নিখুঁত ছদ্মবেশ! বিড়বিড় করে বলল বুড়ো। আয়নায় কোন প্রতিবিম্ব পড়েনি বুড়োর। নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকায় ব্যাপারটা টের পেল না হেনডারসন।
এটা নেব আমি, বলল হেনডারসন। বলো, কত দেব?
আমি নিশ্চিত, এই পোশাকে উৎসবে গেলে দারুণ মজা পাবেন।
আরে, দেব কত তাই বললো।
তা ডলার পাঁচেক দিলেই চলবে।
এই নাও।
ডলার পাঁচটা নিয়ে আলখাল্লাটা হেনডারসনের গা থেকে খুলে নিল বুড়ো। পোশাকটা কাঁধ থেকে নেমে যেতেই আবার স্বাভাবিক উষ্ণতা অনুভব করল হেনডারসন। দীর্ঘদিন বেসমেন্টের শীতল গহ্বরে ছিল বলেই হয়তো কাপড়টা অমন বরফের মতো ঠান্ডা-ভাবল সে।
পোশাকটা ভাঁজ করে সহাস্যে হেনডারসনকে বুঝিয়ে দিল বুড়ো।
কালকেই এটা ফিরিয়ে দেব, প্রতিশ্রুতি দিল হেনডারসন।
দরকার নেই। এখন থেকে ওটা আপনার।
মানে?
খুব শিগগিরই ব্যবসা গোটাচ্ছি আমি। কাজেই পোশাকটা রেখে দিলে আমার চেয়ে আপনিই বেশি কাজে লাগাতে পারবেন।
কিন্তু–
কোন কিন্তু নয়, হেনডারসনকে থামিয়ে দিল বুড়ো। বিদায় জানাবার ভঙ্গিতে বলল, সন্ধেটা আপনার জন্যে আনন্দময় হয়ে উঠুক।
মনে একরাশ জড়তা নিয়ে রওনা হলো হেনডারসন। দরজা পর্যন্ত গিয়ে বুড়োকে বিদায় জানাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল সে। বুড়োর চোখের পাতা ধীর লয়ে খুলছে, বন্ধ হচ্ছে। কাউন্টারের ওপাশ থেকে আরেক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে হেনডারসনের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সে দৃষ্টির আঁচ অনুভব করল না হেনডারসন। সে বুড়োকে শুভরাত্রি জানিয়ে দরজাটা ঝট করে ভিজিয়ে দিয়ে রাস্তায় নামল। যেতে যেতে অবাক হয়ে ভাবল, এ কোন্ পাগলামো করতে যাচ্ছে সে!
.
রাত আটটায় হেনডারসন টেলিফোনে লিন্ডস্ট্রোমকে জানাল, পৌঁছুতে একটু দেরি হবে তার। আলখাল্লাটা গায়ে চাপাতেই আবার সেই ঠান্ডা ভাবটা চলে এল। নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার জন্য আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। তার দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে এল বার বার। আবছা একটা কায়া ছাড়া কিছু দেখতে পেল না আয়নায়। অল্প একটু ড্রিংক করার পর খানিকটা চাঙা বোধ করল হেনডারসন। গরম হয়ে উঠল গা। ড্রিংকস ছাড়া আর কিছু মুখে দিল না সে। ফ্লোর জুড়ে রক্তচোষা পিশাচের মহড়া দিয়ে বেড়াল কিছুক্ষণ। বাদুড়ে রূপান্তরিত হওয়ার ভঙ্গিতে বার বার আলখাল্লার নিচের দিকটা ঝটকা মেরে কাঁধে তুলল ভ্রুকুটিপূর্ণ ভয়াল মূর্তিতে। এই ভয়ঙ্কর খেলায় প্রচুর আনন্দ পেল হেনডারসন। সত্যিই তা হলে একটা পিশাচ হতে যাচ্ছে সে!
কিছুক্ষণ পর লবিতে গিয়ে একটা ক্যাব ডাকল হেনডারসন। এগিয়ে এল ক্যাব। আলখাল্লা গুটিয়ে অপেক্ষা করছিল হেনডারসন, ক্যাবের চালক সেটা দেখামাত্র কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
ভাড়া যাবে? নিচু কণ্ঠে শুধাল হেনডারসন।
কো-কো কোথায়? ভয়ে গলা থেকে বেসুরো স্বর বেরোল তার।
প্রচণ্ড হাসি পেল হেনডারসনের। কিন্তু হাসল না। বহু কষ্টে চেপে রেখে ভুরু কুঁচকে তীর্যক কটাক্ষ হানল লোকটার দিকে। আলখাল্লার নিচের প্রান্ত ঝটকা মেরে পেছনে তুলল।
যা-যা-যা-যাব! আসুন!
যেন পালাতে পারলে বাঁচে ড্রাইভার। হেনডারসন বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে গেল।
কোথায় যাব, ব-বস্-মানে, সা-স্যার? তোতলাতে তোতলাতে জানতে চাইল সে।
কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব ফ্যাসফ্যাসে বানিয়ে ঠিকানাটা বলল হেনডারসন। তারপর গাড়ির পেছনে গিয়ে বসল। ভীত ড্রাইভার ভুলেও আর তার দিকে তাকাল না।
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করল ক্যাব। ড্রাইভারের ভয়চকিত ভাব দেখে হাসি আর চেপে রাখতে পারল না হেনডারসন। তার অট্টহাসি শুনে আরও ঘাবড়ে গেল ড্রাইভার। সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি ছোটাল সে। তার কান্ড দেখে হেনডারসনের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার যোগাড়। আর ওদিকে ড্রাইভার বেচারা রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে। হেনডারসনকে জায়গামতো পৌঁছে দিয়ে হাঁফ ছাড়ল সে। ভাড়া না নিয়েই কেটে পড়ল দ্রুত।
যাক, খাসা হয়েছে ছদ্মবেশটা! মনে মনে আত্মতৃপ্তি লাভ করল হেনডারসন। উৎসবে বেশ সাড়া জাগানো যাবে। ফুরফুরে মেজাজে এলিভেটরে গিয়ে উঠল সে। এগিয়ে চলল লিন্ডস্ট্রোমের ঢালু ছাদের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে।
এলিভেটরে হেনডারসন একা নয়, আরও তিন-চারজন আছে। লিন্ডস্ট্রোমের অ্যাপার্টমেন্টে এর আগেও এদের দেখেছে সে। কিন্তু একজনও তাকে চিনতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে না। উৎসাহ বেড়ে গেল হেনডারসনের। তার মেকি মুখভঙ্গি এবং অদ্ভুত আলখাল্লাটা আমূল বদলে দিয়েছে তাকে। আর এদের দেখো। দামি জবরজং পোশাকে একেকজনের ছদ্মবেশের কী বাহার! স্প্যানিশ ব্যালেরিনা সেজেছে এক মহিলা, এক লোক পরেছে বুল-ফাইটারের পোশাক, অন্য দুজন পুরুষ-মহিলারও ভিন্ন রকম সাজ। তা যে বেশই ধরুক তারা, আসল চেহারা ঢাকতে পারেনি কেউ। হেনডারসন ভালো করেই জানে, ছদ্মবেশটা আসলে তাদের কাছে তেমন কিছু নয়। উৎসবে হাজির হওয়াটাই বড়ো। বেশিরভাগ মানুষই কসটিউম-পার্টিতে আসে তাদের অবরুদ্ধ ক্ষুধার্ত বাসনাগুলোর বাস্তবায়ন ঘটাতে। মেয়েরা আসে তাদের অঙ্গসৌষ্ঠব দেখাতে, পুরুষেরা দেখাতে চায় পৌরুষ-বুল-ফাইটার। কিংবা সার্কাসের ভাঁড়েরা যেমন দেখায়। এসব একদম বিচ্ছিরি লাগে হেনডারসনের। বাপুরা, বীরগিরি দেখাবে ভালো কথা। তা ঘরের ভেতর কেন? সাহস থাকে তো রাস্তায় নামো। তখন অত ভয় কীসের?