***
তৃতীয় রাত
পাহাড়ি নদীটা ভীষণ খরস্রোতা। ছোটো স্টিমার কিংবা ইয়ট দ্বীপের গায়ে ভেড়ানো খুবই কঠিন। আটলান্টিকে গিয়ে পড়া নদীটার মোহনাও অনেক চওড়া। এপার থেকে ওপারের কিছুই দেখা যায় না। আর যা ঘূর্ণি দেখলে ভয়ে হিম হয়ে আসে রক্ত।
উজানে চলেছি আমরা। খুব সাবধানে না এগুলো যে কোনো মুহূর্তে ভয়ানক বিপদ ঘটে যেতে পারে। মাঝে মাঝে ডুবো চরাও আছে। স্টীমার আটকে যাওয়ার ষোলআনা আশঙ্কা। নকশা দেখে অত্যন্ত সাবধানে বা তীর ঘেঁষে এগুতে লাগলাম আমরা। এত সাবধানতা সত্ত্বেও দ্বীপ থেকে প্রায় দুশো গজ দূরে থাকতেই ওরকম এক চরায় আটকে গেল স্টিমার। ভাবছি কি করে পৌঁছানো যায় দ্বীপটাতে। এমন সময় শালতি চালিয়ে একজন নিগ্রো ছেলে এগিয়ে এলো আমাদের কাছে।
ছেলেটাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক, দ্বীপটাতে তাহলে মানুষ আছে।
আশপাশটা খুব ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলাম। নীল সমুদ্রের পানি খাঁড়ির মুখ পর্যন্ত এসে বাদামি হয়ে গেছে। বিশাল সব ঢেউ আছড়ে পড়ছে দ্বীপের গায়ে। বিস্তীর্ণ নদী মোহনায় ভাসছে বিরাট বিরাট কাঠের গুঁড়ি। দূরে সবুজ গভীর জঙ্গল। চারপাশে কেমন যেন থমথমে বিষণ্ণ আর গুমোট। বাতাস এত সঁতসেঁতে, মনে হচ্ছে শরীর ভিজিয়ে দেবে। পুরো পরিবেশটাই আমার কাছে মনে হলো অশুভ। তবু নামতে হবে ওই দ্বীপটাতে। খাবার পানি না নিলে সেন্ট পল দ্য লোয়ান্দায় পৌঁছুতে পারব না।
আমার একমাত্র সঙ্গী বুড়ো নাবিক প্যাটারসনকে নোঙর ফেলতে বললাম। স্টিমারের গায়ে শালতি ভিড়তেই বড়ো কাঠের একটা পিপে নিয়ে উঠে পড়লাম তাতে। মিনিট দশেক বাদেই ওটা দ্বীপে এসে পৌঁছাল। খাড়া ধাপ বেয়ে ওপরে উঠতেই চোখে পড়ল আর্মিটেজ অ্যান্ড উইলসন কোম্পানির সাইনবোর্ড। সাদা চুনকাম করা টানা বারান্দাঅলা নিচুঘর। বড়ো বড়ো কাঠের পিপেয় বারান্দাটা ভর্তি। সৈকতজুড়ে সাজানো তালের ডিঙি আর শালতি। ছোট্ট একটা জেটিও রয়েছে। সাদা পোশাক পরা দুজন ইংরেজ এগিয়ে এলেন। দশাসই চেহারার একজন অভ্যর্থনা জানালেন আমাকে। অদ্ভুত ধূসর তাঁর দাড়ি। অন্যজন লম্বা ছিপছিপে, গোমড়ামুখো। ব্যাঙের ছাতা আকৃতির বিরাট টুপিতে মুখের অর্ধেকটাই ঢাকা পড়েছে।
আপনাকে দেখে সত্যিই খুব খুশি হলাম, টুপি পরা ভদ্রলোক আগে কথা বললেন। আমি ওয়ালকার। আর্মিটেজ অ্যান্ড উইলসন কোম্পানির কর্মচারী। আর ইনি এই কোম্পানির ডাক্তার। মিস্টার সেভারাল। ওরকম কোন ইয়ট আমরা বহুদিন চোখেও দেখিনি।
আমি মেলড্রাম, হাসিমুখে বললাম। জাহাজটার মালিক। ওটার নাম গেমকক।
শখের ভ্রমণে বেরিয়েছেন বুঝি? ওয়ালকারই জিজ্ঞেস করলেন।
তা বলতে পারেন। প্রজাপতি সংগ্রহ আমার নেশা। সেনেগালের পশ্চিম উপকূল ধরে যাত্রা শুরু করেছি।
জায়গা বাছাই আপনার ঠিকই হয়েছে, মৃদু হেসে বললেন ডাক্তার সেভারাল।
হেসে বললাম, হ্যাঁ, এরই মধ্যে প্রায় চল্লিশটা বাক্স ভরে গেছে। আপনাদের এই দ্বীপে নেমেছি খাবার পানি নিতে। তবে খাবার পানির সঙ্গে যদি নতুন কোন প্রজাপতির খবর পাই…।
অবশ্যই পাবেন। ওগগাওয়াই নদীর মুখে প্রচুর প্রজাপতি আছে। সবে শুটি কেটে বেরিয়েছে ওগুলো। থাকুন না দুচারদিন আমাদের এই দ্বীপে। আপনি যে দয়া করে এখানে এসেছেন তাতে আমরা সত্যিই খুব খুশি হয়েছি। আসলে কি জানেন, গল্প-গুজব করা তো দূরের কথা, সাদা চামড়ার সভ্য মানুষ দেখার ভাগ্যটাও হয় না।
কথা বলতে বলতে আমরা এগিয়ে চললাম। জেটিতে শালতি বেঁধে নিগ্রো ছেলেটাও যোগ দিল আমাদের সাথে।
এখানে তাহলে আপনারা খুবই নিঃসঙ্গ? ডাক্তারকে বললাম।
হ্যাঁ। আগে খুবই অসহ্য লাগত। এখন অবশ্য সয়ে গেছে। কাজে ব্যস্ত থাকি সারাদিনই। সন্ধের পরপরই অবসর তো, সময়টা কাটতেই চায় না।
ওই সময়টা তাহলে কি করেন? জিজ্ঞেস করলাম।
সাধারণত দুজনে গল্পগুজব করি কিংবা মদ খাই। ওয়ালকারের আবার রাজনীতিতে দারুণ ঝোঁক। এসবের ওপর লেখাপড়াও করে প্রচুর।
দ্বীপ সম্পর্কেও অনেক কিছু জেনে নিলাম। এখানকার আবহাওয়া সারা বছর প্রায় একই রকম থাকে। দিনে অসম্ভব গরম। রাতে প্রচণ্ড ঠান্ডা। ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামে যখন-তখন। হঠাৎ করে হাড়-কাঁপানো জ্বরে একেবারে শয্যাশায়ী করে ফেলে। সিয়েরালিয়েন থেকে উপকূল ধরে যতই সামনে এগিয়েছি, ততই দেখেছি এই জ্বরের প্রকোপ।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই রেডি হয়ে যাবে রাতের খাবার, বললেন ডাক্তার সেভারাল। এ সপ্তাহে খাবার-দাবার তদারকির ভার পড়েছে ওয়ালকারের ওপর। চলুন না, আমরা ততক্ষণে ঘুরে দেখি দ্বীপটা।
ডাক্তারের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম।
সূর্য ডুবে গেছে। পশ্চিমের আকাশ তখনও রাঙা হয়ে আছে। ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাস কাঁপন তুলল সারি সারি পাম গাছের পাতায়। সরু পায়ে চলা পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। অনবরত কথা বলে চলেছেন ডাক্তার।
এখানে খুবই নিঃসঙ্গ আমরা। তবে জীবনটা একেবারে বৈচিত্রহীন নয়। রোমাঞ্চও আছে যথেষ্ট। অজানা যত রহস্যের মধ্যে বাস করছি বলতে পারেন। ওই যে দূরে গভীর বনটা দেখছেন না? উত্তর-পুব দিকে আঙুল তুলে দেখালেন তিনি। ওটা হলো দুচাইলুর বন। গরিলা আছে অনেক। গ্যাবুন, ভালুক আর বনমানুষও আছে। আর এ পাশের এই বন, দক্ষিণ-পুব দিকে দেখালেন তিনি, এই বনের ভেতর দিয়েই বয়ে এসেছে নদীটা। গভীর রহস্য ঢাকা বন। এখন পর্যন্ত কোনো সভ্যমানুষ যেতে পারেনি ওখানে। নদী মোহনাতে যেসব কাঠের গুঁড়ি ভাসতে দেখছেন, ওগুলো এসেছে ওই বন থেকেই। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ওপর আমার একটু পড়াশোনা আছে–মাঝে মাঝে এমন সব অদ্ভুদ ধরনের অর্কিড গাছপালা ভেসে আসে, যার কোনো নাম নিশানাই আমি উদ্ভিদ বিজ্ঞান বইয়ে দেখিনি। সভ্য মানুষের কাছে যা কল্পনারও অতীত। বলতে বলতে রহস্যঘন হয়ে ওঠে ডা. সেভারালের চোখ আর কণ্ঠস্বর। ফিসফিস করে বললেন, অজানা ওই বনটাই টিকিয়ে রেখেছে আমাদের ব্যবসা। ভেসে আসা ওই বনের শক্ত খুঁড়ি দিয়েই পিপে তৈরি করি আমরা।