রক্তাক্ত মৃত্যুর কথা বলার আগে দুৰ্গটার বর্ণনা দিয়ে নিই। এই দুৰ্গটা ছিল সাতটা ঘর বিশিষ্ট একটা রাজকীয় অট্টালিকা। এই বিরাট ঘরগুলোর সবটা একনজরে দেখা যায় না। কারণ ঘরগুলোর দরজাগুলো অদ্ভুত ধরনের। আসলে এইরকম অসম্পূর্ণ দেখানোটাই ছিল ঘরগুলোর বৈশিষ্ট্য। কুড়ি কিংবা তিরিশ গজ অন্তর একটা করে বাঁক আর বাঁকগুলো দেখলে কেমন রহস্যময় মনে হতো। দেওয়ালের ডান-বা দুদিকেই ঠিক মাঝখানে একটা করে লম্বাটে ধরনের ভূতুড়ে জানালা। ঘরের বাইরে টানাবারান্দা। প্রতিটি ঘরেই হু হু বাতাস বইত। প্রত্যেকটা জানালায় কাঁচ লাগানো ছিল। কিন্তু জানালার কাঁচের রং অদ্ভুত ধরনের। প্রত্যেক ঘরের প্রতিটি সরঞ্জাম যে রঙের ছিল সেই ঘরের জানালার কাঁচের রঙটা ওই ঘরের সাজ-সরঞ্জামের রঙের মতো ছিল। যেমন পূর্বদিকের প্রথম ঘরের প্রতিটি সাজসরঞ্জাম নীল রঙের, তাই ঐ ঘরের জানালার কাঁচের রঙটাও নীল রঙের ছিল। দ্বিতীয় ঘরটায় বেগুনী রঙের জিনিসপত্র সাজানো ছিল, তাই ঘরের জানালার কাঁচও বেগুনী রঙের ছিল। এইভাবে তৃতীয় ঘরের জানালার কাঁচের রঙ সবুজ! চার নম্বর ঘরের জানালার কাঁচের রঙ কমলা। পাঁচ নম্বর ঘরের জানালার কাঁচের রঙ সাদা। ছয় নম্বর ঘরটার জানালার কাঁচের রঙ ছিল ধূসর। আর পশ্চিমদিকের সাত নম্বর ঘরটার প্রতিটি সাজ-সরঞ্জাম ছিল কালো রঙের। এই ঘরের কড়িকাঠ থেকে মেঝে পর্যন্ত সবকিছুই কালো রঙের ছিল। এমনকি ঝুলে থাকা পর্দাগুলো আর মেঝেয় বিছানো কার্পেটটাও কালো রঙের ছিল। কিন্তু এই সাত নম্বর ঘরের জানালার কাঁচের রঙটা ছিল আলাদা। কালো না হয়ে লাল রঙ ছিল। এই লাল রঙটা দেখলেই মনে হতো–তাজা ঘন রক্তের মতো।
দুর্গের সাতটা ঘরের মধ্যে কোনোটাতেই কিন্তু আলোর ব্যবস্থা নেই। এমনকি কড়িকাঠে ঝোলানো ঝাড়বাতি কিংবা প্রদীপ কোনোকিছুরই ব্যবস্থা ছিল না। শুধু মাঝখানে কিছু সোনার অলংকার ছাদ বেয়ে নেমে এসে এদিক-ওদিক ঝুলছে। ফলে সবগুলো ঘর ছিল আলোবিহীন। শুধু ঘরের বাইরে লম্বা বারান্দায় প্রতিটি জানালার ঠিক উলটোদিকের বারান্দাতে একটা করে তিনপায়া টুল রাখা আর এই টুলের উপর থাকত জ্বলন্ত অঙ্গারের পাত্র। এই জ্বলন্ত অঙ্গার থেকে যে আলো বের হতো তা রঙিন জানালাগুলোর কাঁচ ভেদ করে ঘরের মধ্যে যখন পড়ত তখন প্রতিটি ঘরই কেমন রহস্যময় হয়ে উঠত। যেন একটা ভৌতিক আবহাওয়া সৃষ্টি হতো। এই সাতটা ঘরের মধ্যে সবচেয়ে ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হতো পশ্চিমদিকের সাত নম্বর ঘরটায়। অঙ্গারের আলো যখন ওই লাল ঘরের রক্তের কাঁচের জানালা ভেদ করে ঘরের মধ্যে দিয়ে কালো পর্দাগুলোর ও মেঝের কার্পেটের উপর পড়ত তখন ভয়ানক গা-ছম্ছ- করা একটা ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হতো। এই পরিবেশে যদি কেউ এই ঘরে ঢুকতো তখন তার মুখটায় একটা নিষ্ঠুর, ভয়ংকর ভাব ফুটে উঠত, যার জন্যে এই ঘরটাকে দুর্গের সবাই এড়িয়ে চলত। খুব কম লোকই এই সাত নম্বর ঘরটায় ঢুকতে সাহস পেতো।
সাত নম্বর ঘরটার পশ্চিমদিকের দেওয়ালে আরও একটা অদ্ভুত জিনিস রাখা ছিল। তা হচ্ছে আবলুস কাঠের মস্তবড় ঘড়ি। এই ঘড়ির পেণ্ডুলামটা ছিল বিশ্রী, কেমন যেন একঘেয়ে বিশ্রীভাবে শব্দ করে দুলতে থাকত, মিনিটের কাঁটাটা ঘুর পাক খেয়ে যখন একটা ঘণ্টা পুরো হতো তখনই ঘড়িটার পেতলের হৃৎপিন্ড ফুড়ে একটা অদ্ভুত ধরনের শব্দ বেরিয়ে আসত। শব্দটা ছিল পরিষ্কার, জোরালো ও গম্ভীর। এই শব্দের মধ্যে একটা জাদু আছে, যখনই শব্দটা হতো তখন যারা বাদ্যযন্ত্রগুলো বাজাত তারা বাজনা থামিয়ে চুপটি করে শব্দ শুনত। নাচ, গান তখন সব থেমে যেত, সমস্ত কিছুই কেমন এলোমেলো হয়ে যেত। সবাই যেন এই শব্দ থেকে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করত আর সবাই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ত।
শব্দটা যখন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেত তখন আবার সবাই সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠত। একে অন্যের দিকে তাকাত, হাসত, গল্প করত। ওদের এই হাসি, কানো দেখলেই মনে হতো সবটাই ওদের ভয়ের জন্যে। তারপর ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করত, বলত আবার যখন এই শব্দটা হবে তখন ওরা এমনি করে বোকার মতো চুপ করে থাকবে না, কিন্তু ওদের বালাই সার হতো। সেই ষাট মিনিট অর্থাৎ তিন হাজার ছশো সেকেন্ড পরে ঘড়িটা আবার এই অদ্ভুত সুরে বেজে উঠত, তখন ওদের আগের কথা মনে থাকত না। আগের মতো সবকিছু থেমে যেত, মানুষগুলো সব বোকার মতো নিশ্চুপ হয়ে যেত, ওরা সবাই কিছু একটা বুঝতে চেষ্টা করত। প্রতি ঘণ্টায় এইরকম অদ্ভুত শব্দ শুনে চুপ করে গেলেও ওদের আনন্দের অনুষ্ঠান ঠিকভাবেই চলত। তাতে কোনোরকম ত্রুটি ছিল না।
এই সাত নম্বর ঘরের সমস্ত সাজসজ্জা রাজকুমার প্রসপেনোর রুচি অনুযায়ীই সাজানো হয়েছে, এতেই ওঁর অদ্ভুত ধরনের রুচির পরিচয় আমরা পাই। তাছাড়া তার পরিকল্পনা অনুযায়ী সমস্ত অনুষ্ঠনগুলো চলত। এই সব কিছু মিলিয়ে শুধু একটাই পরিবেশ সৃষ্টি হতো যেটা হচ্ছে গতিময় ও ভৌতিক আবহাওয়ার, অবশ্য হারমানি দেখার পর থেকেই রাজকুমারের মাথায় এইসব অদ্ভুত অদ্ভুত পরিকল্পনাগুলো এসেছে। তাছাড়া এখানকার মানুষগুলো সবকিছুই দেখলে মনে হয় কোনোকিছু সুস্থ নয়, সব কেমন এলোমেলো, অগোছালো।
নির্জন, নিখুঁত নিরাপদ থাকার দুর্গের মধ্যে সবাই খুবই আনন্দের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। এইভাবে প্রায় পাঁচ-ছয় মাস কেটে গেল। হঠাৎ ষষ্ঠ মাস শেষ হওয়ার আগেই সেই অভিশপ্ত ব্যাধির আক্রমণ শুরু হলো। ঘটনাটা যেদিন ঘটে সেদিন রাজকুমার প্রসপেরো তার হাজারখানেক প্রজার সঙ্গে নাচ গানের আসরে আনন্দে, উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিলেন। ঘরগুলো সব যেন ভয়াবহ মনে হতে থাকে। মনে হলো, ঘরের রঙ যেন তারা চুষে নিচ্ছে। হঠাৎ আবলুস কাঠের সেই ঘড়িটার শব্দ বাজতে থাকে যার ফলে বাদ্যযন্ত্রের বাজনা থেমে যায়, চারদিকে নিস্তব্ধ-নীরবতা নেমে আসে। সবাই যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।