একটা কসটিউমের দোকানের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে সে–নরকের কোনো ফাটল দিয়ে নয়। তা হলে ডিসপ্লেটা অমন গনগনে লাল দেখাচ্ছে কেনো? থরে থরে সাজানো মুখোশগুলো কী ভীষণ দেখাচ্ছে এই আলোতে! যেন একদল পিশাচ দাঁত বের করে হাসছে।
গোধূলির রঙ, নিজেকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল হেনডারসন। আসলে মুখোশগুলোর সাজানোর ঢঙই এরকম। তবু গা ছমছম করতে থাকে কল্পনাপ্রবণ লোকটার। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে সে।
জায়গাটা অন্ধকার এবং নীরব। ঘরের বাতাসে একাকীত্বের গন্ধ-যে গন্ধ নিরন্তর বিরাজ করে পৃথিবীর সব সমাধি, গভীর অরণ্য, আর দুর্গম পাহাড়ের গুহায় গুহায়। এবং-ধুশ-শালা! নিজের ওপর আবার রুষ্ট হলো হেনডারসন। আজ কী হয়েছে তার? ফাঁকা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে হাসল সে। নিজেকে সান্ত্বনা দিল, এটা আর কিছু নয়, কসটিউম-শপের গন্ধ। গন্ধটা তাকে কলেজের সেই শখের নাটকের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। এই ন্যাপথলিন, জীর্ণ পশম, তেল আর রঙের গন্ধের সাথে তার পরিচয় অনেকদিনের। হ্যামলেট নাটকে অভিনয়ের সেই দৃশ্যগুলো মনে করতে করতে অজান্তেই একটা দাঁত কেলানো মাথার খুলি তুলে নিল সে।
সংবিৎ ফিরতেই খুলিটা তার মাথায় চমকপ্রদ একটা ফন্দি যোগাল। এই হ্যালোইনের রাতে অন্য সবার মতো রাজা, তুর্কীবীর কিংবা জলদস্যু সেজে উৎসবে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তার। সাধারণ ছদ্মবেশে লিন্ডস্ট্রোন্ডের ওখানে গেলে কেউ তাকে পাত্তাই দেবে না। তা ছাড়া লিন্ডস্ট্রোমও মনঃক্ষুণ্ণ হবে। কারণ তার সোসাইটির বন্ধুরা আসবে দামী পোশাকে ছদ্মবেশ নিয়ে। হেনডারসন অবশ্য লিন্ডস্ট্রোমের ওই কৃত্রিম বন্ধুদের তেমন একটা তোয়াক্কা করে না। আসবে তো সব মেয়েলি স্বভাবের পুরুষ, আর মণি-মুক্তাখচিত ভারি গহনা পরা রমণীরা। তাদের ভড়কে দিয়ে হ্যালোইনের প্রাণসঞ্চার করতে ভয়ঙ্কর একটা কিছু সাজবে না কেনো সে?
.
অপেক্ষায় থেকে হাঁপিয়ে উঠল হেনডারসন। পেছনের ঘর থেকে আলো নিয়ে আসছে না কেউ। মিনিট কয়েক পর ধৈর্য হারিয়ে ফেলল সে। কাউন্টারে সজোরে হাত চাপড়ে চেঁচাল, কে আছ! এদিকে এসো!
প্রথমে নীরবতা, তারপর অস্পষ্ট একটা নড়াচড়ার শব্দ শোনা গেল পেছনে। কী বিচ্ছিরি! একটু পরেই নিচের সিঁড়িতে পৌঁছাল শব্দটা। থপ্ থপ থপ করে ভারি পা ফেলে উঠে আসছে কেউ। সহসাই হাঁ করে শ্বাস টানল হেনডারসন। কালোমতো কী একটা বেরিয়ে আসছে মেঝে খুঁড়ে!
আসলে ওটা বেসমেন্টের ট্র্যাপডোর। এইমাত্র খুলল। ল্যাম্প হাতে এক লোক বেরিয়ে এসে কাউন্টারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। ল্যাম্পের আলোয় হলদেটে দেখাচ্ছে মুখ। ঘুম জড়ানো চোখে পাতা পড়ছে ঘন ঘন।
লোকটা মৃদু হেসে নরম কণ্ঠে বলল, দুঃখিত, একটু ঘুমোচ্ছিলাম। তা আপনার জন্যে কী করতে পারি, স্যার?
হ্যালোইনের কসটিউম খুঁজছি আমি।
ও, আচ্ছা। তা কী ধরনের কসটিউম চাই আপনার?
কণ্ঠস্বরটা ক্লান্ত, খুবই ক্লান্ত। হলুদ চেহারায় নিস্তেজ একটা ভাব। চোখ দুটোতে ঘুমের রেশ কাটেনি এখনও।
প্রচলিত সাজের বাইরে একটা ছদ্মবেশ নিতে চাই আমি। মানে উৎসবে গিয়ে সবাইকে একটু ভড়কে দিতে চাই আর কী।
কিছু মুখোশ দেখাতে পারি আপনাকে।
আরে না, নেকড়ে মানব সাজার কোনো শখ নেই আমার। আমি চাই এমন একটা পোশাক, যা দেখে লোকে ছদ্মবেশটাকেই আসল রূপ মনে করে ভয় পাবে।
তা হলে সত্যিকারের পোশাক চাইছেন আপনি!
হ্যাঁ। হেনডারসনের মনে ক্ষীণ একটা সন্দেহ উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল। সত্যিকারের পোশাক বলতে কী বোঝাতে চাইছে মাথামোটা লোকটা?
সেরকম একটা পোশাক বোধহয় দিতে পারব, স্যার। চোখ পিট পিট করে বলল সে। তার ঠোঁট জোড়ার ভঁজে হাসির রেখা। জিনিসটা শুধু হ্যালোইনের জন্যেই।
কী রকম?
রক্তচোষা পিশাচের কথা ভেবেছেন কখনও?
ড্রাকুলার মতো?
জ্বী, জ্বী ড্রাকুলা।
আইডিয়াটা মন্দ নয়। কিন্তু আমাকে ওই পোশাকে মানাবে তো?
আঁটো হাসি ফুটল লোকটার মুখে। হেনডারসনের আপাদমস্তক জরিপ করে বলল, খুব মানাবে।
বেঢপ প্রশংসা! বিদ্রুপের ভঙ্গিতে হাসল হেনডারসন। তা কোথায় সেই সাজ-পোশাক?
সাজ-পোশাক? এটা তো শুধুই একটা পোশাক। তাও রাতের।
রাতের?
জ্বী, এজন্যেই তো দিচ্ছি।
কী সেটা?
একটা আলখাল্লা। একেবারে আসল!
একটা আলখাল্লা-ব্যস, এই?
জী, সার। শুধুই একটা আলখাল্লা। কিন্তু ওটা পরলে মনে হবে শবের কাফন। দাঁড়ান, নিয়ে আসছি।
নড়বড়ে পা দুটো টেনে টেনে আবার দোকানের পেছনে চলে গেল লোকটা। ট্র্যাপোর খুলে নেমে গেল নিচে। হেনডারসন দাঁড়িয়ে রইল
অপেক্ষায়। নিচে আগের চেয়ে আরও বেশি খুটখাট দুমদাম হচ্ছে।
শিগগিরই ফিরে এল বুড়ো। হাতে একটি আলখাল্লা। অন্ধকারে ঝাঁকুনি দিয়ে আলখাল্লা থেকে ধুলো ঝাড়ল সে। তারপর বলল, এই নিন-আসল জিনিস।
আসল?
গায়ে দিলেই টের পাবেন। আশ্চর্য একটা ক্ষমতা আছে এটার, বিশ্বাস করুন!
ঠান্ডা, ভারী কাপড়টা কাঁধে চাপাল হেনডারসনের। পেছনে এসে আয়নায় নিজেকে দেখার সময় ছত্রাকের পুরোনো একটা অস্বস্তিকর গন্ধ পেল সে। আলখাল্লা থেকে আসছে। মৃদু আলো, তবু নিজের চেহারার অদ্ভুত পরিবর্তন নজর এড়াল না হেনডারসনের। তার লম্বাটে মুখটা আরও সরু দেখাচ্ছে, ফ্যাকাসে চেহারার মাঝে জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো। সমস্তই এই কালো পোশাকের জাদু। একটা বড়সড় কালো কাফন এটা।