তারপর থেকে চলে একের-পর-এক রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড। আর তার সাথে সাত নম্বর ঘরটায় রক্তের স্রোত বয়ে চলে। দুর্গের সবাই মৃত্যুভয়ে দিশেহারা হয়ে ওঠে। এই ভয়ংকর রক্তাক্ত মৃত্যুর থেকে বাঁচার জন্য সবাই মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু পালানোর কোনো পথই নেই ওদের। এইভাবে একের-পর-এক মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে, তার সাথে দুৰ্গটা জনশূন্য হয়ে পড়ে। আবলুস কাঠের অদ্ভুত ঘড়িটা স্তব্ধ হয়ে যায়, বাইরের বারান্দায় রাখা জ্বলন্ত অঙ্গারগুলো নিভে যায়, মানুষহীন দুর্গ জুড়ে একটা রহস্যময় গভীর অন্ধকার নেমে আসে। শুধু এই দুৰ্গটার মধ্যে বেঁচে থাকে একরাশ অন্ধকার আর মৃত্যু। রক্তাক্ত মৃত্যু তার আধিপত্য বিস্তার করে বেঁচে থাকে এই রহস্যময় দুর্গের মধ্যে। আর তার অভিশপ্ত ব্যাধির বিস্তার ঘটে।
লিজিয়ার মৃত্যু
লেডি লিজিয়ার সঙ্গে কবে, কীভাবে, কোথায় আমার প্রথম পরিচয় ঘটেছিল, আমার কিছুই মনে নেই। তারপর অনেক বছর গেছে, অনেক কষ্ট পেয়েছি, স্মৃতি দুর্বল হয়ে এসেছে। অথবা লিজিয়ার দুৰ্জ্জেয় চরিত্রের সবটুকু আমি ধরতে পারিনি বলেই সব কথা মনে করতে অক্ষম।
লিজিয়া! লিজিয়া! লিজিয়া! শুধু এই নামটি মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করলেই মনের চোখে ভেসে উঠে অতুলনীয় একটি রূপ-ইহ লোকের মায়া যে অনেক আগেই ত্যাগ করেছে। লিজিয়া! লিখতে বসে মনে পড়ছে, সে এসেছিল আমার বান্ধবীরূপে, তারপর বাগদান করে সহায় হয়েছিল আমার পড়াশুনায়। সবশেষে বরণ করেছিল আমাকে স্বামীত্বে।
সব ভুলেছি, ভুলিনি কেবল লিজিয়ার অসামান্য রূপ। দীর্ঘাঙ্গী, কৃশকায়া। চলাফেরা করত হাল্কা চরণে। পড়ার ঘরে ঢুকত লঘুপায়ে ছায়ার মতো, টের পেতাম না। সঙ্গীতের মতো নরম মিষ্ট কণ্ঠে কথা বললে চমক ভাঙত, রোমাঞ্চিত হতাম কাঁধের ওপর মর্মর হাতের স্পর্শে।
লর্ড ভেরুলাম বলেছেন, প্রকৃত রূপ চিনেও চেনা যায় না। সে রূপের মধ্যে এমন অদ্ভুত কিছু থাকে, যা আমাদের অজ্ঞাত, ব্যাখ্যার অতীত। লিজিয়ার মধ্যে আমি এই অজানা বৈশিষ্ট লক্ষ্য করেছি, কিন্তু খুঁজে পাইনি কেন সে এত শ্রীমতী।
রূপ সম্বন্ধে আমাদের চিরকালের যে সংজ্ঞা, লিজিয়ার রূপ সেই বাঁধাধরা ফরমুলায় পড়ে না। তবুও সে অলোকসামান্য কেন? ললাট নিখুঁত, হাতির দাঁতের মতো সাদা গায়ের চামড়া, দাঁড়কাকের মতো কুচকুচে কালো একরাশ ঢেউ খেলানো চুল। নাকের গড়ন টিকোলো। হিব্র সুন্দরীদের হার মানা মিষ্টি মুখটি স্বর্গীয় সুধায় রমণীয়। ওষ্ঠের তুলনায় অধর ঈষৎ পুষ্ট, গালের টোল যেন নিজেই মুখর হতে চায়, হাসলেই দেবলোকের বিমল রশ্মিরেখায় যেন ঝলমল করে উঠে পরিপাটি দাঁতের সারি।
সবচেয়ে আশ্চর্য ওর চোখ। ইতিহাস-প্রসিদ্ধ ডাকসাইটে সুন্দরীদের নয়নের মতো নয়, কোনো তুলনাই চলে না। লর্ড ভেরুলাম সৌন্দর্য রহস্যের ব্যাখ্যা করতে যা বলেছেন, অজানা সেই রহস্য বুঝি বিধৃত ওর আকাশ সমান আঁখির মধ্যে। সাধারণ সুন্দরীদের চেয়ে বড়ো চোখ, উজ্জ্বল তারকার মতো প্রদীপ্ত। উত্তেজিত হলেই ভাস্বর হয়ে ওঠে তুলনাহীন এই প্রত্যঙ্গ দুটি। বিচ্ছুরিত হয় অপার্থিব সৌন্দর্য। তখন তা বন্য তাতার সুন্দরীদের চোখের মতোই দুস্তর ঝলমলে। চোখের মণি দুটোয় কালো হীরের দীপ্তি। বড়ো বড়ো চক্ষু পল্লব। বঙ্কিম ভুরু দুটিও কুচকুচে কালো। অদ্ভুত সৌন্দর্যটা কিন্তু চোখের রঙ, দীপ্তি বা গঠন সুষমায় নয়–এ রহস্য ওর চোখের চাহনিতে। কেন ওর চোখের ভাব এত এত রহস্যময়! এত মোহময়! কিছুতেই তল পাইনি নিতর। সেই চাহনির। আমার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দূর আকাশের যুগল নক্ষত্রর মতো অম্লান থেকেছে ওর সৌন্দর্যের আকর যুগল নয়ন। পূজা করেছি সেই নক্ষত্র দুটিকে, জ্যোতির্বিদের মতো অন্বেষণ করেছি নক্ষত্রের স্বরুপ-ব্যর্থ হয়েছি।
আশ্চর্যসুন্দর রহস্যময় এই নক্ষত্রসম চোখ দুটির দ্যুতিও কিন্তু ক্রমে ক্রমে ম্লান হয়ে এল। অসুস্থ হলো লিজিয়া। বন্যচোখ দুটিতে আর সে আভা ফুটল না, বিশীর্ণ আঙুলগুলি মোমের আঙুলের মতো রক্তহীন হয়ে এল। সামান্যতম আবেগেই স্পষ্ট হলো শুভ্র ললাটের নীল শিরা। বুঝতে পারছি, সময় ফুরিয়ে আসছে লিজিয়ার, আমি প্রাণপণে লড়তে লাগলাম মনের সঙ্গে। লড়তে লাগল লিজিয়াও। জীবনের প্রতি অসীম মায়া, জাগতিক সংসারের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ, বেঁচে থাকার তীব্র বাসনা বিমূর্ত হলো ওর মৃদু কণ্ঠস্বরে। ওর সেই অবস্থায় সান্ত্বনার কোনো ভাষা আমি পাইনি।
লিজিয়া আমায় ভালোবাসত। বুক দিয়ে ভালোবাসত। ওর ভালোবাসার গভীরতা সমস্ত অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছি ওর চিরবিদায়ের পর। মৃত্যুর আগে ধীর স্থির নয়নে আমার পানে চেয়ে মৃদুস্বরে ও আমাকে প্রেমের অমৃত বচনই শুনিয়েছিল। বলেছিল, সেই কবিতাটি আবৃত্তি করবে? আমি অবরুদ্ধ আবেগে শুনিয়েছিলাম ওর স্বরচিত কবিতা।
কবিতা শেষ হলো। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে সটান বিছানায় দাঁড়িয়ে উঠল লিজিয়া। মৃত্যুপথযাত্রীর এত আবেগ সইবে কেন? নিঃশেষিত হয়ে লুটিয়ে পড়ল শষ্যায়। শেষ নিশ্বাস যখন পড়ছে, তখন শুনলাম বাতাসের সুরে ওর আত্মা যেন বিড়বিড় করছে অধরোষ্ঠের ফাঁকে। কান পেতে শুনলাম গ্যানভিলের সেই অমর কথা-ইচ্ছার মৃত্যু নেই। ঈশ্বর স্বয়ং একটা মহান ইচ্ছা। মানুষ দেবলোকে যেতে চায় না-মরার পরেও না-আপন ইচ্ছাশক্তি যতক্ষণ না দুর্বল হচ্ছে।