শব্দটা থামতেই আবার বাদ্যযন্ত্রগুলো বেজে ওঠে; সবাই হাসি-গল্পে মুখর হয়ে ওঠে। আনন্দ-ফুর্তির বন্যা বয়ে চলে। তিনপায়া টুলে রাখা সেই জ্বলন্ত অঙ্গারের আলো রঙিন কাঁচের জানালাগুলো ভেদ করে ঘরে বিভিন্ন রঙের পরিবেশ সৃষ্টি করতে থাকে। সবগুলো ঘরের মধ্যে সাত নম্বর ঘরটা আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ( উৎসবের রাত ক্রমশ বেড়ে চলে। লাল জানালার কাঁচ খুঁড়ে রক্তের মতো লাল আলো সাত নম্বর ঘরটার কালো রঙের সাজ-সরঞ্জামের উপর এসে পড়তে থাকে আর ঠিক তখনই একটা মূর্তি সাত নম্বর ঘরের কালো কার্পেটে পা রাখে, তার দেহটা লাল আলোয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঠিক সেই সময়ে আবলুস কাঠের ঘড়িটা সুরেলা ছন্দে বেজে ওঠে, অন্যসব ঘরের লোকেরা সেই শব্দ শুনতে পায়, শুধু সাত নম্বর ঘরটা ছাড়া বাকি ঘরগুলোতে লোকের ভিড়। ওদের এই উৎসব চলে মাঝরাত অবধি।
প্রতিদিনই প্রতি ঘণ্টায় ঘড়ির শব্দে ওদের নাচ, গান, কথাবার্তা সব থেমে যায়। আজ আবার শব্দটা আরম্ভ হতেই রোজকার মতো সব থেমে গেল। মানুষগুলোর মধ্যে একটা বিহ্বলতা নেমে আসে। তারপর যখন ঘড়িটার শেষ শব্দটা খুব আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়, ঠিক তখনই ভিড়ের মধ্যে অনেকেই একজন মুখোশধারীর অস্তিত্ব টের পায়, যাকে একমুহূর্ত আগেও দেখা যায়নি। সকলেই এই অদ্ভুত আকৃতির লোকটার উপস্থিতি নিয়ে চাপারে ফিসফিস করে আলোচনা করতে থাকে। সবার চোখে বিস্ময়, তীব্র আতঙ্ক, ভয়ে সবাই মরিয়া হয়ে ওঠে। অদৃশ্য মূর্তিটার আকৃতিটাও বীভৎস, বিরাট লম্বা দৈত্যের মতো দেখতে, পা থেকে মাথা যেন রহস্যের আবরণে ঢাকা, মুখে মুখোশ, পোশাক-পরিচ্ছদগুলো সব ঘন লাল রক্তবর্ণ, দেখলেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে।
সেই সময় রাজকুমার প্রসপেনোর চোখ ঐ ভূতুড়ে মূর্তিটার উপর গিয়ে পড়ে। মূর্তিটাকে লক্ষ্য করে কর্কশ গলায় বলে ওঠেন–এতদূর স্পর্ধা?
মূর্তিটা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে, রাজকুমার ওর সাহস দেখে খেপে ওঠেন। রুক্ষস্বরে বলেন–ওর স্পর্ধা তো কম নয়। আমাদের উপহাস করছে, অপমান করছে। ওকে তোমরা সবাই মিলে ধরো, ওর মুখোশটা খুলে দাও। তাহলে বুঝতে পারব আগামীকাল ভোরে কাকে আমরা ফাঁসিকাঠে ঝোলাচ্ছি।
রাজকুমার প্রসপেরো পূর্বদিকের নীল ঘরটায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন। আর এই ঘরেই ঘটনার প্রথম সূত্রপাত। ওঁর হাতের ইশারায় সমস্ত বাজনা থেমে গেল। রাজকুমার তখন নিজের দলের লোকজনদের নিয়ে একইভাবে ঘরটার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকেন। দলের লোকজন মুখোশধারী দৈত্যের দিকে এগিয়ে যায় তাকে ধরার জন্য।
কিন্তু মূর্তিটা সেদিক কোনোরকম লক্ষ্য না করেই এগিয়ে যায় রাজকুমারের দিকে। একটা অজানা আতঙ্কে সবাই থেমে যায়, কারও সাহসে কুলোয় না মূর্তিটাকে জাপটে ধরতে। ততক্ষণে মূর্তিটা রাজকুমার প্রসপেয়োর সবচাইতে কাছের লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওদের মধ্যে দূরত্ব মাত্র গজখানেকের মতো। এবার মূর্তিটা ঘরের মাঝখানটা পার হয়ে একেবারে শেষপ্রান্তে দেওয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর ভয়ংকর মূর্তিটা নিজের যাওয়ার রাস্তা করে নেয়, ওর প্রতিটি পদক্ষেপ যেন মাপা আর জোরালো। প্রথমে মূর্তিটা নীল রঙের ঘর থেকে ছুটে যায় বেগুনী রঙের ঘরে, সেখান থেকে যায় সবুজ রঙের ঘরে, তারপর কমলা রঙের ঘরে ঢোকে। এ ঘরে এসে মূর্তিটা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।
রাজকুমার প্রসপেরোর মধ্যে ক্রোধ আর ভয় দুটোই কাজ করতে থাকে। মনে মনে ভীষণ খেপে ওঠেন। তার সঙ্গে একটা ভয়মিশ্রিত লজ্জা আর অপমানে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। তিনি মূর্তিটার পিছন পিছন ধাওয়া করে চলেন। কিন্তু ওঁর সঙ্গীরা কেউই তাকে অনুসরণ করে না। রাজকুমার প্রসপেরো মূর্তিটার পিছন পিছন একের পর এক ঘরে ঢোকেন, হাতে তার ঝকঝকে ছুরি, যার তীক্ষ্ণ ফলাটা চৰ্চ করে ওঠে প্রতিহিংসা, অপমান ও ক্রোধে।
সবশেষে রাজকুমার প্রসপেরো আর দৈত্যটা সাত নম্বর ঘরে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। রক্তের মতো লাল আলো ঘরের মধ্যে ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। একটু পরে ঘরের ভেতর থেকে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ গোটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। রাজকুমারের তীক্ষ্ণ ফলাওয়ালা ছুরিটা কালো কার্পেটের উপর ছিটকে যায় আর রাজকুমার প্রসপেয়োর রক্তাক্ত মৃতদেহটা কালো কার্পেটের উপর আছড়ে পড়ে।
তারপরের ঘটনাগুলো খুবই দ্রুত ঘটে যায়। সবাই তখন আতঙ্কে, ভীত বিহ্বল হয়ে পড়ে। কারও কোনোকিছু করার ক্ষমতা থাকে না। হঠাৎ রাজকুমারের তীক্ষ্ণ চিৎকার ওদের সবাইকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। এবার সবাই মরিয়া হয়ে মনের সাহস জোগাড় করে ছুটে যায় লাল রঙের ঘরটার দিকে। হুড়মুড় করে সবাই ঘরে ঢুকে পড়ে দেখতে পায় সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা, যা দেখে ওরা আতঙ্কে শিউরে ওঠে, মুখের ভাষা বন্ধ হয়ে যায়।
সবাই আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে দেখে সামনে সেই আবলুস কাঠের ঘড়িটার ঠিক পিছনে লম্বা, বিকট আর ভয়ঙ্কর দৈত্যটা দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হয় পাথরের খোদাই-করা একটা মূর্তি নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয়েছে। কবর থেকে উঠে আসা মুখোশধারী মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে মৃত্যুভয়ে সবার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। প্রত্যেকেই রক্তাক্ত মৃত্যুর উপস্থিতি টের পায়। সবাই বুঝতে পারে এই মূর্তিটা হচ্ছে একটা পিশাচ। মানুষের রক্তেই যার খিদে মেটে। মাঝরাতে যে সকলের অলক্ষ্যে চোরের মতো এই দুর্গে ঢুকে পড়েছে।