হাত দুটো ইতোমধ্যে লিন্ডস্ট্রোমের গলায় গিয়ে পৌচেছে। কী উষ্ণ গলা! পাগলের মতো শিরা খুঁজে বের করল সে। মুখটা এগিয়ে যাচ্ছে গলার দিকে। নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করল লিন্ডস্ট্রোম। কিন্তু হেনডারসনের বজ্রমুঠি আরও চেপে বসল গলায়। লালচে হয়ে গেল লিন্ডস্ট্রোমের চেহারা। রক্ত সব উঠে আসছে মাথায়। এইতো চাই। রক্ত!
মুখটা আরও বড়ো হলো হেনডারসনের। শিরশির করে উঠল দাঁত। মোটা গলাটা স্পর্শ করল মুখ। তারপর–
থামো! যথেষ্ট হয়েছে! শীতল কণ্ঠ শীলার। হেনডারসনের হাত ধরে টানছে সে। মাথা তুলে তাকাল হেনডারসন। নিজের কান্ড দেখে নিজেই হতবাক। লিন্ডস্ট্রোমকে ছেড়ে দিল সে। হাঁ করে হাঁপাচ্ছে বেচারা। বিস্ময়ে গোল হয়ে গেছে দর্শকদের মুখ।
হেনডারসনের কানের কাছে ফিসফিস করল শীলা, এটা কী করলে! ভয়ে তো বেচারা আধমরা!
নিজের মাঝে ফিরে আসার চেষ্টা করল হেনডারসন। সবার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে হাসল। বলল, ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়গণ, আমাদের উৎসবের আয়োজক আমার সম্পর্কে যা বলেছেন, তার ছোট্ট একটা প্রমাণ দেখালাম আপনাদের। আমি সত্যিই একটা রক্তচোষা। তবে আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন, দ্বিতীয়বার আর এমন দৃশ্য দেখতে হবে না। এখানে যদি কোনো ডাক্তার থাকেন, তা হলে অবশ্যি রক্ত বদলের একটা আয়োজন করতে পারি।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সবাই। গোল মুখগুলোতে হাসির হুল্লোড় উঠল। বেশিরভাগই হাসল হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো। হেনডারসন তৃপ্ত। কিন্তু মার্কাস লিন্ডস্ট্রোমের মুখে হাসি নেই। সে ভয়-বিহ্বল চোখে হেনডারসনের দিকে তাকিয়ে। হেনডারসন ভালো করেই জানে, তার ভয়টা কীসের।
জটলা ভেঙে যে যার মতো ছড়িয়ে পড়ল আবার। এলিভেটর থেকে এক তাড়া খবরের কাগজ নিয়ে বেরিয়ে এল একজন। রঙ মেখে চেহারাটা ঢেকে ফেলেছে সে। মাথায় ক্যাপ আর গায়ে অ্যাপ্রোন চাপিয়ে নিউজ-বয় সেজেছে। পত্রিকা হাতে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এল সে, গরম খবর! তাজা খবর! পড়ুন সবাই। হ্যালোইনের বড়ো চমক! বাড়তি আকর্ষণ!
কলহাস্যরত অতিথিরা কিনতে লাগল পত্রিকা। এক মহিলা এগিয়ে এল শীলার দিকে। শীলাকে যেতে বলল তার সাথে। বিমূঢ় একটা ভাব নিয়ে তার সাথে এগোল শীলা। হেনডারসনকে শুধু বলল, যাই, আবার দেখা হবে।
শীলার অবজ্ঞা গায়ে জ্বালা ধরাল হেনডারসনের। মেয়েটা মনে মনে খেপে গেছে তার ওপর। কিন্তু সে নিজেই তো বুঝতে পারছে না, লিন্ডস্ট্রোমকে ওভাবে চেপে ধরেছিল কেনো! উহ্, কী ভয়ানক সেই অনুভূতি! কেনো এমন হয়েছিল?
নকল নিউজবয় সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকটা অজান্তেই একটা পত্রিকা কিনে ফেলল হেনডারসন। দেখাই যাক, হ্যালোইনের বড়ো চমকটা কী?
প্রথম পৃষ্ঠায় আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কোনো চমক আবিষ্কার করতে পারল না হেনডারসন। পাতা উলটে শেষ পৃষ্ঠায় চলে এল সে। পাওয়া গেল কাঙ্ক্ষিত শিরোনাম। শুধু চমকই নয়, খবরটা হেনডারসনের জন্য একটা রোমহর্ষক ব্যাপার। পড়তে পড়তে আতঙ্কের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছাল সে।
আজ এক কসটিউম-শপে আগুন লাগে…আটটার পরপরই দমকল বাহিনী সেখানে পৌঁছে…আগুন আয়ত্তের বাইরে চলে যায়…সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত…ক্ষতির পরিমাণ ভীষণ অদ্ভুত, মালিকের পরিচয় জানা যায়নি…কঙ্কালটা পাওয়া গেছে–
না! সশব্দে ফুঁপিয়ে উঠল হেনডারসন।
খবরটা আরেকবার পড়ল সে। আবার কঙ্কালটা পাওয়া গেছে দোকানের নিচে, সেলারে, একটা মাটির বাক্সে। আর বাক্সটা একটা কফিন। আরও দুটো বাক্স ছিল সেখানে। দুটোই খালি। কঙ্কালটা একটা আলখাল্লায় মোড়ানো ছিল। আগুন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি ওটার।
খবরের শেষে একটা বক্স এঁকে তাতে মোটা কালো কালো অক্ষরের শিরোনামসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের মন্তব্য ছাপা হয়েছে। পড়শিরা বড়ো ভয় পেত জায়গাটাকে। তাদের ধারণা হাঙ্গেরির ওদিকে দোকানের মালিকের বাড়ি। অজানা-অচেনা সব লোক আসত দোকানটায় ডাকিনীবিদ্যার চর্চা, প্রেত পূজা–এসব নাকি চলত ওখানে। প্রণয়োদ্দীপক পানীয়, জাদু-টোনার তাবিজ, রহস্যময় ভূতুড়ে পোশাক-কুসংস্কারমূলক বিভিন্ন জিনিসই ছিল দোকানটার পণ্য।
ভূতুড়ে পোশাক-পিশাচ-আলখাল্লা-একে একে সবই ধরা পড়ল হেনডারসনের চোখে। মনে পড়ে গেল বুড়োর সেই কথাগুলো-একটা আলখাল্লা। একেবারে আসল!
তা ছাড়া বুড়ো আলখাল্লাটা ফেরতও নিতে চায়নি। বলেছে–দরকার নেই। এখন থেকে ওটা আপনার।
কথাগুলো ঘাই মারল হেনডারসনের মগজে। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। সেই প্যানেল মিররের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুহূর্ত মাত্র স্থির রইল সে। তারপরই আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে একটা হাত উঠে গেল চোখের সামনে। প্রতিবিম্ব পড়েনি আয়নায়। সহসাই ঝাঁ করে মনে পড়ে গেল, ভ্যাম্পায়ারদের কোনো প্রতিফলন ঘটে না।
কোনো সন্দেহ নেই কিছু একটা ভর করেছে তার ওপর। এই অশুভ শক্তি তাকে কোমল হাত আর মাংসল গলার দিকে টানছে। এজন্যেই লিন্ডস্ট্রোমকে জাপটে ধরেছিল সে। হায় ঈশ্বর!
ছাতলা পড়া এই কুচকুচে কালো আলখাল্লাটাই যত নষ্টের গোড়া। কোনো সাধারণ মাটি নয়, কবরখানার মাটি লেগে আছে এটার সাথে। হিমশীতল এই পোশাকটাই তার মাঝে একটা খাঁটি রক্তচোষাকে জাগিয়ে তুলেছে। এখন ভাবতেই কেমন ঝিমঝিম করছে মাথা–একসময় সত্যিকারের এক পিশাচের সম্পত্তি ছিল অভিশপ্ত পোশাকটা! এটার আস্তিনে যে মরচে-রঙা দাগ দেখা যাচ্ছে, নির্ঘাত শুকনো রক্ত।