কিন্তু তা তো পারছিলাম না। রোজই লোক-গিজগিজ শহর থেকে গা কাঁপানো খবর পৌঁছাচ্ছিল কটেজে। চেনা জানাদের মধ্যে কেউ না কেউ পরলোক চলে যাচ্ছেন রোজই–এ খবর কানে শুনলে আর স্থির থাকা যায়? মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে প্রতিদিনই খবর পেতাম, একজন না একজন বন্ধু মায়া কাটাচ্ছেন।
এরপর থেকে খবর নিয়ে কাউকে আসতে দেখলেই শিউরে উঠতাম। দক্ষিণের বাতাসেই যেন মরণের বিষ ঢুকে বসে আছে। মৃত্যু ছাড়া আর কোন প্রসঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। মৃত্যু চিন্তায় আবিষ্ট হয়ে থাকতাম সর্বক্ষণ। এমন কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নও দেখতাম মরণকে।
আমার গৃহস্বামী আত্মীয়টি অবশ্য অন্য ধাচের মানুষ। আমার মতো সহজে উত্তেজিত হয়ে পড়তেন না। রোজ রোজ চেনাজানাদের চলে যাওয়ার খবর শুনতে শুনতে বেশ মুষড়ে পড়লেও ভেঙে পড়েননি। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যেই তিনি মেধাবী বলে নাম কিনেছিলেন–তাই বলে অবাস্তবতাকে পাত্তা দিতেন না। আতঙ্ক যখন কায়া গ্রহণ করত, তখন তিনি তার মোকাবিলা করার জন্যে কোমর বেঁধে লেগে যেতেন–কিন্তু বিচলিত হতেন না আতঙ্কের ছায়া দেখলে।
আমার গুম-মেরে-থাকা অবস্থাটা কাটিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টাই উনি। করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। পারবেন কী করে? ওঁকে না জানিয়ে ওঁরই। লাইব্রেরি থেকে এমন কয়েকখানা বই এনে রোজ পড়তাম–যা আমার মনের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা কুসংস্কারের বীজগুলোকে পরম পুষ্টি জুগিয়ে চলেছিল। দিনরাত এত উদ্ভট কল্পনায় বিভোর হয়ে থাকতাম সেই কারণেই। কারণটা উনি ধরতে পারেননি।
আমার বাতিক ছিল অনেক। তার মধ্যে একটার কথা বলা যাক। অশুভ ঘটনার পূর্বলক্ষণে আমি বিশ্বাস করতাম। এই সংকেত আসে আচমকা এবং তারপরে সত্যি সত্যিই তা ঘটে যায়। এই কটেজে আসার পর এইরকমই একটা অশুভ পূর্বলক্ষণ আমি দেখেছিলাম যুক্তি দিয়ে যার ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। ঘটনাটার মধ্যে ভাবী অমঙ্গলের স্পষ্ট ইঙ্গিত লক্ষ্য করেছিলাম বলে তাকে ভিত্তিহীন কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতে পারিনি। ভয়ে কাঁটা হয়ে। থাকতাম সর্বক্ষণ; মাথার মধ্যেও যেন সব ঘোঁট পাকিয়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা নিয়ে অষ্টপ্রহর থ হয়ে থাকতাম বলে আত্মীয় বন্ধুকে এ বিষয়ে বলার মুরোদও হয়নি।
সেদিন খুব গরম পড়েছিল। বিকেল নাগাদ কোলের ওপর একটা বই রেখে খোলা জানালা দিয়ে দেখছিলাম দূরের পাহাড়। নদীর পাড়ের ওপারে এই পাহাড়ের গায়ে ধস নামার ফলেই বোধহয় গাছপালার বালাই আর নেই। একদম ন্যাড়া হয়ে রয়েছে। বইয়ের পাতায় চোখ রেখেও আমি ভাবছিলাম শহরের কথা-মৃত্যুরাজ সেখানে রোজই নৃত্য করে চলেছেন–মন থেকে তা কিছুতেই তাড়াতে পারছিলাম না। তাই চোখ উঠে গিয়েছিল বইয়ের পাতা থেকে–দৃষ্টি মেলে ধরেছিল নদীর পাড়ের ওপর দিয়ে দূরের নগ্ন পাহাড়ের দিকে।
কদাকার চেহারার একটা জীবন্ত দৈত্যকে দেখতে পেয়েছিলাম ঠিক সেই সময়ে। পাহাড় চুড়া থেকে সরসরিয়ে নেমে এসে নিচের ঘন জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল মিনিট কয়েকের মধ্যে।
বিকট সেই জীবকে প্রথমে দেখেই ভেবেছিলাম বুঝি পাগল হয়ে গেছি নির্ঘাৎ। অথবা চোখের গন্ডগোল হয়েছে–ভুল দেখছি নিশ্চয়।
বেশ কয়েক মিনিট ঠায় সজীব আতঙ্ককে নজরে রাখার পর বিশ্বাস ফিরে এসেছিল চোখ আর মাথার সুস্থতায়। আমি পাগলও হইনি, দৃষ্টিবিভ্রমেও ভুগছি না। যা দেখছি সত্যি। কুৎসিত সেই দানবের বর্ণনা শোনবার পর পাঠক অবশ্য আমাকে পাগলই বলবেন–অথবা বলবেন স্বপ্ন দেখেছি নিশ্চয়। অথচ বিকটাকারকে অনেকক্ষণ ধরে ধীরস্থির শান্তভাবেই চোখে চোখে রেখেছিলাম–উত্তেজনাকে প্রশ্রয় দিইনি। সুতরাং ভুল দেখার প্রশ্নই ওঠে না।
জঙ্গলের সব গাছ তো ধস নামার ফলে ধ্বংস হয়নি-কয়েকটা মহীরুহ মাথা তুলে ছিল রাজার মতোই। এদের পাশ দিয়ে চলমান দুঃস্বপ্ন অদৃশ্য হয়েছিল বলেই তার সাইজটা আন্দাজ করে নিতে পেরেছিলাম। সমুদ্রের সবচেয়ে বড়ো জাহাজের চেয়েও অনেক বড়ো তার কলেবর। জাহাজের উপমা দেওয়ার কারণ আছে। জাহাজের খোলের সঙ্গে অনায়াসেই তুলনা করা যায় সেই ভয়ঙ্করকে। তার মুখখানা বসানো রয়েছে ষাট সত্তর ফুট লম্বা একটা শুড়ের ডগায় হাতির শরীর যত মোটা, গুঁড়ের ব্যাসও তাই। শুড়ের গোড়ায় থুথুক করছে বিস্তর কালো চুল–এক কুড়ি মোষের গা থেকেও অত কালো লোম পাওয়া যায় না। লোমশ অঞ্চল থেকে ঠেলে বেরিয়ে এসে মাটি মুখো হয়ে রয়েছে দুটো প্রকাণ্ড দাঁত-বুনো শুয়োরের দাঁতের চেয়েও অনেক বড়ো আর নৃশংস। পড়ন্ত রোদ ঠিকরে যাচ্ছিল এই গজাল দাঁত থেকে। প্রকাণ্ড অঁড়ের সমান্তরালে সামনের দিকে এগিয়ে রয়েছে ঝকঝকে, স্বচ্ছ কৃস্টাল দিয়ে তৈরি দুটো অদ্ভুত জিনিস; রয়েছে সঁড়ের দুপাশে–ঠিক যেন দুটো প্রিজম–খাঁটি কৃস্টাল দিয়ে তৈরি। লম্বায় প্রতিটা তিরিশ থেকে চল্লিশ ফুট। পড়ন্ত রোদ তা থেকে ঠিকরে এসে এত দূরেও চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে আমার। ধড়খানা তৈরি হয়েছে গোঁজের মতো। গোঁজের মাথা রয়েছে মাটির দিকে। দুপাশ দিয়ে বেরিয়েছে দুজোড়া ডানা। রয়েছে ওপর-ওপর। ধাতুর আঁশ দিয়ে ছাওয়া প্রতিটা ডানা। প্রতিটা আঁশের ব্যাস দশ থেকে বারো ফুট। শক্ত শেকল দিয়ে আটকানো রয়েছে ওপরের আর নিচের ডানা।