মাঝের ওই নিতল গহ্বরের দিকে!
হা ঈশ্বর! আর তো পরিত্রাণের পথ নেই। ওরা আমাকে এই কারাগারে এনেছিল একটাই উদ্দেশ্যে–পাতাল-কূপে ফেলে দেবে বলে। দু-দুবার ওদের ফাঁকি দিয়েছি। এবার আর রক্ষা নেই। তেতে-লাল লোহার দেওয়াল বারকয়েক ঘঁাকা দিয়ে ফোঁসকা তুলে গেল গায়ে। দম আটকে আসছে উগ্র কটু গন্ধে। পেছনের দুই দেওয়াল ক্রমশ এগিয়ে এসে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। অতলান্ত ওই বিভীষিকার দিকে…
কুয়োয়
কি আছে ওই কুয়োয়? কেন ওরা আমাকে ওরা ফেলে দিতে চায় কুয়োর গর্ভে? উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে উঁকি মেরেছিলাম তলদেশে। শিহরণের পর শিহরণ ঘূর্ণিপাকের মতো আর্বত রচনা কবে আমাকে ছিটকে সরিয়ে এনেছিল কুয়োর পাড় থেকে।
যা দেখেছি, তা আর যেন ইহজীবনে দেখতে না হয়। আগুনের লাল আভা সিলিং থেকে ঠিকরে গিয়ে প্রদীপ্ত করে তুলেছিল কুয়োর তলদেশ। সেখানে বিরাজ করছে যে বিভীষিকা, তা কল্পনায় আনার ক্ষমতা আছে শুধু নরকের বাসিন্দাদের সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করবার জন্যে প্রস্তুত হয়নি পার্থিব চোখ…করাল ওই বিভীষিকার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আশঙ্কাই তো বিকৃত করে দেওয়াল পক্ষে যথেষ্ট!
আমি তাই ছিটকে সরে এসেছিলাম পেছনে–পরক্ষণেই তপ্তলৌহ দেয়ালের ছ্যাকা খেয়ে কাতরে উঠে আছড়ে পড়েছিলাম সামনে। পেছানোর আর জায়গা নেই। হয় চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে জ্যান্ত ঝলসাতে হবে–নয়তো পাতাল-কূপের মরণাধিক শৈত্যবরণ করতে নিতে হবে!
আমি যখন টলছি…ঠিক সেই সময়ে যেন সহস্র দামামা ধ্বনিত হলো বাইরে কোথায়…সম্মিলিত কণ্ঠের বজ্ররোষ বুঝি বিদীর্ণ করে দিল দূর গগন…পাষাণ মেঝের ওপর লোহা টেনে নিয়ে যাওয়ার কর্কশ নিনাদে ঝালাপালা হয়ে গেল কানের পর্দা…টলে গিয়ে কুয়োর গর্ভে যখন পড়ে যাচ্ছি–শক্ত হাতে কে যেন আমার বাহুমূল খামচে ধরে টেনে নিয়ে এল মৃত্যু গহ্বরের কিনারা থেকে।
এসে গেছেন জেনারেল লাসালে। টোলাডো দখল করেছে ফরাসি সৈন্য। ব্যর্থ হয়েছে চক্রান্ত!
রক্তচোষা
রক্তলাল রঙ ছড়িয়ে পাহাড়ের ওপারে ডুব দিচ্ছে সূর্য। ধারাল বাতাসের তাড়া খেয়ে ঝরে পড়া শুকনো পাতাগুলো পশ্চিমে এমনভাবে ধেয়ে যাচ্ছে, যেন সূর্যের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে যাচ্ছে ওগুলো।
নিজেকে জড়বুদ্ধির লোক বলে তিরস্কার করল হেনডারসন। থমকে দাঁড়িয়ে মগ্ন হলো ভাবনায়। আঁধার নামতে আর বেশি দেরি নেই। সস্তা কল্পনায় গা ভাসিয়ে কী লাভ?
মাথামোটা? আবার বলল হেনডারসন। চিন্তাটা সম্ভবত দিনের বেলায়ই তার মাথায় আসে, এবং তখন থেকেই সে আনমনা। হ্যালোইনের ভয়াল রাত আজ। পৃথিবীর সব গোরস্থানে জেগে উঠবে মৃতেরা। আত্মাগুলো বেরিয়ে আসবে কবর ছেড়ে।
অন্যান্য দিনের মতোই আরেকটা ঠান্ডা, পচা দিন আজ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল হেনডারসন। এমন একটা সময় ছিল, আপনমনে ভাবল সে, যখন এ রাত আসা মানেই ছিল ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার। অশুভ আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠত গোটা অন্ধকার ইউরোপ। অজানা ত্রুর হাসির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হতো এই সন্ধে। অশুভ দর্শনার্থীদের ভয়ে রুদ্ধ হতো একটার পর একটা দরজা, একান্ত প্রার্থনায় বিভোর হতো অগণিত মানুষ, ঘরে ঘরে জ্বলে উঠত লক্ষ লক্ষ মোম। চিন্তাভাবনায় আঁকাল একটা ব্যাপার ছিল তখন, গভীরভাবে উপলব্ধি করল হেনডারসন। রোমাঞ্চে পরিপূর্ণ ছিল সেই জীবন। মধ্যরাতের পথচারীরা সিঁটিয়ে থাকত আতঙ্কে, না জানি কী আছে সামনের বাঁকটায়। ভূত-পিশাচ আর অপদেবতার জগতে বাস করে আত্মাকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করত তারা। সে সময় বিশেষ একটা তাৎপর্য ছিল মানুষের আত্মার। এখন দিন বদলেছে। নাস্তিক্য এসে দূরে ঠেলে দিয়েছে আগের সেই ধারনাকে। মানুষ আগের মতো আর শ্রদ্ধা করে না তার আত্মাকে। তবু এই বিংশ শতাব্দীতেও ছাড়া ছাড়া কিছু ঠুনকো বিশ্বাস আঁকড়ে আছে মানুষ, যেগুলো তাদের কল্পনার ডানা মেলতে গিয়ে বার বার হোঁচট খায়।
বেকুব! অজান্তেই আবার বলে উঠল হেনডারসন। আসলে তার মানব সত্তাকে হটিয়ে দিয়ে ভিন্ন একটা সত্তা ঠাঁই নিয়েছে মাথায়। পাছে প্রেতলোকের ওই জীবগুলো তার গোপন পরিকল্পনার কথা জেনে ফেলে, এই ভয়ে বার বার নিজেকে ভর্ৎসনা করছে সে। ওদের রক্তচক্ষু ফাঁকি দেয়ার একটা প্রাণপণ চেষ্টা আর কী।
রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কসটিউমের একটা দোকান খুঁজছে হেনডারসন। জমকালো একটা পোশাক চাই তার। আজ রাতের ছদ্মবেশ-উৎসবে পরতে হবে। দেরি হলে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্যে হ্যালোইন নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করতে রাজি নয় সে।
সরু গলির দুপাশে সারি বেঁধে দাঁড়ানো দালানগুলোতে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে অনুসন্ধান করছে হেনডারসন। আঁধার ক্রমশ ছায়া ফেলছে দালানগুলোর গায়ে। ফোন-বুকে টানা হাতে লেখা ঠিকানাটার দিকে আবার তাকাল সে। কিন্তু আলোর স্বল্পতায় পড়তে পারল না। বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকাল হেনডারসন। সন্ধে নামা সত্ত্বেও হতচ্ছাড়ার দল দোকানগুলোতে আলো দিচ্ছে না কেনো ? এই দরিদ্র ঘিঞ্জি এলাকায় খোঁজাখুঁজি করতে আসাটাই একটা ঝক্কির ব্যাপার, কিন্তু তবু–
হঠাৎ করেই সেই দোকানটা পেয়ে গেল হেনডারসন। রাস্তার ঠিক ওপারেই। রাস্তা পেরিয়ে দোকানের জানালায় গিয়ে দাঁড়াল সে। উঁকি দিল ভেতরে। অস্তগামী সূর্যের শেষ আলো এসে দালানের কপালে তির্যকভাবে পড়ে সড়াৎ করে নেমে এসেছে জানালা আর ডিসপ্লেতে। চেপে রাখা ধারাল শ্বাসটুকু টেনে নিল হেনডারসন।