এই তার শেষ কথা। মারা গেল লিজিয়া। শোকে দুঃখে মুষড়ে পড়লাম আমি। নিঃসঙ্গ পুরীতে থাকতে পারলাম না। ঐশ্বর্য বলতে যা বোঝায়, আমার তার অভাব ছিল না। নশ্বর মানুষ যে সম্পদ কল্পনাও করতে পারে না, আমার তা ছিল। সম্পত্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল লিজিয়াকে বিয়ে করার পর। তাই মাস কয়েক পরে ঘরছাড়া দিকহারা হয়ে দেশভ্রমণের পর একটা পুরোনো মঠ কিনলাম ইংল্যান্ডের মাটিতে। বিষাদাচ্ছন্ন মঠ। আসবাসপত্রে অনেক স্মৃতি, অনেক ব্যথা, অনেক ইতিহাস বিজড়িত। আমার নিঃসঙ্গ শোকবিধুর মনের উপযোগী পরিবেশ।
ভাঙা মঠের বাইরেটা ভাঙাই রইল, মেরামত করলাম না। কিন্তু ভেতরটা সাজালাম রুচিসুন্দরভাবে দামি দামি জিনিস দিয়ে। আমার তখন মাথার ঠিক নেই। ছেলেমানুষী উন্মাদনায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। মহার্ঘ আসবাসপত্র দিয়ে ঘরসজ্জা আমার চিরকালের বাতিক। নিরালা অঞ্চলের সেই ভাঙা মঠের অভ্যন্তরেও তাই নিয়ে এলাম স্বর্ণখচিত গালিচা, মিশরীয় কারুকার্য, জমকালো পর্দা। শোকাচ্ছন্ন হয়েও আফিমের ঘোরে আমি দিনকয়েক মত্ত রইলাম গৃহ সজ্জা নিয়ে। তারপর একদিন শুভ্রকেশী নীল নয়না লেডি রোয়েনাকে বধূবেশে নিয়ে এলাম সেই বাসভবনে অবিস্মরণীয় লিজিয়ার শূন্য সেই সিংহাসনে বসাতে।
কনে বউয়ের জন্যে যে ঘরটি সাজিয়ে ছিলাম, তার বর্ণনা দিচ্ছি এবার। ঘরটা মঠের শীর্ষদেশে, বুরুজের তলায়। পাঁচকোনা ঘর। দক্ষিণ দিকের দেওয়াল জোড়া একটা জানলা। ভেনিস থেকে আমদানি করা প্রকাণ্ড এক খানা রঙিন কাঁচ বসানো জানলায়। সূর্যলোক অথবা চন্দ্রকিরণ সেই কাঁচের মধ্য দিয়ে ভৌতিক প্রভা দিয়ে লুটিয়ে পড়ে ঘরের আসবাবপত্র। বিশাল জানালার ওপরে একটা প্রাচীন আঙুরলতা শ্যাওলা ধরা বুরুজ বেয়ে উঠে গেছে ওপরে। ওক কাঠের কড়িকাঠ অনেক উঁচু। খিলানের আকারে তৈরি। কাঠের গায়ে বহু পুরোনো কিম্ভুতকিমাকার আধা গথিক কারুকাজ। বিষণ্ণ কড়িকাঠের মাঝখানের খিলান থেকে সোনার চেনে ঝুলত একটা সোনার ধুনুচি। সারাসেনিক প্যাটার্নে তৈরি গন্ধ পাত্র। সর্পিল রেখায় অবিরাম বর্ণবিচিত্র অগ্নিশিখা লেলিহান রসনা মেলে ধরত কারুকার্য পরিবৃত রন্ধপথে।
বেশ কয়েকটি তুর্কী পালঙ্ক আর সোনালি শামদান সাজানো ঘরের নানা স্থানে। ভারতবর্ষ থেকে আনিয়েছিলাম নিরেট আবলুস কাঠে নির্মিত নতুন বউয়ের আরামকেদারা, মাথার ওপর ছত্রাকার চন্দ্রাতপ। পাঁচকোণে বসানো পাঁচটা সমাধি-সিন্দুক, ঘন কালো আগ্নেয়শিলা খুদে তৈরি। ডালার ওপর সুপ্রাচীন ভাস্কর্য, সিন্দুকগুলি সংগ্রহ করেছি রাজারাজড়ার সমাধি-মন্দির থেকে। সবচেয়ে জবর ফ্যানটাসি কিন্তু দেওয়াল জোড়া পর্দায়। দানবিক দেওয়ালের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত ঝুলছে মহার্ঘ বস্ত্রাবরণ, যা গালিচার মতো পুরু, তুর্কী পালঙ্কের চাদরের মতো চিত্র-বিচিত্র, জানালার পর্দার মতো জমকালো। সোনার কাপড় দিয়ে তৈরি এই বস্ত্রাবরণের দাম শুনলে স্মম্ভিত হতে হবে। কুচকুচে কালো কাপড়ের ওপর স্বর্ণচিত্র, ব্যাস এক ফুট, সমান ব্যবধানে আরব্য ইমারতের উদ্ভট নকশা।
ঘরে ঢুকলে প্রথমে নকশাগুলোকে আরব্যদেশীয় মনে হবে। আরো এগোলে নকশার চেহারা পালটে যাবে, যেন বিরাটকায় দানবদল কিম্ভুতকিমাকার ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। পায়ে পায়ে ঘরের মাঝে এলে দানবদলও অদৃশ্য হবে রোমাঞ্চকর পর্দার বুক থেকে। তখন ডানে বাঁয়ে সামনে পেছনে কেবল দুলবে কুসংস্কারের ছায়ামূর্তি। অন্তহীন বিদঘুঁটে মূর্তিগুলোকে মনে হবে মুখ ঢাকা সন্ন্যাসীর দল, নির্নিমেষে নিরীক্ষণ করছে। ঘরের প্রাণীদের। কৃত্রিম উপায়ে হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে পর্দার পেছনে। তাতে বৃদ্ধি পেয়েছে গা-শিউরোনো অনুভূতি। হাওয়ায় অবিরাম দুলতে থাকে ভারি পর্দা-অলীক কাহিনির বিচিত্র অপচ্ছায়ার মতো মঠবাসীদের কল্পিত আকারগুলিকে মনে হয় সজীব। গায়ে রোমাঞ্চ জাগে সেই দৃশ্য দেখলে, শিরশির করে শিড়দাঁড়া।
বিয়ের প্রথম মাসটা এহেন ঘরেই কাটল। খুব একটা অশান্তি হলো না। নতুন বউ আমার থমথমে মুখ দেখে ভয় পেত, আমার আত্মনিমগ্ন রূপ দেখে দূরে সরে যেত। আমাকে সে ভালোবাসতে পারেনি, তাতে আমি খুশিই হয়েছি। নিজের মনের অতলে ডুব দিয়ে দিবারাত্র ধ্যান করতাম লিজিয়াকে যে লিজিয়া আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।
চিরবিদায় নিয়েছে বলেই তার রূপ আমার মধ্যে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, তার প্রতি আমার আকর্ষণ আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমার আফিমের নেশা ছিল। নেশার ঘোরে স্বপন দেখতাম লিজিয়াকে। কল্পনা করতাম, আহারে, আবার যদি ওকে ফিরিয়ে আনা যেত এই মাটির পৃথিবীতে!
বিয়ের দ্বিতীয় মাসে হঠাৎ অসুস্থ হলো লেডী রোয়েনা। রোগমুক্তি ঘটতে সময় লাগল। ব্যাধির প্রকোপেই বোধ হয় প্রায়ই অনুযোগ করত ঘরের মধ্যে অদ্ভুত পদশব্দের। ছায়া নড়ছে, অদ্ভুত আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। চোখের ভুল কানের ভুল বলে উড়িয়ে দিতাম। স্নায়ু দুর্বল হলে এ-রকম ইন্দ্রজাল অনুভব করে অনেকেই।
বেশ কিছুদিন পরে আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠল রোয়ানা। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার শয্যাশায়ী হলো। এবার কিন্তু রোগ সারবার লক্ষণ দেখা গেল না। ভয় পেলাম ওর অবস্থা দেখে। শুকিয়ে যেতে লাগল দিনের পর দিন, যেন মিশে গেল বিছানার সাথে। ডাক্তাররাও ধরতে পারল না