তোমাকে একটা ঘটনা বলব, শীলা।
চোখ বড়ো বড়ো করে শুনতে উন্মুখ হলো মেয়েটা।
আজ রাতের পত্রিকাটা পড়েছ?
হ্যাঁ।
আমি-আমি ওই দোকান থেকে এই আলখাল্লাটা কিনেছি। অদ্ভুত একটা আসুরিক শক্তি আছে এটার। তোমাকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। লিন্ডস্ট্রোমকে কেমন ঠেসে ধরেছিলাম, তুমি তো দেখেছই। ওটা আসলে কিন্তু অভিনয় ছিল না। আমি সত্যিই দাঁত ফুটিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম ওর গলায়। এই পোশাকটা আমার ভেতর সত্যিকারের পিশাচের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি, শীলা।
আমি জানি। চাঁদের আলোতে চিকচিক করছে মেয়েটার চোখ।
আমি একটা পরীক্ষা করতে চাই। এই পোশাকে চুমু খাব তোমাকে। আমি প্রমাণ করতে চাই, ওই জিনিসের চেয়ে আমার ভালোবাসার শক্তি বেশি। যদি দুর্বল হয়ে পড়ি, ব্যর্থ হই, কথা দাও–দ্রুত পালিয়ে যাবে তুমি। আমাকে ভুল বুঝো না, লক্ষ্মীটি! ওই অশুভ শক্তির সাথে প্রাণপণ লড়ব আমি। আমার ভালোবাসা তোমার জন্য নিখাদ এবং নিরাপদ হোক-এটাই তো আমি চাই। কী, ভয় পেলে?
না। শীলা এখনও তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। সে যেমন তাকিয়ে আছে মেয়েটার গলার দিকে। বেচারি যদি তার মনের খবর জানত!
তুমি আবার ভেবে বসোনা, মাথাটা আমার বিগড়ে গেছে, বোঝাবার ভঙ্গিতে বলল হেনডারসন। ওই দোকানে-এক বিরক্তিকর বেঁটে বুড়ো এই আলখাল্লাটা আমাকে দিয়ে বলল, এটা নাকি সত্যিকারের ভ্যাম্পায়ারের পোশাক। ভেবেছিলাম বুড়ো তামাশা করেছে। কিন্তু এই পোশাকে আয়নার। সামনে দাঁড়ালে কোন প্রতিবিম্ব পড়ে না এবং এটার প্রভাবেই লিন্ডস্ট্রোমের গলার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। এমনকী তোমার প্রতিও। কাজেই আমাকে পরীক্ষাটা করতেই হবে।
শীলা তৈরি। চেহারায় চাপা কৌতুক। হেনডারসন তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকল। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল বিপরীত দুই অনুভূতির। কমলা চাঁদের ভৌতিক আলোতে মুহূর্তকাল মাত্র স্থির দেখা গেল তাকে। পরক্ষণে তার চোখে মুখে ফুটে উঠল কঠোর চেষ্টার চিহ্ন।
মেয়েটা তাকে প্রলুব্ধ করল। তার লাল টুকটুকে ঠোঁটের ফাঁকে ঝিলিক দিল সাদা দাঁত। কালো আলখাল্লার ভেতর থেকে ফর্সা দুটি হাত এসে আস্তে করে পেঁচিয়ে ধরল হেনডারসনের গলা। মেয়েটা এবার মুখ টিপে হেসে আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে বলে উঠল, আমি আগে থেকেই জানি, আমারটার মতো তোমার আলখাল্লাটাও আসল। তুমি যেখান থেকে এনেছ, আমারটাও একই জায়গার। আয়নায় শুধু তোমার না, আমারও কোন প্রতিবিম্ব পড়ে না। বোকা, খেয়াল করোনি।
প্রচণ্ড বিস্ময়ে বরফের মতো জমে গেল হেনডারসন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজোড়া চতুর ঠোঁট তার গলা স্পর্শ করল। কুট করে বিধে গেল সুতীক্ষ দাঁত। প্রথমে সূক্ষ্ম একটা বেদনা, তারপর আশ্চর্য সুখকর অনুভূতি। একটা সর্বগ্রাসী অন্ধকার ক্রমশ গিলে খেতে লাগল হেনডারসনকে।
লালমৃত্যু
সেই সময় গোটা দেশজুড়ে রক্তাক্ত মৃত্যুর প্রতিধ্বনি। দেশটা যেন ধ্বংসের মুখের খাবারের মতো গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে। এই রক্তাক্ত মৃত্যুটাও একধরনের ব্যাধি, যে ব্যাধির আক্রমণে সমস্ত জায়গাজুড়ে রক্তবন্যা বয়ে চলে।
এই রোগের লক্ষণ হলো প্রথমে তীব্র একটা যন্ত্রণার অনুভূতি, তারপর মাথা ঘোরা, সবশেষে শরীরের প্রতিটি লোমকূপ থেকে অবিরত রক্ত ঝরা। সারা শরীরটাই রক্তের দাগে ভরে ওঠে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো এই রোগের শিকার যাতে বাইরের কোনো সাহায্য কিংবা তার পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে কোনোরকম সহানুভূতি পেতে না পারে তার জন্য শিকারের মুখটা আঠালো ফিতে দিয়ে আঁটা থাকে। এই শিকার ধরা থেকে তাকে শেষ করতে সময় লাগে মাত্র আধঘণ্টা। এই আধঘণ্টার মধ্যেই সমস্ত ঘটনাটা নিখুঁতভাবে ঘটে যায়।
এ রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের ফলে রাজকুমার প্রসপেরোর রাজ্যের লোকসংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গেল। রাজকুমার প্রসপেরো খুব সুখী আর ভীষণ আমুদে স্বভাবের ছিলেন। তাঁর ছিল খুব সাহস আর ছিলেন বিচক্ষণ ব্যক্তি। যখন দেখলেন তার রাজ্যের লোকসংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে তখন তিনি তাঁর দরবারের হাজারখানেক যোদ্ধা আর অভিজাত মহিলাদের নিজের কাছে ডেকে পাঠালেন। তারপর নিজের তৈরি করা নির্জন দুর্গগুলোর একটাতে ওদেরকে পাঠিয়ে দিলেন।
ওদের যে দুৰ্গটায় পাঠানো হলো সেটা অদ্ভুত ধরনের দেখতে। এ থেকে রাজকুমারের নিজস্ব অভিজাত আর অদ্ভুত রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। দুর্গার চারদিক জুড়ে উঁচু আর শক্ত দেওয়াল। আর দেওয়ালটার চারদিকেই মাঝে মাঝে লোহার গেট। মানুষগুলোকে লোহার গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার পর দরজার বগুলো গরম করে হাতুড়ি পিটে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হলো। এর ফলে দুর্গের মধ্যে কোনোরকম উত্তেজনাকর ঘটনা ঘটলে কারো পক্ষেই বাইরে আসার উপায় ছিল না। আবার তেমনি কেউ ইচ্ছা করলেই ভিতরে ঢুকতে পারত না।
তবে দুর্গের ভিতরে সবকিছুর ব্যবস্থা ছিল। বেঁচে থাকার জন্যে যা যা প্রয়োজন সবকিছুরই সুব্যবস্থা ছিল। আনন্দ-ফুর্তি করার জন্য সবরকম ব্যবস্থা এই দুর্গের ভিতরে করা হয়েছিল। আনন্দ দেওয়ার জন্য একদল সুন্দরী রমণী ছিল আর খাওয়ার জন্য ঢালাও মদের ব্যবস্থা ছিল। দুর্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থাটাও ছিল খুব নিখুঁত, কোনো ভয় ছিল না। শুধু দুর্গে একটাই জিনিস ছিল না তা হচ্ছে–রক্তাক্ত মৃত্যু।