সবার ওপর এক পলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল হেনডারসন। প্রত্যেকেই নিঃসন্দেহে দেখতে সুন্দর। চমৎকার স্বাস্থ্য এবং প্রাণ প্রাচুর্যেরও কমতি নেই। তাদের আছে উপযুক্ত সতেজ গলা এবং ঘাড়। পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির পেলব হাত দুটির দিকে তাকাল হেনডারসন। কোন কারণ ছাড়াই একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। তারপর সংবিত্তি ফিরতেই দেখে এলিভেটরের আরোহীরা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এককোণে। যেন তার সাজ পোশাক আর অভিব্যক্তি দেখে তারা আতঙ্কিত। তাদের কথাবার্তা বন্ধ।
সবাই কেমন চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে। পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু যেন বলতে চায় সে। কিন্তু তার আগেই এলিভেটরের দরজা খুলে গেল। একে একে বেরিয়ে এল সবাই।
একধরনের অস্বস্তি খচখচ করছে হেনডারসনের মনে। কোথাও ভুল হচ্ছে না তো। প্রথমে ড্রাইভার ভয় পেল, তারপর এরা। পানের মাত্রাটা কি বেশি হয়ে গেছে?
কিন্তু এ নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবতে পারল না হেনডারসন। মার্কাস লিন্ডস্ট্রোম তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির। হাতে একটা গ্লাস ধরিয়ে দিতে চাইছে সে।
আমরা তা হলে এই করতে এসেছি? হালকা সুরে বিদ্রূপ করল হেনডারসন। আরে, তুমি তো টলছ!
লিন্ডস্ট্রোম যে মদের নেশায় চুর, একবার তাকিয়েই যে কেউ বুঝবে। মোটা মানুষটা অ্যালকোহলে সাঁতার কাটছে।
ড্রিংক নাও, হেনডারসন। আমি আর নেব না। তবে তোমার সাজগোজ দেখে চমকে গেছি ভাই। কোত্থেকে এমন মেকআপ নিলে?
মেক-আপ? আমি তো মুখে কিছুই মাখিনি।
ওহ্, তাই তো। কী বোকা আমি!
লিন্ডস্ট্রোমও ঘাবড়ে গেল নাকি? তার চোখ দুটোও কি শঙ্কায় পরিপূর্ণ? অবাক হয়ে গেল হেনডারসন–এতই ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে তাকে!
দাঁড়াও, ওদিকে একটু ঘুরে আসি, খানিক ইতস্তত করে দ্রুত সটকে পড়ল লিন্ডস্ট্রোম। ব্যস্ত হয়ে পড়ল অন্যান্য অতিথিদের নিয়ে। তার ঘাড়ের পেছনটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল হেনডারসন। কী পুরু আর সাদা! চামড়ার ভাঁজ ঝুলে পড়েছে কলারের ওপর দিয়ে। একটা নীল শিরা ফুটে আছে ভীত লিন্ডস্ট্রোমের ঘাড়ে।
হেনডারসন বাইরের ঘরে একা দাঁড়িয়ে। ভেতর থেকে গান-বাজনা আর হাসির শব্দ আসছে। বেশ কোলাহলমুখর উৎসব। ভেতরে ঢুকতে একটু দ্বিধা হচ্ছে হেনডারসনের। হাতের গ্লাসটাতে চুমুক দিল সে। বাকর্ডি রাম। কড়া পানীয়। সহজেই নেশা ধরে যায়। চুমুক দিতে দিতে ব্যাপারটা তলিয়ে দেখল হেনডারসন। সে ভয়াল একটা রূপ ধরতে চেয়েছে ঠিকই, কিন্তু সবাই এভাবে আতঙ্কে সিটিয়ে যাক–এতটা চায়নি। সত্যিই এই পোশাকের বিশেষ কোনো ক্ষমতা আছে? পিশাচের আসল রূপ ফুটে উঠেছে তার মাঝে? লিন্ডস্ট্রোম পর্যন্ত চমকে উঠে মেক-আপের কথা বলেছে। আচ্ছা, চেহারাটাই আগে দেখা যাক।
হলঘরের লম্বা প্যানেল মিররের দিকে এগোল হেনডারসন। একটু উঁকিঝুঁকি মেরে সোজা হয়ে দাঁড়াল চৌকো আয়নার সামনে। পেছন থেকে আসা উজ্জ্বল আলোয় আয়নার কাঁচের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল সে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না।
আয়নার সামনে সে জলজ্যান্ত বিদ্যমান, অথচ প্রতিবিম্ব পড়েনি! এটা কী করে সম্ভব?
চোখ দুটো ডলে নিয়ে আবার তাকাল সে। ফল একই। প্রতিবিম্ব নেই।
চাপা গলায় হেসে উঠল হেনডারসন। তার কণ্ঠের গভীর থেকে বেরোল এই খলখলে হাসি। ফাঁকা আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রমেই : উঁচুতে চড়ল হাসি। হাসিতে কুটিল আনন্দ।
ভালো নেশা ধরেছে, অস্ফুটে বলল হেনডারসন। একটু আগে তবু ঝাপসা প্রতিবিম্ব দেখেছি, আর এখন তো দেখতেই পাচ্ছি না। নেশার জন্যই চেহারাটা ভীষণ হয়েছে। ভয় পাচ্ছে সবাই।
প্লিজ, একটু সরে দাঁড়াবেন!
একটা সুরেলা কণ্ঠে চমক ভাঙে হেনডারসনের। ঝট করে পেছনে ফেরে সে। তার মতোই কালো পোশাক মেয়েটির। ফর্সা গর্বিত মুখ। মাথায় ঝিকমিকি করছে রেশমের মতো চুলগুলো। নীল চোখে অপার্থিব দ্যুতি। ঠোঁট জোড়া টুকটুকে লাল। স্বর্গের দেবী সেজেছে মেয়েটি।
হেনডারসন নরম কণ্ঠে শুধল, কে আপনি?
শীলা ডারলিং। দয়া করে সরে দাঁড়ালে নাকে একটু পাউডার ঘষতাম।
স্টিফেন হেনডারসন অবশ্যই সরে দাঁড়াবে, হাসল সে। পিছিয়ে এসে জায়গা ছেড়ে দিল মেয়েটিকে।
হেনডারসনকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি মুখ টিপে হেসে বলল, এর আগে কাউকে পাউডার নিতে দেখেননি?
দেখেছি, তবে প্রসাধনীর প্রতি স্বর্গ-সুন্দরীদের এরকম আসক্তির কথা জানতাম না। অবশ্যি স্বর্গের দেবীদের সম্পর্কে খুব কমই জানি। এখন থেকে বিশেষভাবে জানতে চেষ্টা করব তাদের। এই হচ্ছে মোক্ষম সুযোগ। হয়তো উৎসবের পুরোটা সময়ই আপনার পেছনে নোটবুক হাতে দেখতে পাবেন আমাকে।
ভ্যাম্পায়ারের হাতে নোটবুক!
হ্যাঁ, আমি খুব বুদ্ধিমান ভ্যাম্পায়ার সেকেলে ট্রানসিলভেনিয়ানদের মতো নই। এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি, আমার সঙ্গ ভালো লাগবে আপনার।
হু আমারও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু স্বর্গের দেবীর সাথে রক্তচোষা-জুটিটা কেমন বেমানান হয়ে যাচ্ছে না!
সে আমরা মানিয়ে নেব, ভরসা দিল হেনডারসন। তা ছাড়া আপনার মাঝেও তো অশুভ ছায়া রয়েছে। ধরুন এই কালো আলখাল্লাটা। এটার জন্যই আপনাকে মনে হচ্ছে ডার্ক-অ্যানজেল। যেন স্বর্গের বদলে আমার জায়গা থেকে এসেছেন।
রসালাপে মজে গেলেও হেনডারসনের মাথায় ঝড়ো বেগে অন্য চিন্তা চলছে। অতীতের সেই বিতর্কের দিনগুলোকে স্মরণ করছে সে। গ্রিসের প্রাচীন দর্শনে কী প্রচণ্ড বিশ্বাসই না ছিল তার!