লোমহর্ষক এই জানোয়ারটার সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য তার বুকজোড়া একটা ছবি। মড়ার মাথার ছবি। চোখ ধাঁধানো সাদা রঙ দিয়ে যেন নিপুণভাবে আঁকা হয়েছে মস্ত কালো বুক জুড়ে। বাহাদুরি দিতে হয় শিল্পীকে।
বীভৎস জীবটাকে মিনিট কয়েক দেখার পর, বিশেষ করে বুকজোড়া মড়ার খুলি আমার গা-হাত-পা ঠান্ডা করে দেওয়ার পর–আতঙ্কে আমি হিম হয়ে গিয়েছিলাম। সমস্ত সত্তা দিয়ে উপলব্ধি করছিলাম, খুব শিগগিরই একটা অকল্পনীয় বিপদ আসছে। যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে অমূলক আশঙ্কাটাকে মন থেকে তাড়াতে তো পারিইনি–উলটো আমাকে স্থাণু করে রেখেছিল ওই কয়েকটা মিনিট।
বিমূঢ় চোখে বীভৎস সেই আকৃতি দেখতে দেখতে আর একটা ঘটনা ঘটে গেল। আচমকা হাঁ হয়ে গেল শুড়ের ডগায় বসানো দানব-মুখের দুই চোয়াল–ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল এমনই একটা বিকট নিনাদ যা নিরতিসীম শোকবিষণ্ণ–যে শব্দের তুলনীয় হাহাকার বিশ্বব্রহ্মান্ডে আর কোথাও কেউ শুনেছে বলে আমার জানা নেই।
ওই একখানা অপার্থিব হাহাকারই যেন গজাল ঠুকে বসিয়ে দিল আমার বিকল স্নায়ুমন্ডলীর গোড়ায়। জঙ্গলের আড়ালে তার দানব-দেহ বিলীন হতে না হতেই জ্ঞান হারিয়ে আমি লুটিয়ে পড়লাম মেঝের ওপর।
জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর প্রথমেই ভেবেছিলাম–যা দেখেছি, যা শুনেছি–সবই বলব বন্ধুকে। কিন্তু তারপর ঠিক করলাম–দরকার নেই।
দিন তিন চার পরে আরেক বিকালে জানালার ধারে একই চেয়ারে বসে ন্যাড়া পাহাড়ের দিকে চেয়েছিলাম আমি। পাশে আমার প্রিয় বন্ধু। পরিবেশ আর সময়ের প্রভাব আগল খুলে দিয়েছিল আমার মনের। বলেছিলাম, কী দেখেছি কি শুনেছি কদিন আগে। শুনে অট্টহাসি হেসেছিল বন্ধুবর। তারপর বড্ড বেশি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয় ভাবছিল, নির্ঘাৎ গোলমাল দেখা দিয়েছে আমায় মাথায়।
আর ঠিক তখনি ভয়াবহ সেই প্রাণীটাকে আবার দেখতে পেলাম ন্যাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে নিচের জঙ্গলের দিকে। ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিলাম। আঙুল তুলে বন্ধুকে দেখতে বলেছিলাম। সে কিছুই দেখতে পায়নি। শুধু আমিই দেখেছিলাম, একই রকম রক্ত জমানো গতিভঙ্গিমায় মূর্তিমান আতঙ্ক এগিয়ে চলেছে নিচের মহীরুহগুলোর দিকে।
কী ভয় যে পেয়েছিলাম, তা ভাষা দিয়ে লিখে বোঝাতে পারবো না। স্পষ্ট বুঝেছিলাম, বিকট বিভীষিকা পর-পর দুবার আমাকেই চেহারা দেখিয়ে গেল শুধু একটা আসন্ন ঘটনারই পূর্বাভাস দিতে। আমার মৃত্যুর আর দেরি নেই। অথবা বেঁচে থেকেও মরে যাওয়ার চাইতে বেশি যন্ত্রণা পাবো পাগল হয়ে গিয়ে। এ তারই দানবীয় সংকেত! এলিয়ে পড়েছিলাম চেয়ারে। দুহাতে মুখ ঢেকে ধরে করাল সংকেতকে আর দেখতে চাইনি। চোখ থেকে একটু পরে হাত সরিয়ে নেওয়ার পর তাকে আর দেখতেও পাইনি–বনতলে বিলীন হয়েছে অমঙ্গলের আগন্তুক।
আমার বন্ধু কিন্তু আরো শান্ত হয়ে গেল এই ঘটনার পর। খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল, বিকট জীবটাকে দেখতে কীরকম। হুবহু বর্ণনা দিয়েছিলাম। তারপর আমাকেই শুনতে হলো তান জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা। যার সারবত্তা এই : সব মানুষই এক জায়গায় ভুল করে বসে; দূরের জিনিসকে কাছে এনে আর কাছের জিনিসকে দূরে রেখে দেখার তফাৎ ধরতে পারে না। হয় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ধারণা করে নেয়-না হয় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বসে। বর্তমান গণতন্ত্রই তার প্রমাণ।
বলতে বলতে উঠে গিয়ে বুককেস থেকে একটা বই নামিয়ে এনেছিল বন্ধু। প্রাকৃতিক ইতিহাস-এর বই। পড়তে সুবিধে হবে বলে, এসে বসেছিল আমার চেয়ারে–আমাকে বসিয়েছিল ওর সোফায়। জানালার ধারে পড়ন্ত আলোয় বই খুলে ধরে প্রথমেই লেকচার দিয়েছিল এইভাবে : তোমার বিশদ বর্ণনা না শুনলে, দানবটা আসলে কী–তা কোনওদিনই আঁচ করতে পারতাম না। যাক সে কথা, আগে শোনো একটা পোকার শরীরের বর্ণনা। স্ফিংক্স প্রজাতির পোকা, ইনসেকটা শ্রেণির, লেপিডোপটেরা গোষ্ঠীর, ক্রিপসকিউলেরিয়া ফ্যামিলির এই পোকার কথা সব স্কুলের বইতেই আছে। শোনো :
চারটি ডানা ধাতু রঙের আঁশ দিয়ে ছাওয়া; চোয়াল লম্বা হয়ে গিয়ে অঁড়ের আকার নিয়েছে–মুখ আছে তার ডগায়; এর দুপাশে আছে ম্যানিবল আর প্যালপি-র দুটো অবশিষ্টাংশ; নিচের ডানার সঙ্গে ওপরের ডানা লেগে থাকে একটা লম্বা চুলের মাধ্যমে; অ্যান্টেনা দেখতে লম্বাটে গদার মতো–ঠিক যেন একটা প্রিজম্; উদর ছুঁচালো; বুকে আঁকা মড়ার খুলি দেখে আর করুণ কাতরানি শুনে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ ভয় পায়।
এই পর্যন্ত পড়ে, বই মুড়ে রেখে, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল বন্ধুবর–ঠিক যেভাবে যে কায়দায় বসে একটু আগে আমি দেখেছি লোমহর্ষক ভয়াবহকে।
সোল্লাসে বলল তারপরেই–এই তো…স্পষ্ট দেখছি…পাহাড় বেয়ে ফের উঠছে আশ্চর্য প্রাণী ঠিকই–তবে যতটা বড়ো আর যত দূরে আছে বলে মনে করেছিলে–কোনওটাই ঠিক নয়। জানালার কাঁচে ঝুলছে মাকড়সার জালের সুতো। সুতো ধরে ওপরে উঠছে। আমার চোখের কনীনিকা থেকে তার এখনকার দূরত্ব এক ইঞ্চির ষোলভাগের একভাগ; গোটা শরীরটাও লম্বায় এক ইঞ্চির ষোলোভাগের একভাগের বেশি নয়।
হানাবাড়ি
আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে বরিশাল শহর ছিল নিতান্তই একটি মফস্বল। শহরটিকে পাড়া গাঁয়ের একটু উঁচু সংস্করণ বলা যায়। শহরের শেষ মাথায় ছিল কেদার চাটুজ্যের পোডড়া ভিটে। এ গল্পের যখন শুরু তারও প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে চাটুজ্যে মারা গেছেন। তারপর থেকে ওই পোডড়া ভিটেতে কেউ বাস করার সাহস পায়নি। তখন অবশ্য এত ঘনবসতি ছিল না। শহরগুলোয় কাজেই বাড়ি ফাঁকা পেলেই সেখানে বসত গড়ার ফন্দিও কেউ করত না। আর কেদার চাটুজ্যের পোডড়া ভিটের ধারেকাছেও কেউ যেত না ভয়ে। কারণ লোকে বলত ওই বাড়িটি নাকি একটা হানাবাড়ি।