একসময় হেনডারসন বন্ধুমহলে ঘোষণা দিয়েছিল, শুধু নাটক-নভেল ছাড়া বাস্তবে প্রথম দর্শনে প্রেম বলে কিছু নেই। সে বলে বেড়াত, নাটক নভেল থেকে মানুষ প্রেম সম্পর্কে জানতে পারে এবং সেই অনুসারে সবার মনে প্রথম দর্শনে প্রেম নিয়ে একটা বিশ্বাস জন্মে, যখন সম্ভবত কামনাকে অনুভব করা যায়।
এবং এ মুহূর্তে শীলা–এই স্বর্ণকেশী সুন্দরী তার মন থেকে সব অসুস্থ চিন্তা, মদের নেশা, আয়নার ভেতরে বোকার মতো উঁকিঝুঁকি একই সঙ্গে ঝেটিয়ে বিদেয় করেছে। তার চোখে এখন রঙিন স্বপ্ন। এক জোড়া লাল ঠোঁট, দ্যুতিময় নীল চোখ এবং পেলব দুটি বাহু উতলা করে তুলেছে তাকে।
হেনডারসনের চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনের খবর পেয়ে গেল মেয়েটা। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে, এখন থেকে আমরা দুজন একে অন্যের কাছে আর আপনি নই। তুমি!
এ তো আমার পরম সৌভাগ্য! তবে আমি চাই আরেকটু কাছে যেতে। স্বর্গের দেবী কি নাচবে আমার সাথে?
চতুর ভ্যাম্পায়ার! চলো, ও ঘরে যাই।
হাতে হাত রেখে পার্লারে ঢুকল ওরা। হাসি-আনন্দে ভরপুর উৎসব। ঘর জুড়ে নেশার তরলের ছড়াছড়ি। তবে নাচের প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না কারও। জোড়া জোড়া নারী-পুরুষ ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে খোশগল্পে মশগুল। উৎসবের রীতি অনুযায়ী ছদ্মবেশধারীরা ঘরের কোণে নানান রঙঢঙে মত্ত। হেনডারসন ঘরে ঢোকা মাত্রই ভারী হয়ে উঠল আনন্দমুখর পরিবেশ।
হেনডারসন যখন ভরা আসরের মাঝখানে গিয়ে আলখাল্লার প্রান্ত ঝটকা মেরে কাঁধে তুলল, অদ্ভুত একটা প্রতিক্রিয়া দেখা গেল সবার মাঝে। ধ্যান গম্ভীর নীরবতা নেমে এল ঘরে। বড়ো বড়ো পা ফেলে এগোতে এগোতে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল হেনডারসনের কুটিপূর্ণ চেহারা। শীলাকে দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটাকে বিরাট একটা তামাশা হিসেবে নিয়েছে সে।
ওদের দেখিয়ে দাও, ভ্যাম্পায়ার কাকে বলে! ফিক্ করে হাসল শীলা। শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরল হেনডারসনের বাহু। উৎসাহে প্রভাবিত হলো হেনডারসন। যুগলদের দিকে শ্যেনদৃষ্টি হানতে হানতে এগিয়ে গেল সে। বিশেষ করে মেয়েদের বিকট মুখভঙ্গি করে ভয় দেখাল। অতিথিদের ঝটিতি ঘাড় ফেরানো, তাৎক্ষণিক মৃদু আর্তনাদ-এসব বুঝিয়ে দিল হেনডারসনের উদ্দেশ্য কতটা সফল। মূর্তিমান বিভীষিকার মতো লম্বা ঘর জুড়ে বিচরণ করছে সে। পেছন থেকে ক্রমাগত ফিসফাস্ আসছে তার কানে।
লোকটা কে?
আমাদের সাথেই এলিভেটরে এসেছে, এবং সে…
তার চোখ দুটো দেখেছ…
সাক্ষাৎ রক্তচোষা!
হ্যালো, ড্রাকুলা! মার্কাস লিন্ডস্ট্রোম এবং ক্লিওপেট্রার বেশধারী এক গোমড়া মুখো শ্যামলা মেয়ে এগিয়ে এল হেনডারসনের দিকে। দুজনেই বেসামাল। ক্লাবে যখন লিন্ডস্ট্রোম স্বাভাবিক থাকে, লোকটাকে তখন ভালোই লাগে হেনডারসনের। কিন্তু পার্টি বা উৎসবে লোকটাকে সহ্য করা মুশকিল। যেমন-এ মুহূর্তে তাকে আর যাই হোক ভদ্র বলা যাবে না।
প্রিয় বন্ধুগণ, ঘোষণা দেয়ার ভঙ্গিতে চেঁচাল লিন্ডস্ট্রোম। এই হ্যালোইনের রাতে আমার অত্যন্ত প্রিয় এক বন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি আপনাদের সাথে। কাউন্ট ড্রাকুলা এবং তার মেয়েকে দাওয়াত করেছিলাম। তারাই এখন আপনাদের সামনে উপস্থিত। কাউন্টের দাদিকেও আসতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি জেমিমা ফুপুকে নিয়ে আরেকটা পার্টিতে গেছেন। আসুন, কাউন্ট, আমার ছোট্ট খেলার সাথিটির সাথে কথা বলুন।
ওহ, ড্রাকুলা! অবাক হওয়ার ভান করল মেয়েটি। কী বড়ো বড়ো চোখ আপনার! কত বড়ো বড়ো দাঁত! ও-ওহ–
অন্য কোনো সময় হলে লিন্ডস্ট্রোমের চোয়ালে ধাই করে একটা ঘুসি মেরে বসত হেনডারসন। কিন্তু এই হাসিখুশি পরিবেশে এতগুলো লোকের সামনে এমন কাজ করাটা মোটেও সমীচিন হবে না। তা ছাড়া শীলা আছে পাশে। এরচে উজবুক লোকটার স্থূল রসিকতায় তাল দেয়াই ভালো। হ্যাঁ, সে পিশাচই একটা!
মেয়েটার দিকে ফিরে মুচকি হাসল হেনডারসন। তারপর ঋজুভঙ্গিতে সমবেত অতিথিবৃন্দের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করল সে। হাত দুটো ঘষল আলখাল্লায়। আশ্চর্য, কাপড়টা এখনও ঠান্ডা! নিচের দিকে তাকাতেই প্রথমবারের মতো তার নজর পড়ল, আলখাল্লার শেষ প্রান্তে ময়লা লেগে আছে। জমাট ধুলো কিংবা কাদা। ভালো করে দেখার জন্যে আলখাল্লার নিচের দিকটা লম্বা একটা হাত দিয়ে টেনে তুলল সে। কিন্তু বুক পর্যন্ত তোলার পর পিছল ঠান্ডা সিল্ক হাত ফস্কে পড়ে গেল। বেশ অনুপ্রাণিত দেখাল তাকে। তার চোখ দুটো আরেকটু বড়ো এবং জুলজুলে হলো।
ফাঁক হয়ে গেল মুখ। অদ্ভুত একটা ইন্দ্রিয়শক্তি ভর করল তার ওপর। মার্কাস লিন্ডস্ট্রোমের নরম, মোটা গলার দিকে তাকাল সে। সাদা চামড়ায় নীল শিরা ফুটে আছে। ঘরভর্তি লোক তাকিয়ে আছে তার দিকে। অনুভূতিটা এবার পুরোপুরি গ্রাস করল তাকে। ভাঁজ ভাঁজ চামড়ার গলার ওপর চোখ দুটো স্থির হলো। একজন মোটা মানুষের তুলতুলে গলা!
হেনডারসনের হাত দুটো বেরিয়ে এসেছে। লিন্ডস্ট্রোম ভীত ইঁদুরের মতো চি চি করে উঠল। তেল চৰ্চকে নাদুসনুদুস ইঁদুরের মতো লাগছে লোকটাকে। রক্তে ঠাসা শরীর। পিশাচেরা রক্ত পছন্দ করে। কিচমিচ করা ধাড়ি ইঁদুরের গলার শিরা থেকে বের হওয়া রক্ত!
উষ্ণ রক্ত! মনের প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দিল হেনডারসন। কণ্ঠের গভীর থেকে বেরোল কথাটা।