রক্ত! দেখতে কী সুন্দর এই জিনিস! রক্তের উষ্ণতায় আছে প্রাণ, আছে প্রবহমান জীবন।
দূর, উন্মত্ত মাতালের মতো কী যা তা ভাবছে সে!
ও, আমার ভ্যাম্পায়ার বন্ধুটি তা হলে এখানে! শীলা কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টেরই পায়নি হেনডারসন। বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয় তার। শীলার উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকাতেই সে টের পায়, মেয়েটির টুকটুকে ঠোঁট তাকে নীরব আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। উষ্ণ একটা ঢেউ অনুভব করে হেনডারসন। ঝলমলে কালো পোশাক ভেদ করে উঁচু হয়ে থাকা শীলার। ধবধবে গলার দিকে তাকায় সে। আরেকটা উষ্ণতা জেগে ওঠে তার মাঝে। এই উষ্ণতায় রয়েছে ভালোবাসা, কামনা এবং একটি ক্ষুধা।
হেনডারসনের চোখের ভাষা বুঝে নেয় শীলা। তার চোখেও যে ওই আগুন। সেও ভালোবেসে ফেলেছে সামনে দাঁড়ানো পুরুষটিকে।
আবেগের তাড়নায় চট করে আলখাল্লাটা খুলে ফেলে হেনডারসন। বরফ শীতল ভার নেমে যায় গা থেকে। সে এখন অভিশপ্ত পোশাকটার নাগপাশ থেকে মুক্ত। শীলাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার তীব্র একটা ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু জড়তা এসে বাধা দেয়।
কী, ক্লান্ত হয়ে পড়েছ? বলল শীলা। একই শিহরণ তাকেও দোলা দিচ্ছে। সেও খুলে ফেলে তার আলখাল্লা-অশুভ আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসে সত্যিকারের দেবী। অ্যানজেলের পোশাকে দারুণ লাগছে শীলাকে। সোনালি চুল এবং গর্বিত ভঙ্গিমার মাঝে ফুটে উঠেছে তার পূর্ণাঙ্গ নারীসত্তা। অজান্তেই প্রশংসা-ধ্বনি বেরোয় হেনডারসনের কণ্ঠ থেকে। সে ফিসফিস করে বলে, আমার স্বর্গ-সুন্দরী!
শীলাও সাড়া দেয়, আমার শয়তান!
পরমুহূর্তে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয় দুজন। শীলার আলখাল্লাটা চলে আসে হেনডারসনের হাতে। দুরন্ত আবেগে একাকার হয়ে যায় দুজোড়া ঠোঁট।
লিন্ডস্ট্রোম এবং তার কজন সঙ্গীর আকস্মিক আগমন দুজনের দুর্বার ভালোবাসায় ছেদ ঘটাল। গল্প করতে করতে ঢুকে পড়েছে তারা।
হেনডারসনকে দেখেই কুঁকড়ে গেল লিন্ডস্ট্রোম। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল, তু-তুমি এখনও আছ!
ভয় নেই, হাসল হেনডারসন। এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।
শীলাকে জড়িয়ে ধরে খালি এলিভেটরের দিকে এগোল হেনডারসন। তরাস খাওয়া লিন্ডস্ট্রোমের ছাই-বরণ মুখের ওপর দড়াম করে বন্ধ হলো। দরজা।
আমরা কি চলে যাচ্ছি? হেনডারসনের কাঁধে মাথা রেখে জানতে চাইল শীলা।
হ্যাঁ, যাচ্ছি। তবে মাটির ধরায় নয়। নিচে আমার জগতে না গিয়ে যাচ্ছি। ওপরে–তোমার ভুবনে।
ছাদের বাগানে?
হ্যাঁ গো, আমার স্বপ্নের রানি। স্বর্গের বাগানে বসে গল্প করব আমরা। মেঘের চুড়ায় বসে চুমু খাব তোমাকে। তারপর–
শীলার ঠোঁট দুটো কথা শেষ করতে দিল না হেনডারসনকে। এলিভেটর উঠতে লাগল আপন গতিতে।
একসময় বিচ্ছিন্ন হলো দুজন। হেনডারসন বলল, দেবীর সাথে শয়তান। এ কেমন জুটি!
আমিও তাই বলেছি, মনে করিয়ে দিল শীলা। আমাদের সন্তানেরা স্বর্গীয় মহিমা, না শয়তানের শিঙ নিয়ে জন্মাবে?
দুটোই থাকবে ওদের সাথে। দেখে নিয়ে।
খোলা নির্জন ছাদে বেরিয়ে এল দুজন। হেনডারসন আবারও অনুভব করল, আজ হ্যালোইনের রাত। নিচে লিন্ডস্ট্রোম এবং তার সোসাইটি-বন্ধুরা আমোদ-ফুর্তি আর মদ্য পানে মগ্ন। আর এখানে আলো নেই, শব্দ নেই, পানাহার নেই। নিস্তব্ধ বিষণ্ণ একটি রাত। অন্যান্য রাতের মতোই সাধারণ। তবু এ রাতের আলাদা একটা মর্ম আছে।
আকাশটা এ মুহূর্তে নীল নয়, কালো। কমলা চাঁদের চারদিকে ঘুরে বেড়ানো ধূসর মেঘগুলোকে দৈত্যের থোকা থোকা দাড়ির মতো লাগছে। সাগরের ওদিক থেকে আসা ঠান্ডা বাতাসে মৃদু গুঞ্জন।
শীতও পড়েছে বটে!
আমার কাপড়টা দাও, মৃদু কণ্ঠে বলল শীলা।
পোশাকটা ফিরিয়ে দিল হেনডারসন। পাক খেয়ে ঝলমলে কালো কাপড়টার ভেতর ঢুকে পড়ল শীলা। তার ঠোঁট দুটো আবারও তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠল। হেনডারসন উপেক্ষা করতে পারল না। জোড়া লেগে গেল দুজোড়া ঠোঁট।
শীতে মৃদু কাঁপছে হেনডারসন। শীলা দেখে বলল, আলাখাটা পরে নাও।
হেনডারসনও আলখাল্লা গায়ে দেয়ার কথা ভাবছে। এটা পরে মেয়েটার দিকে তাকালে কামনা জেগে উঠবে তার। তারপর তৃষ্ণা। প্রথমে সে চুমু খাবে শীলাকে, তারপর ধীরে ধীরে পৌঁছাবে তার মসৃণ গলায়। ভালোবাসায় ভাসতে ভাসতে সানন্দে গলাটা এগিয়ে দেবে শীলা। তারপর
এটা পরো, ডার্লিং কথা শোনো। শীলার অধৈর্য চোখে তীব্র একটা আকাক্ষা ফুটে উঠেছে।
উত্তেজনায় কেঁপে উঠল হেনডারসন। সত্যিই সে আঁধারের প্রতীক আলখাল্লাটা পরবে? কবরের গন্ধ মাখা মৃত্যুর পোশাক গায়ে দিয়ে সাজবে রক্তচোষা?
দেখি, একটু ঘোরো তো।
শীলার শীর্ণ হাত দুটো আলখাল্লাটা কাঁধে চাপাল হেনডারসনের। মেয়েটা গভীর মমতায় হাত বোলাল তার গলায়। তারপর আটকে দিল আলখাল্লার বোতাম।
হেনডারসন টের পেল, বরফ-শীতল সেই পরশটা ক্রমেই ভয়ানক রকম উষ্ণতার দিকে যাচ্ছে। নিজেকে আগের চেয়ে আরও বেশি অনুভব করতে পারছে সে। চেহারার পরিবর্তন স্পষ্ট বুঝতে পারছে। এর নাম শক্তি। একটা অশুভ শক্তি!
সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির চোখে চাপা কৌতুক, প্রচ্ছন্ন আমন্ত্রণ। তার হাতির দাঁতের মতো সাদা সরু গলাটার দিকে তাকাল হেনডারসন। একটু পরেই ওখানে পৌঁছাবে তার ঠোঁট। তারপর–
না-এটা হতে পারে না। মেয়েটাকে সে ভালোবাসে। তার ভালোবাসা অবশ্যই এই পাগলামিকে জয় করবে। হ্যাঁ, এই পোশাক পরেই, এটার শক্তিকে হটিয়ে দিয়ে, শীলাকে বুকে টানবে সে। শয়তানের মতো নয়, একজন মানুষের মতো নিজের প্রেমিকাকে গ্রহণ করবে। এটা তার জন্যে একটা পরীক্ষা।