালের পাশে, হেয়ার লাইনের ঠিক নিচে। পাগলের মত ধস্তাধস্তি করল ও, লাভ হলো না। বাধন ছিঁড়ল না। সাহায্যের আশায় চিৎকার করে ক্লার্ককে ডাকল সে, কিন্তু কেউ ওর সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এল না। তবু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে হ্যারিসন।
ব্যাথটা অসহ্য। কোন কিছুর সাথে তুলনা দেয়া যায় না। হ্যারিসন টের পেল তার খুলি থেকে মাংসসহ চুল কেটে নেয়া হচ্ছে, ঘাড় এবং মুখ বেয়ে গরম রক্ত নামতে শুরু করল, চোখে আঠালো ধারাটা পড়তে আচ্ছন্ন হয়ে এল দৃষ্টি, লালচে কুয়াশার একটা আবরণ সৃষ্টি হলো সামনে। গলার সমস্ত রগ ফুলে উঠল হ্যারিসনের চিৎকার দিতে গিয়ে, বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা পাজরের গায়ে দমাদম বাড়ি খাচ্ছে। ভীষণ আতঙ্ক ওকে প্রায় অবশ করে দিল। শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে যেন প্রতিবাদ করেও লাভ হবে না জেনে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে হ্যারিসনের। এখন আর চিৎকার করছে না, গোঙাচ্ছে অস্ফুটে আর ওকে দয়া করতে বলছে। শেষের দিকে কর্কশ, ফেঁপানোর মত আওয়াজ বের হতে লাগল গলা থেকে। শিশুর মত কাঁদতে শুরু করল হ্যারিসন, লবণাক্ত জলের সাথে রক্ত ঢুকে গেল মুখে।
উখা বা করাত ঘষার খরখরে শব্দ শুনতে পেল হ্যারিসন হঠাৎ। লিম চং জিনিসটা দিয়ে ওর খুলি কাটতে শুরু করেছে। প্রচণ্ড ভয়ে কেঁপে উঠল হ্যারিসন, বিস্ফারিত চোখে দেখল ওর খুলির ছোট ছোট সাদা হাড় মেঝের ওপর ছিটকে পড়ছে।
গোঙাতে গোঙাতে চোখ তুলে চাইল হ্যারিসন। ওর সামনে হলদে রঙের ভৌতিক কয়েকটা মুখ, প্রদীপের কাঁপা আলোতে দেখা গেল শয়তানী হাসি সব কটার ঠোঁটে। ওদের ভেতরে রিচার্ড ক্লার্কও আছে। কেমন জব্দ! নিঃশব্দে হেসে যেন বলছে ও। হ্যারিসন দেখল উপস্থিত দর্শকদের সবাই সাগ্রহে থাবার মত হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার খুলি লক্ষ্য করে। পরক্ষণে মাথায় ভয়ঙ্কর একটা ব্যথার অনুভূতি ওর সারা শরীরে আগুন ধরিয়ে দিল। কয়েক সেকেণ্ডের জন্য আঁধার হয়ে এল দুনিয়া, শেষ মুহূর্তে, বহু কষ্টে চোখ মেলে তাকাল হ্যারিসন। দেখল ওদের দুজন রক্ত মাখা, স্পঞ্জের মত ধূসর একটা জিনিস মুখে পুরে কচমচ করে চিবুতে শুরু করেছে। তার পরপরই নিঃসীম আঁধার আবার গ্রাস করল হ্যারিসনকে।