কিন্তু ওটা রোজালিনের অনেক কাছে চলে এসেছে। রোজালিন রান্নাঘরে ছুটল। সেখান থেকে হলঘরে। তবে সদর দরজায় পৌঁছাতে পারল না। তার আগেই কীসের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে দড়াম করে পড়ে গেল মেঝেতে।
ভয়ঙ্কর জীবটা রোজালিনের সামনে এসে দাঁড়াল। বাড়িয়ে দিল রোমশ হাত। রোজালিনের মাথা স্পর্শ করল।
তুমি এসেছ, বলল ওটা মানুষের গলায়।
তুমি এসেছ, খাঁচায় বসে ভেংচাল কাকাতুয়া। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল রোজালিন।
.
জ্ঞান ফিরে পেল রোজালিন, চোখ মেলে চাইতেই চমকে গেল ভয়ানক। সৃষ্টিছাড়া জীবটা এখনও ঝুঁকে দেখছে ওকে। তার পাশে হ্যারিয়েট ফুপু।
রোজালিন, তুই একটা বাজে মেয়ে। মানা করেছিলাম না চিলেকোঠার ধারে কাছেও ঘেঁষবি না। বলেছিলাম ওখানে গেলে পস্তাবি। রাগে রোজালিনের দিকে আঙুল তুলে নাড়লেন তিনি। তোর কারণে ভয় পেয়েছে বেচারা হারম্যান।
বেচারা হারম্যান, পুনরাবৃত্তি করল কাকাতুয়া।
হ্যাঁ, বেচারাই তো, বললেন ফুপু, আদর করে নেড়ে দিলেন ছেলের মাথার চুল। আর্থার ওকে নিয়ে কত এক্সপেরিমেন্ট করল অথচ ও আর
আগের চেহারা ফিরে পেল না।
রোজালিনের দিকে ফিরলেন হ্যারিয়েট ফুপু। তোকে আর আমরা ছাড়তে পারব না, রোজালিন। কারণ তুই এখন আমাদের গোপন কথা জেনে ফেলেছিস। তোর বাবা অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে তোর খবর নেয়ার জন্য ফোন করলে জানিয়ে দেব তুই আমাদের এখানে আসিসইনি। আমরা চিলেকোঠায় ওর জন্য চমৎকার একটি ঘরের ব্যবস্থা করতে পারব, তাই না, হারম্যান?
উন্মাদ ফুপুর দিকে তাকাল রোজালিন। তারপর চাইল ফুপাত ভাইয়ের দিকে। হারম্যানের কদাকার চেহারায় জান্তব উল্লাস।
আমাদের সঙ্গ তোর মন্দ লাগবে না, রোজালিন। বললেন ফুপু।
মন্দ লাগবে না, ক্যাকক্যাক করল কাকাতুয়া।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিল রোজালিন। তারপর জ্ঞান হারাল আবার।
হারম্যান ওর অচেতন দেহ আলগোছে তুলে নিল কোলে, তারপর চলল চিলেকোঠার সিঁড়ি অভিমুখে।
ঘুমালেই বিপদ!
ভোর চারটা বাজে। কিন্তু এখনও ঘুমাতে সাহস পাচ্ছি না।
আমার বর্তমান দুর্দশার শুরু মাস তিনেক আগে, যেদিন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি।
বাবা মারা যাওয়ার দুবছরের মধ্যে তাঁর জমানো সমস্ত টাকা উড়িয়ে দিই আমি। ছোটোখাটো চাকরি করতাম মাঝে মাঝে আর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবতাম আমার পছন্দের ঘোড়াগুলো যদি আরেকটু জোরে ছুটতে পারত, কত ভালোই না হতো।
অভাব অনটনে জর্জরিত আমি যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল, সিদ্ধান্ত নিলাম এ জীবন আর রাখব না। এত কষ্ট করে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। আর আত্মহত্যার জন্য টিউব রেলওয়ে উৎকৃষ্ট স্থান। রেল লাইনে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকো, ব্যস- তোমার সব দুঃখ-কষ্ট কাটা পড়ে যাবে রেল গাড়ির চাকার নিচে।
আত্মহত্যার সিদ্ধান্তে অটল আমি সেদিনও সান্ধ্যকালীন পত্রিকা কেনার লোভ সামলাতে পারিনি। চলন্ত সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে কিনে ফেললাম সেদিনকার খবরের কাগজ। আগামীকাল বিকেল চারটায় যে ঘোড়দৌড়টা হবে, সে রেসের একটা ঘোড়ার ওপর বাজি ধরেছিলাম আমি। যদিও জানি আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে অনন্ত লোকের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়ে যাবে আমার। তবু কোন্ কোন্ ঘোড় রেসে অংশ নিচ্ছে জানার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। যদিও এই চতুস্পদ প্রাণীগুলোর ওপরে বাজি ধরতে গিয়েই গত দু বছরে ফতুর হয়ে গেছি।
যে লোকটার কাছ থেকে খবরের কাগজ কিনেছি সে আকারে ছোটোখাট, গালে মাফলার জড়ানো। কাপড়ের টুপিটা চোখ প্রায় ঢেকে রেখেছে। তার কাছে একটিই মাত্র কাগজ ছিল। তার হাত থেকে কাগজ নেয়ার সময় শিরশির করে উঠল গা। ইচ্ছে করে সে যেন ছুঁয়ে দিয়েছিল আমার হাত। তার আঙুলগুলো বরফের মতো ঠাষ্ঠা।
সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে দাঁড়িয়ে, উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় স্টপ প্রেস লেখাটিতে চোখ বুলালাম আমি।
ওতে লেখা বেলা সাড়ে চারটার রেসে কাম এরর নামে একটি ঘোড়া দৌড়ে জিতেছে। আমার বুকি নিশ্চয় রেগে আগুন হয়ে যাবে দেখে আমি রেসে হাজির হইনি।
হঠাৎ দম বন্ধ হয়ে এল ব্যাপারটার মাজেজা বুঝতে পেরে। কাম এরর-এর রেস তো আজ নয়, কাল বিকেলে। ঘোড়াটার জেতার খবর আগাম ছেপে দিয়েছে এ পত্রিকা।
কপাল কুঁড়ে ঘাম বেরুল। পত্রিকাটি ফেলে দিয়েছিলাম। তুলে নিলাম আবার। হাত কাঁপছে আমার বেলা দুটোর রেসে কোন ঘোড়া জিতল দেখতে গিয়ে।
এটি একটি কোল্ট। এ ঘোড়ার নামও শুনিনি।
আগামী দিনের খবরের কাগজ নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি আমি। কিন্তু এ পত্রিকাটি সেগুলো থেকে আলাদা…
আমার পত্রিকায় আগামীকালের তারিখ লেখা!
স্টেশনের প্রবেশ পথে চলে এলাম। যে লোকটা কাগজ বিক্রি করেছে, খুঁজছি তাকে। কিন্তু তার কোনো চিহ্ন নেই। ফল বিক্রেতা এক ছোঁড়াকে লোকটার চেহারার বর্ণনা দিয়ে জানতে চাইলাম। এরকম কাউকে তার চোখে পড়েছে কিনা।
এখানে কোনো হকারকে আজ দেখি নাই, ভাই, ভুরু কুঁচকে বলল সে। কোনো খবরের কাগজঅলাই আজ পত্রিকা বিক্রি করতে আসে নাই। আমি চলে এলাম ওখান থেকে।
বলাবাহুল্য সুইসাইড করিনি আমি। বদলে ফিরে এলাম বাড়ি। আগামীকালের পত্রিকার আদ্যোপান্ত চষে ফেললাম। পরদিন বিকেলের রেসের বিজয়ী ঘোড়াগুলো সম্পর্কে নোট টুকে নিলাম কাগজে, স্টক এক্সচেঞ্জের দাম লিখলাম, এমনকী কাল সন্ধ্যায় গ্ৰেহাউণ্ড রেসে কারা কারা জিতছে তাদের খবরও পড়ে ফেললাম অভিভূত বিস্ময়ে।