তোমাদের বাড়িটি খুব বড়ো, ফুপু, বলল রোজালিন।
মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। তারপর বাড়িটি তোকে ঘুরিয়ে দেখাব। চল, তোর শোবার ঘরটা দেখিয়ে দিই।
শোবার ঘরটা দেখিয়ে দিই, তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল কেউ।
কে কথা বলে? অস্বস্তি নিয়ে জানতে চাইল রোজালিন। খনখনে গলায় হেসে উঠলেন ফুপু। গায়ে কাঁটা দিল রোজালিনের। ফুপু হলওয়ের শেষ প্রান্তে হেঁটে গেলেন। সবুজ ভেলভেটের কাপড় সরাতেই একটা খাঁচা দেখতে পেল রোজালিন। খাঁচার ভেতরে একটি কাকাতুয়া।
ওর নাম পলি, তাই না, পলি? পাখির মতো কিচকিচ শব্দ করলেন হ্যারিয়েট ফুপু।
পাখির খাঁচার ধারে গেল না রোজালিন। সে কাকাতুয়া একদম পছন্দ করে না। ফুপু, আমি বরং আমার ঘরে যাই।
হ্যাঁ, চল, চল… আমি এক্ষুনি ফিরছি, পলি, বললেন ফুপু।
রোজালিনকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলেন মিসেস হ্যারিয়েট। হলঘরের শেষ মাথার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
এটা তোর ঘর, রোজালিন। আশা করি পছন্দ হবে। বিয়ের সময় এটা বসার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতাম।
ভেতরে উঁকি দিল রোজালিন। গোটা ঘরে লাইলাকের ছড়াছড়ি। বিছানার চাদরে উজ্জ্বল রঙের লাইলাকের ছাপা; ওয়াল পেপারে সাদা লাইলাক। এমনকি আসবাবগুলোর গায়েও তাই।
তুই একটু বিশ্রাম নে, রোজালিন। তারপর নিচে আসিস, একসঙ্গে চা খাব।
মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল রোজালিন। বিশ মিনিট পরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচে। ফুপুর সঙ্গে চা খাবে। মূল হলওয়েতে সূর্যালোকিত একটি ঘরে ভাতিঝির জন্য অপেক্ষা করছিলেন হ্যারিয়েট ফুপু। সোফার পাশের ছোটো টেবিলে চা এবং কেক সাজিয়ে রাখা।
কেকগুলো ঘরে বানানো, রোজালিন, বললেন ফুপু। তুই এসেছিস খুব খুশি হয়েছি। মাঝে মাঝে এমন একা লাগে! পলি আর আমি একা বসে বেশিরভাগ সময় খাই। তাই না, পলি?
একা খাই, কর্কশ গলায় বলে উঠল পলি। রোজালিন লক্ষ করল খাঁচাটি জানালার ধারে বসানো হয়েছে।
রোজালিন কেক খেল। স্বাদ ভালোই। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঘরে চোখ বুলাতে লাগল। আসবাবগুলো মান্ধাতা আমলের। ল্যাম্পগুলো শেড থেকে ঝুলে আছে, তাতে ক্রিস্টালের পুঁতি। চেয়ার কভারগুলো মখমলের। দেখেই বোঝা যায় অনেক পুরোনো, ভাজ খেয়ে রয়েছে নানা জায়গায়। ছোটো ছোটো অসংখ্য স্ট্যাচু এবং ছবি সারা ঘর জুড়ে। একটা ছবিতে নজর আটকে গেল রোজালিনের। ও কি আমার ফুপাতো ভাই হারম্যান?
হাহাকারের মতো একটা শব্দ বেরুল ফুপুর গলা দিয়ে।
সরি, ফুপু। আমি বুঝতে পারিনি তুমি কষ্ট পাবে, বলল রোজালিন। বিব্রত বোধ করছে। সে শুনেছে হারম্যান খুব অল্প বয়সে মারা গেছে। ছেলের মৃত্যুর মাসখানেক বাদেই আত্মহত্যা করেন আর্থার ফুপা। ফুপুর সঙ্গে রোজালিন কিংবা তার বাবার যোগাযোগ শুধু টেলিফোন এবং চিঠির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। রোজালিনের বাবার কোনো ভাই নেই, বোন এই একজনই–হ্যারিয়েট।
সে সান্ত্বনার সুরে বলল, তুমি তো জানোই ফুপু, হারম্যান ভাইয়ার জন্য কীরকম টান ছিল আমার। যদিও কোনোদিন দেখিনি ওকে… কিন্তু আমাদের জন্ম তো একই বছরে। ও মারা গেছে শুনে খুব কেঁদেছিলাম আমি।
ফুপু সামলে নিয়েছেন নিজেকে। হারে, ওটা তোর হারম্যান ভাইয়ারই ছবি। যাক, বাদ দে। যা গেছে গেছে। ও নিয়ে আর মন খারাপ করতে হবে না। চল, তোকে বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাই।
রোজালিন তার ফুপুর পেছন পেছন বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আবার সেই অন্ধকার হলওয়েতে ঢুকল।
তোকে আগে তোর আর্থার ফুপার পড়ার ঘর এবং ল্যাবরেটরি দেখাব। তুই তো জানিস, আর্থার খুব বড়ো মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন। সবসময় সময়ের আগে এগিয়ে থাকতেন। ইউনিভার্সিটির লোকজন তাকে ঈর্ষা করত। এ জন্য ভার্সিটির চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে গবেষণা শুরু করেছিলেন তিনি।
একটি প্রকাণ্ড ঘরে ঢুকল ওরা। এ ঘরে শুধু বই আর বই। রোজালিন অবাক চোখে চারদিক দেখছে। এখানে বসে আর্থার ফুপা কাজ করতেন। শুনেছে তিনি বিজ্ঞানী ছিলেন। তবে বাবা কখনোই ফুপার বিষয়ে কোনো কথা বলত না। রোজালিন শুনেছে কী একটা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ইস্তফা দিতে হয়েছিল ফুপাকে।
আর এদিকে, একটা দরজা দেখালেন ফুপু। তোর ফুপার গবেষণাগার।
পরের ঘরটা কেমন গা ছমছমে। ঘরভর্তি নানান কাঁচের জার, টেস্টটিউবসহ বৈজ্ঞানিক আরও জিনিসপত্র। জারগুলোর গায়ে বিভিন্ন লেবেল সাঁটানো। ভেতরে কেমিকেল।
আর্থার ফুপা কী নিয়ে গবেষণা করতেন? জিজ্ঞেস করল রোজালিন।
উনি জীববিজ্ঞানী ছিলেন, বিরাট বায়োলজিস্ট, সশ্রদ্ধ কণ্ঠে বললেন হ্যারিয়েট ফুপু। হিউম্যান মিউটেশন মানে মানব দেহের পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতেন।
ও আচ্ছা, বলল রোজালিন। দেয়ালে চোখ বুলাল। ওখানে গরিলা এবং বানরের পাশাপাশি মানুষের শরীরের ছবিও ঝুলছে।
রোজালিন, একটা কথা এ দুটি ঘরের কোনো কিছুতে হাত দেয়া যাবে। আমার স্বামীর কাজের নিদর্শন রয়ে গেছে এ ঘর দুটিতে। একদিন বিজ্ঞান বুঝতে পারবে উনি কতটা প্রতিভাবান ছিলেন। এ ঘর দুটি যেমন আছে সবসময় তেমন থাকবে।
অবশ্যই ফুপু, বলল রোজালিন। ফুপুর পেছন পেছন স্টাডিরুম হয়ে আবার চলে এল হলঘরে।
বাড়ির বাকি ঘরগুলো তুই নিজেই ঘুরে দেখতে পারবি, রোজালিন, বললেন ফুপু। তবে চিলেকোঠায় ভুলেও যাবি না। তাঁর কণ্ঠ কঠিন শোনাল। আমার কথা বুঝতে পেরেছিস?