বিরতি দিয়ে চামড়ার আর্ম চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ক্লার্ক, লক্ষ করছে গল্প শুনে আমেরিকানটার কি প্রতিক্রিয়া হয়। বিরক্তি লাগল, কারণ হ্যারিসন ওর প্রতি তেমন। আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তবু সে বলে চলল।
কাবাডি হচ্ছে প্রায়শ্চিত্তের আরেক ধরন। জিনিসটা ভারী কাঠ দিয়ে তৈরি, তাতে ক্ষুরের মত ধারাল ব্লেড ঢোকানো। প্রায়শ্চিত্তকারীর দুকাঁধে কাঠের ফ্রেমটা বসানো হয়।
হ্যারিসন ক্লার্কের গল্প শুনছে না। তার সমস্ত মনোযোগ চাইনিজ ওয়েট্রেসের দিকে। মেয়েটির পরনে চিওংসাম। সে মদের বোতল নিয়ে ওদের টেবিলে আসছে, প্রতিটি পা ফেলার সময় বিদ্যুৎ ঝিলিকের মত ধবধবে সাদা ঊরু দেখা যাচ্ছে কাটা পোশাকটার আড়াল থেকে। হ্যারিসন ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মেয়েটি যেন ইচ্ছে করে আরও বেশি নিতম্ব দোলাল। মদের বোতল রেখে মেয়েটি চলে যাচ্ছে, ওর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আমেরিকান। তরুণী দৃষ্টির আড়াল হলে ফিরল সে ক্লার্কের দিকে।
চাইনিজদের সম্পর্কে যে সব গল্প শুনি সব কি সত্যি? হেসে উঠে জানতে চাইল হ্যারিসন।
খুব রাগ হলো লোকটার ওপর। শালার আমেরিকান জাতটাই এমন! দাঁতে দাঁত চাপল ক্লাক। তবে চেহারা স্বাভাবিক করে বলতে লাগল, চাইনিজদের সম্পর্কে যে যাই বলুক বা কেন, ওরা কিন্তু বেশ অদ্ভুত প্রজাতির মানুষ। ওদের সংস্কৃতি, রীতি-নীতিগুলোও ভারি অদ্ভুত। আবার হেলান দিল সে চেয়ারে, অপেক্ষা করছে হ্যারিসন তার টোপটা গেলে কিনা। মুখের সামনে ধোয়ার মেঘ জমেছে, আমেরিকানটার চেহারা দেখা যাচ্ছিল না, সে অধৈর্যভঙ্গিতে হাত নেড়ে ধোয়া সরাল, এবার আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল, যেমন? মাছ টোপ গিলেছে। ক্লার্ক প্রস্তুত হলো ওকে নিয়ে খেলতে।
যেমন, কিছু চীনা সম্প্রদায়ের লোক সংফিশের মাথাটাকে খুব সুস্বাদু মনে করে। কাঁটা বাদ দিয়ে পুরো অংশটাই খেয়ে ফেলে, পাশ্চাত্যের মানুষদের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হতে পারে, নয় কি?
এক পাশের ভুরু কপালের দিকে উঠে গেল হ্যারিসনের, ঠোঁটে শুকনো হাসি ফুটল, তবে কোন মন্তব্য করল না। ক্লার্ক তার গল্পটাকে আরও ফাঁপিয়ে তুলল।
তারপর ধরুন, এখানে, মানে সিঙ্গাপুরে, এক শ্রেণীর চীনা আছে, এরা সবসময় অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। কিন্তু এরা এমন এক ধরনের উৎসব করে যা নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাসই করতাম না।
হ্যারিসন তার চেয়ারের এক কোণে কাত হয়ে বসেছিল, তার চেহারায় প্রবল আগ্রহের ভাব ফুটে উঠতে দেখে তৃপ্তি বোধ করল রিচার্ড ক্লার্ক। মনে মনে ভাবল, ব্যাটাকে বড় রকমের একটা ধাক্কা দিতে হবে।
সে আবার শুরু করল, এ চীনারা বিশ্বাস করে বানরের মগজ খেতে পারলে শুধু বুদ্ধি আর জ্ঞানই বাড়বে না, বৃদ্ধি পাবে সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা, নিশ্চয়তা দেবে দীর্ঘ জীবনের। তবে মগজটা খেতে হবে জ্যান্ত বানরের মাথা থেকে, তাৎক্ষণিকভাবে, নইলে কাজ হবে না। ওরা করে কি, হতভাগ্য বানরটাকে শক্ত করে বেঁধে ফেলে, তারপর মাথার খুলি ফাটিয়ে ভেতর থেকে মগজ বের করে এনে খায়। বানরটা মারা যাবার আগেই কাজটা করতে হয়। মানে যতক্ষণ জানোয়ারটা যন্ত্রণায় মোচড় খেতে থাকে, সেই সময়ের ভেতরে চীনারা খুবলে নেয় মগজ। সে দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। মগজ খুবলে নেয়ার সময় আহত বানরটা এমন ভয়ঙ্কর চিৎকার দিতে থাকে, এর চে ভয়াবহ ব্যাপার আর হয় না।
হ্যারিসনের চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, দৃষ্টিতে অবিশ্বাস।
এসব গল্প বলেই আপনি ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ করেন, না? চোখে না দেখলে আমি সত্যিই আপনার গল্প বিশ্বাস করব না। এ তো সাংঘাতিক অমানবিক কাণ্ড!
হাসল ক্লার্ক। ব্যাপারটা মানবিক না অমানবিক সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে কোন পরিবেশে আপনি বড় হয়ে উঠেছেন তার ওপর। সত্যি বলতে কি, সবার মূল্যবোধও এক নয়। যারা এই কাজটা করে তাদের কাছে কিন্তু এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।
এরপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল দুজনে। হ্যারিসনের এখনও সন্দেহ দূর হচ্ছে না। সে ক্লার্কের গল্পটা নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে গেছে। আবার যখন কথা বলতে শুরু করল, সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেল সে।
তিনশো ডলার দেয়ার কথা ছিল আপনাকে। হিপ-পকেটের পেট মোটা মানিব্যাগ থেকে এক তাড়া নোটা বের করল সে, তিনশো ডলারের বেশিই হবে, টাকাটা টেবিলের ওপর দিয়ে ঠেলে দিল ক্লার্কের দিকে। আপনাকে অ্যাডভান্স দিলাম পুরোটাই। অতিরিক্ত আরও পঞ্চাশ ডলার রাখুন। আশা করি আমাকে স্পেশাল কিছু জিনিস দেখানোর ব্যবস্থা করতে পারবেন।
টাকাটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল রিচার্ড ক্লার্ক, সিদ্ধান্ত নিল স্পেশাল কিছু জিনিস আমেরিকানটাকে দেখাবে সে। হ্যারিসন বিশেষ কিছু দেখার অধিকার রাখে। এমন কিছু যা সারা জীবন মনে থাকবে।
পরদিন সকালে একটা গাড়ি ভাড়া করে ক্লার্ক গুড উড হোটেলে চলে এল। হ্যারিসন যে জিনিস দেখতে চেয়েছে তার ব্যবস্থা সে করে এসেছে। গত রাতে, ক্লার্ক হোটেল থেকে চলে আসার পরে, হ্যারিসন নিজেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে রাতের শহরে বেরিয়ে পড়ে এবং এক প্রমোদবালাকে ভাড়া করে। লোকে চীনাদের সম্পর্কে যে গল্প বলে তা আদৌ সত্যি নয়, এই ব্যাপারটি হ্যারিসন আবিষ্কার করে ঠিকই, তবে যে জিনিসটি ওকে সবচে অবাক করেছে তা হলো, মাত্র বিশ ডলারের সে মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছে মেয়েটির কাছ থেকে। তার রাতের অভিযানের গল্প শুনে ক্লার্ক মৃদু হাসল শুধু, মন্তব্য করার প্রয়োজন বোধ করল না। তার মন পড়ে আছে অন্য জায়গায়। সে হ্যারিসনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।