অসুখটা। মাঝে মাঝে ছেড়ে যায়, আবার এসে তেড়ে ধরে। ক্রমশ কমে আসতে লাগল প্রাণশক্তি, বৃদ্ধি পেল স্মায়বিক বিকার। সেই অপচ্ছায়ার নড়াচড়া নাকি আবার দেখতে পাচ্ছে-শুনতে পাচ্ছে অদ্ভুত শব্দ। দেওয়ালজোড়া ফ্যানট্যাসটিক পর্দার আড়াল থেকেই এ শব্দ শোনা যায়, সৎ করে ছায়ামূর্তি মিলিয়ে যায় পর্দার বুকে।
একদিন রাতে ওর এই অস্বস্তির কথা নিয়ে আমাকে আরো চেপে ধরল রোয়ানা। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চমকে উঠছিল। আমি উদ্বিগ্ন চোখে দেখছিলাম বিশীর্ণ মুখের ভাবতরঙ্গ। পালঙ্কের পাশে রাখা আবলুস কাঠের কেদারায় বসেছিলাম আমি। ঘুম ভাঙল রোয়ানার। কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে বলল, শব্দটা নাকি আবার শোনা যাচ্ছে। আমি কিন্তু কিছু শুনলাম না। বলল, অপচ্ছায়াকে আবার দেখা যাচ্ছে, আমি কিন্তু কাউকে দেখলাম না। হাওয়ায় পর্দা দুলছিল। ভাবলাম, ওকে বুঝিয়ে বলি, প্রায় অশ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দ পর্দার খসখসানি ছাড়া কিছু নয়। পর্দার বিমঘুঁটে মূর্তিগুলো দুলে দুলে উঠছে বলে মনে হচ্ছে, কে যেন সরে যাচ্ছে পর্দার আড়ালে।
রোয়ানার মুখ কিন্তু নিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। মানুষ মরে গেলে মুখ যে রকম সাদা হয়ে যায়, রোয়ানার মুখের অবস্থা তখন তাই। মনে হলো, এই বুঝি জ্ঞান হারাবে। কাছাকাছি চাকর-বাকর নেই যে ডাকব। মনে পড়ল, হঠাৎ দরকারের জন্যে ঘরের মধ্যেই এক বোতল মদ রেখে গিয়েছিলেন ডাক্তার। তাই দৌড়ে গেলাম ঘরের অপর প্রান্তে সুরার আধার আনতে। মাথা ওপর ঝুলন্ত সোনার গন্ধপাত্রের তলা দিয়ে যাওয়ার সময়ে একই সময়ে দুটো বিচিত্র অনুভূতি সাড়া জাগিয়ে গেল আমার লোমকূপে।
স্পষ্ট মনে হলো কে যেন আলতো করে আমার গা ঘষটে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, ধুনুচির তলায় আলোকবলয়ের মধ্যে স্বর্গের পরীর মতো একটা আবছা অস্পষ্ট ছায়া। ছায়ার ছায়া যদি কিছু থাকে-দ্যুতিময় সেই ছায়াটা যেন তাই।
কিন্তু আমি নিজে তখন আফিমের ঘোরে, তাই এ সব কথা রোয়ানাকে না বলাই সমীচীন মনে করলাম। মদিরাপত্ৰ এনে পেয়ালায় ঢেলে তুলে ধরলাম ওর ঠোঁটের কাছে। তখন অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে রোয়ানা। মদিরার পেয়ালা আমার হাত থেকে নিয়ে ধরল ঠোঁটের কাছে।
আমি বসলাম আবলুস কাঠের আরামকেদারায়। চোখ রইল রোয়ানার ওপর। ঠিক এই সময়ে আমার সর্বসত্তা দিয়ে অনুভব করলাম আবার সেই মায়াস্পর্শ। স্পষ্ট শুনতে পেলাম, কে যেন লঘু চরণে হেঁটে এল কার্পেটের ওপর দিয়ে, এগিয়ে গেল কেদারার পাশ দিয়ে। ঠিক তখনি পেয়ালাটা উঁচু করে ধরেছে রোয়ানা। আমার চোখের ভুল কিনা জানি না, কিন্তু বেশ দেখলাম যেন শূন্যমার্গের কোন নিঝরিণী উৎস থেকে সহসা আর্বিভূত হলো চার-পাঁচটা টলটলে চূণীর মতো অত্যুজ্জ্বল তরল বিন্দু এবং টপটপ করে খসে পড়ল পেয়ালার সুরায়।
রোয়ানা কিছু দেখল না। এক চুমুকে পাত্র নিঃশেষ করে ফিরিয়ে দিল আমার হাতে। আমি ভাবলাম, দেখেছি তা আফিমের প্রভাবে দেখেছি। রাত্রি নিশীথে আতঙ্কিত স্ত্রীকে সামনে রেখে নিজেই ইন্দ্রজাল দর্শন করছি।
একটা ব্যাপার কিন্তু আমার মনের কাছে গোপন করতে পারলাম না। রুবীর ফোঁটা সুরার মধ্যে ঝড়ে পড়ার পর থেকেই আরো খারাপ হলো স্ত্রীর শরীর। তৃতীয়রাতে দাসীরা তাকে কবরে শোয়ার পোশাক পরিয়ে দিল। চতুর্থ রাতে তার চাদর ঢাকা প্রাণহীন দেহ সামনে নিয়ে পাথরের মতো বসে রইলাম।
অদ্ভুত সেই কক্ষে অনেক উদ্ভট দৃশ্য যেন আফিমের ঘোরে ছায়ার মতো কল্পনায় ভেসে গেল। ঘরের পাঁচ কোণে রাখা পাঁচটি শবাধারের পানে চাইলাম অশান্ত চোখে। দেখলাম, দুলন্ত পর্দার গায়ে কিম্ভুতকিমাকার মূর্তিগুলোর নড়াচড়া, মাথার ওপরে ধুনুচি ঘিরে সর্পিল আগুনের কুণ্ডুলী। সেখান থেকে দৃষ্টি নেমে এল তলায়, মেঝের ওপরে। দুরাত আগে যেখানে দেখেছিলাম অপার্থিব এক জ্যোতির্ময় ছায়ার অস্পষ্ট আদল। কিন্তু এখন সে স্থান শূন্য। এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে দেখছিলাম, এবার স্বচ্ছন্দ হয়ে এল শ্বাস-প্রশ্বাস।
সহজভাবে তাকালাম শয্যায় শায়িতা পাণ্ডুর আড়ষ্ট দেহের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে লিজিয়ার স্মৃতি ভিড় করে এল মনের মধ্যে। মনে পড়ল, এমনিভাবে আর এক রাতে তার প্রাণহীন দেহ সামনে নিয়ে নিথরভাবে বসে থেকেছি আমি। মনে পড়ল হাজার হাজার মিষ্টি মধুর বেদনাবিধুর ঘটনা। রাত বয়ে চলল। তিক্ত স্মৃতিভারে তন্ময় হয়ে গেলাম-লিজিয়ার ধ্যানে বিশ্বসংসার বিস্মৃত হলাম।
মাঝরাত নাগাদ একটা চাপা, হ্রস্ব, মধুর, কিন্তু স্পষ্ট ফোঁপানির শব্দে সম্বিত ফিরে এলো। সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করলাম, শব্দটা এসেছে আবলুস কেদারা থেকে। কুসংস্কারের আতঙ্ক পেয়ে বসল আমায়, উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। কিন্তু মৃত্যু কেদারা থেকে আর কেউ ফুঁপিয়ে উঠল না। আড়ষ্ট হয়ে চাইলাম নিষ্প্রাণ দেহের দিকে, কিন্তু নিস্পন্দ দেহে সামান্যতম চাঞ্চল্যও দেখতে পেলাম না।
কিন্তু আমার ভুল হয় নি। যতক্ষণই হোক না কেন, ফোঁপানির শব্দ আমি ঠিকই শুনেছি বলেই ধ্যান থেকে জেগে উঠেছি। তাই মনটা শক্ত করে নিমেষহীন চোখে চেয়ে রইলাম মৃত স্ত্রীর পানে।
অনেকগুলো মিনিট কাটল বিনা ঘটনায়। তারপর শুরু হলো আর এক। অলৌকিক রহস্যের খেলা। ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে এল দুই গাল। খুব আবছা হলেও রক্তাভা চোখ এড়ালো না আমার, সেই সঙ্গে দেখলাম রক্তের খেলা বসে যাওয়া চোখের পাতায়। হাত-পা অবশ হয়ে এল আমার সেই অসম্ভব দৃশ্য দেখে। মনে হলো, এই বুঝি স্তব্ধ হয়ে যাবে হৃৎপিণ্ড।