নাচতে নাচতে বিছানায় গেলাম আমি। আগামীকাল থেকে লসগুলো পূরণ করব আমি। আপনি যদি আগেভাগে জানতে পারেন ছটা ঘোড়দৌড়ে কোন্ কোন্ ঘোড়া জিতবে, আপনাকে ঠেকায় কে? একদিনেই তো আপনি আপনার বিনিয়োগকৃত টাকার কয়েকগুণ ঘরে তুলে আনতে পারবেন। এবং তা-ই করলাম আমি।
পরদিন সন্ধ্যায় যথারীতি চলে এলাম টিউব স্টেশনে। একটা ফ্যাসফেসে কণ্ঠ বলল, পেপার, স্যার!
সেই বেঁটে লোকটাই, গালে জড়ানো মাফলার, ক্যাপটা এমনভাবে টেনে নামানো, চোখ দেখা যায় না। তার ঠাঠা আঙুল ঘষা খেল আমার হাতে। লক্ষ করলাম লোকটার কাছে একটাই মাত্র কাগজ।
আচ্ছা… বলতে গেলাম আমি, বাধা পেলাম পেছন থেকে ধাক্কা খেয়ে। স্টেশন থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসছিল একজন, আমাকে ধাক্কা মেরে হনহন করে এগোল সামনে। তাল সামলে পেছন ফিরলাম। নেই কাগজঅলা।
আমি এখন প্রতিটি রেসে জিতি। সেই সঙ্গে আমার স্টক ব্রোকারের কাছ থেকেও প্রচুর টাকা কামাই। কারণ আগেই বলে দিই স্টক এক্সচেঞ্জে কোন কোম্পানির দর নামবে, কোনটা উঠবে। রেস শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যা ছটায় চলে আসি টিউব স্টেশনে, সেদিনের কাগজ কিনতে। এবং প্রতি সন্ধ্যায় মুখে মাফলার পেঁচানো কাগজঅলা বন্ধুটিকে পেয়ে যাই। তার হাতে একটিই মাত্র কাগজ থাকে আমার কাছে বিক্রি করার জন্য।
দ্রুত ধনী হয়ে যাচ্ছি আমি। আবার জেনির পাণিপ্রার্থনা করলাম। যখন ধ্বংসের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলাম, ভেবেছি ইহজীবনে জেনির সঙ্গে দেখা হবে না আমার।
জেনির বাবা মালদার পার্টি। একমাত্র মেয়েকে মধ্যবিত্ত কারও হাতে তুলে না দেয়ার ব্যাপারে কঠোর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তবে এখন যেহেতু আমার টাকা আছে, তার জামাই হওয়ার দুঃসাহস দেখাতেই পারি। কারণ জানি আমি যদি জেনিকে বিত্তবৈভবের মধ্যে রাখতে পারি, এ বিয়েতে আপত্তি করবেন না ওর বাবা। আমার এখন জেনির বাবার চেয়েও বেশি টাকা এবং দিন দিন ব্যাংক ব্যালান্স বেড়েই চলেছে, সত্যি বলতে কী, আমি পরিণত হয়েছি টক অব দ্য টাউনে। সবার আলোচনার বিষয়বস্তু এখন আমি। কাজেই ওদের বাসায় যেদিন গেলাম, সাদর সম্ভাষণ জানাল পিতা ও কন্যা।
সেন্ট মার্গারেট চ্যাপেল বিয়ের অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য ধার্য করা হলো। সিদ্ধান্ত নিয়েছি সুইজারল্যান্ডে যাব মধুচন্দ্রিমায়।
টিউব স্টেশনে প্রতিদিন ক্ষুদ্র মানুষটির কাছ থেকে খবরের কাগজ কিনি আমি। এটা এখন রুটিনে দাঁড়িয়ে গেছে। আগে ভাবতাম জানব লোকটা কেন, কোত্থেকে এসেছে, কী তার পরিচয়। তার কাছে শুধু একটিই মাত্র পত্রিকা কেন থাকে এবং আমি স্টেশনে হাজির হওয়া মাত্র কাগজটা কেন সে তুলে দেয় আমার হাতে। কিন্তু লোকটার কাছ থেকে পত্রিকা কেনা এমন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, এসব নিয়ে একটুও মাথা ঘামাই না।
বিয়ের আগের দিন সিদ্ধান্ত নিলাম আর পত্রিকা কিনব না। স্টক এবং শেয়ারের দৌলতে আজ আমি দেশের শীর্ষস্থানীয় ধনীদের কাতারে। কাল বিকেল আড়াইটায় কোন্ ঘোড়া রেসে জিতবে, এ খবর জানার আমার এখন আর প্রয়োজন নেই।
জেনিকে কাল বিয়ে করছি আমি। এরপর ওই বেঁটে, নোংরা লোকটার স্মৃতি চিরতরে দূর করে দেব মন থেকে। লোকটার ঠাণ্ঠা আঙুলের স্পর্শে ভীতিকর শিহরণ থেকে মুক্ত থাকব।
তবু যথারীতি টিউব স্টেশনে হাজির হয়ে গেলাম আমি। না, রেসের কোন্ ঘোড়া জিতবে জেনে আরও টাকা কামাই করতে নয়, কৌতূহল জাগছে পত্রিকায় আমার বিয়ে নিয়ে কী খবর ছেপেছে দেখতে।
লোকটার হাতে যথারীতি সেই একটাই কাগজ। আমি কাগজটা তার হাত থেকে নিয়েছি, এই প্রথমবার সে আমার দিকে মুখ তুলে চাইল। তার কোটরাগত চোখের রঙ ধূসর, গাল চাপড়া ভাঙা। সে আজ মাফলার জড়ায়নি মুখে। মুখটা ভয়ঙ্কর মুখোশের মতো। আমি নিজের অজান্তে পিছিয়ে এলাম এক কদম, শিরদাঁড়া বেয়ে নামল ঠান্ডা বরফ জল। লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি, মুখে ভৌতিক হাসি ফুটল তার, লম্বা, হাড্ডিসার হাতখানা স্যালুটের ভঙ্গিতে তুলল, তারপর ঘুরে দাঁড়াল। মিশে গেল টিউব স্টেশনের জনতার ভিড়ে।
কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরলাম আমি। তবে ঘরে ঢুকে জোর করে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিতে চাইলাম লোকটার চিন্তা। ওকে ভয় পওয়ার কী আছে? ওর সঙ্গে তো ইহজীবনে দেখা হবে না আমার। কারণ ওর কাছ থেকে আর খবরের কাগজ কিনতে যাচ্ছি না আমি। লোকটা হয়তো জেনে ফেলেছে ব্যাপারটা। তাই স্যালুটের ভঙ্গিতে বিদায় জানিয়েছে আমাকে।
খবরের কাগজ খুললাম। আগ্রহ নিয়ে পাতা ওলটাচ্ছি। বিয়ে বিষয়ক কোনো খবরই নেই। অথচ বহু সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে আমি এবং জেনি জানিয়েছি কবে গাঁটছড়া বাঁধতে চলেছি দুজনে।
কাগজের তারিখটা দেখলাম। হ্যাঁ, এটা আগামীকালের খবরের কাগজই। কিন্তু বিয়ে সংক্রান্ত কোনো খবর ছাপেনি।
হঠাৎ প্রথম পাতার একটি খবরে আটকে গেল চোখ।
ঘুমের মধ্যে বরের মৃত্যু হেডলাইনে লেখা।
বুকের মধ্যে ঘোড়ার মতো লাফাতে শুরু করল কলজে। দপদপ করতে লাগল কপালের শিরা। রক্তচাপে ফুলে উঠল।
পড়লাম আমি ঘুমের মধ্যে মারা গেছি, আমার চাকর আমাকে দেখেছে চেয়ারে বসে আছি আমি ধোপদুরস্ত পোশাক পরে, হাতে কলম। মৃত্যুর কারণ ধারণা করা হয়েছে হার্ট ফেইলিওর।
তাই আমি এ লেখাটা লিখছি জেগে থাকার জন্য। বিয়ের আর কঘণ্টা বাকি। এটুকু সময়… আমার… জেগে… থাকতে…