তীব্র কর্তব্যবোধ শেষ পর্যন্ত মাথা চাড়া দিল মনের মধ্যে। বেশ বুঝলাম, রোয়ানা মারা যায়নি। এখনো বেঁচে আছে। এখুনি কিছু উপাসনার দরকার। কিন্তু-চাকর-বাকরেরা থাকে মঠের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, আমার ডাক সেখানে পৌঁছোবে না। উঠে গিয়েও তাদের ডেকে আনতে সাহস পেলাম না।
তাই একাই সূক্ষ্মদেহী রোয়ানার আত্মাকে আহ্বান জানালাম, সে তো এখনো যায়নি, আছে আমার কাছেই, আকুল আহ্বান জানালাম দেহপিঞ্জরে ফের ফিরে আসতে। কিন্তু দেখতে দেখতে রক্তাভা মিলিয়ে গেল চোখের পাতা আর গালের চামড়া থেকে। আবার মৃত্যুর ভয়াবহতা প্রকট হলো চোখে মুখে। আবার মার্বেল-সাদা হয়ে গেল মুখখানা, দাঁতের ওপর চেপে বসল নিরক্ত অধরোষ্ঠ। তুহিনকঠিন দেহের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেঁপে উঠলাম থরথর করে, এলিয়ে পড়লাম কেদারায় এবং আবার তন্ময় হয়ে গেলাম লিজিয়ার কামনাতপ্ত স্মৃতি-জাগরণে।
এক ঘণ্টা পর আবার অস্পষ্ট শব্দ শুনলাম। শয্যার দিক থেকে এসেছে। শব্দটা। নিঃসীম আতঙ্কে উৎকর্ণ হয়ে রাইলাম। এবার আর ভুল হলো না। স্পষ্ট শুনলাম, কে যেন পাজর খালি করা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছুটে গেলাম মড়ার পাশে। দেখলাম-স্পষ্ট দেখলাম, ঠোঁটটা থিরথির করে কাঁপছে।
এক মিনিট পরেই কিন্তু শিথিল হয়ে গেল অধরোষ্ঠ, ফাঁক দিয়ে দেখা গেল মুক্তাদাঁতের ঝকঝকে সারি। এবার আতঙ্কে চোখ আমার ঝাপসা হয়ে এল। ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেল। অতি কষ্টে সামলে রাখলাম নিজেকে। কর্তব্য করতেই হবে-ভয় পেলে চলবে না।
এবার প্রাণের হালকা আভা প্রকাশ পেল ললাটে, গালে, গলায়। উষ্ণতায় আচ্ছন্ন হলো সারা দেহ। এমন কি মৃদু মৃদু স্পন্দিত হলো বক্ষদেশও।
বেঁচে আছে! বেঁচে আছে! লেডি বেঁচে আছে! দ্বিগুণ উৎসাহে ওকে পুরোপুরি সজীব করার জন্যে হাত-পা-রগ ঘষতে লাগলাম। ডাক্তারি জানি না, আনাড়ীর মতোই করে গেলাম। কিন্তু বৃথা হলো প্রচেষ্টা।
আচম্বিতে অদৃশ্য হলো রক্তিমাভা, স্তব্ধ হলো বক্ষস্পন্দন, দাঁতের ওপর আড়ষ্ট হয়ে গেল অধরোষ্ঠ। মুহূর্তের মধ্যে আবার মড়ার মতোই কঠিন, শীতল, বীভৎস হয়ে উঠল দেহের প্রতিটি রেখা, সমাধি মন্দিরে ছাড়া অন্যত্র যার স্থান নেই।
আবার নিমগ্ন হলাম লিজিয়ার ধ্যানে। আবার ফোঁপানি শুনলাম আবলুস শয্যার দিক থেকে।
রাত তখন ফুরিয়ে এসেছে। আগের চাইতেও স্পষ্টভাবে নড়ে উঠল নিষ্প্রাণ দেহটা। আমি কিন্তু নড়লাম না, উদাত আবেগের টুটি টিপে ধরে অতি কষ্টে বসে রইলাম কেদারায়। আগের মতোই রঙের ছোঁয়া লাগল কপোলে, কপালে। উষ্ণতায় চঞ্চল হলো সারা দেহ, স্পন্দিত হলো বক্ষদেশ, কম্পিত হলো চক্ষুপল্লব। তবুও আমি নড়লাম না।
রোয়ানার শরীরে তখনো কফিনের সাজ, ব্যান্ডেজ এবং অন্যান্য বস্ত্র। কফিন-সজ্জা না থাকলে রোয়েনাকে জীবন্তই বলা যেত। কিন্তু অচিরেই আমার মনের সব দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে এল দেহটা। খলিত চরণে টলতে টলতে দু হাত সামনে বাড়িয়ে যেন স্বপ্নের ঘোরে ঘরের ঠিক মাঝখানে এসে পৌঁছোলো চাদরমোড়া নারীমূর্তি। তবুও আমি নড়লাম না, শিউরে উঠলাম না। কারণ, অনেকগুলো অবর্ণনীয় কল্পনা যুগপৎ আছড়ে পড়ল আমার মস্তিষ্কে। চলমান মূর্তির চালচলন, দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা যেন অসাড় করে দিল আমার মগজ।
আমি পাথর হয়ে গেলাম। একচুলও না নড়ে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইলাম প্রেমূর্তির দিকে। কে এই শরীরী রহস্য? রোয়ানা? কিন্তু এ সন্দেহ কেন আসছে মাথার মধ্যে?
শুভ্রকেশী নীলনয়না রোয়ানা নয় আগুয়ান ঐ নারী মূর্তি, এমন উদ্ভট ধারণা কেন পীড়িত করছে আমার মস্তিষ্ক? মুখের ওপর ব্যান্ডেজের পটি আছে ঠিকই, কিন্তু সঘন নিঃশ্বাসে প্রাণময় ও-মুখ লেডী রোয়ানার না হয়ে অন্যের হতে যাবে কেন? রক্তিম ঐ কপোল তো রোয়ানারই, জীবনের মধ্যাহ্নে প্রাণ সূর্যের আলোক ছিল যেভাবে, ঠিক সেইভাবে গোলাপি ও গাল রোয়ানার ছাড়া আর কারো নয়। ঐ চিবুক, ঐ টোলও নিশ্চয় রোয়ানার। কিন্তু…কিন্তু…অসুখে ভুগে কি মাথায় লম্বা হয়ে গিয়েছে রোয়ানা? একি উন্মত্ত চিন্তা পেয়ে বসেছে আমাকে? ক্ষিপ্তের মতো ধেয়ে গেলাম, ছিটকে পড়লাম তার পায়ের ওপর।
আমার ছোঁয়া পেতেই মাথা থেকে কদর্য কফিন-সজ্জা খুলে ফেলে দিল সে, ব্যান্ডেজের আড়াল থেকে মেঘের মতো পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়ল একরাশ চুল, সে চুল মধ্যরাতের দাঁড়কাকের ডানার চেয়েও কুচকুচে কালো!
তারপর ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল শরীরী রহস্য।
বুকফাটা হাহাকার করে উঠলাম আমি–এবার চিনেছি…চিনেছি তোমায়…কৃষ্ণকালো বড়ো বড়ো এ চোখ যে আমার হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সী ..লেডি লিজিয়ার!
স্ফিংক্স
নিউইয়র্কে যখন ভয়াবহ কলেরার মড়ক চলছে, তখন আমার এক আত্মীয়ের নেমন্তন্ন রাখতে তাঁর বাড়ি গিয়ে দিন পনেরো কাটিয়ে এসেছিলাম। বাড়িটা কটেজ প্যাটার্নের। হাডসন নদীর পাড়ে।
গ্রীষ্মবকাশ কাটানোর সমস্ত আয়োজনই মজুদ ছিল সে অঞ্চলে। ইচ্ছেও ছিল হেসেখেলে ছুটির দিনগুলো কাটিয়ে দেবো। চারপাশের জঙ্গল দেখা, বসে বসে ছবি আঁকা, নৌকা নিয়ে অভিযানে বেরোনো, ছিপ ফেলে মাছ ধরা, সাঁতার কাটা, গান গাওয়া আর বই পড়া–গ্রীষ্মবকাশ পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে যেত এতগুলো মজার মধ্যে থাকলে।