সহসা আমি নিশ্চল হয়ে যেতে নিশ্চয় ধোঁকায় পড়েছিল মাংসলোভী ইঁদুর বাহিনী। রান্না মাংস ফুরিয়ে যাওয়ার পর আমার কাঁচা মাংস তো রয়েছেই। এরকম কাঁচা নরমাংস এর আগেও ওরা অনেক খেয়েছে। কিন্তু আমি যে এখনো মরিনি, অথচ চুপচাপ শুয়ে রয়েছি–হাতও নাড়ছি না–এই অবস্থাটা বুঝতেই যেটুকু সময় ওরা নিয়েছিল। তারপরেই ডাকাবুকো দু-একটা বেড়ে ইঁদুর গন্ধে গন্ধে উঠে এসে দাঁত বসালো চর্বি মাখা পাটিতে।
দেখাদেখি এল বাকি সবাই। দেখতে দেখতে ঝাঁকে ঝাঁকে ছেয়ে ফেলল আমার সর্বাঙ্গ। হেঁটে গেল আমার গলার ওপর দিয়ে ঠোঁট মেলালো আমার ঠোঁটের সঙ্গে। কী কষ্টে যে নিজেকে ওই পূর্তিগন্ধময় বিবরবাসীদের সান্নিধ্যে রেখেও স্থির হয়েছিলাম, তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না।
সুচতুর শয়তানের দল নখর বসিয়ে বসিয়ে আমার চোখ মুখ, কান, গলা, পা হাত দিয়ে হেঁটে গেলেও বুকের ঠিক যেখানে খড়গের কোপ নেমে আসছে–পা দিল না সেখানে। টের পেলাম পাটির নানান জায়গায় কুট কুট করে দাঁত বসছে…পাটি খসেও পড়ছে নানান জায়গায়–তবুও আমি নড়লাম না…জোরে নিঃশ্বাস ফেললাম না–অমানষিক প্রচেষ্টায় নিজেকে নিশ্চল রেখে দিলাম।
খড়গ কিন্তু ইতিমধ্যে আরও নেমে এসেছে। আলখাল্লা কেটে কেটে যাচ্ছে। স্নায়ুর মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলাম চামড়ায় পরশ বুলিয়ে যাওয়ার। বাঁ হাতের এক ঝটকায় ফেলে দিলাম সমস্ত ইঁদুর। খচমচ শব্দে হটে গেল হতচকিত বিবরবাসীরা। অতি সন্তপর্ণে একপাশে সরে গিয়ে খসিয়ে নিলাম একটার পর একটা বাঁধন। তারপর একেবারেই গেলাম কাঠের ফ্রেমের বাইরে। খড়গের কোপ থেকে এখন আমি অনেক দূরে। আমি মুক্ত! সাময়িক হলেও স্বাধীন!
স্বাধীন হলেও খুনিগুলোর খপ্পর থেকে এখনও কিন্তু নিস্কৃতি পাইনি। তা সত্ত্বেও বিপুল উল্লাসে অট্টহাসি হেসে যখন নৃত্য করছি পাষাণ কারাগারে, ঠিক সেই সময়ে স্তব্ধ হলো মারণ-দোলকের দুলুনি–অদৃশ্য এক শক্তি তাকে টেনে তুলে নিল সিলিং-এর কাছে। এই দেখেই চরম শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল আমার। নরকের পিশাচগুলো তাহলে আড়াল থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে উপভোগ করছিল আমার প্রতি মুহূর্তের মরণাধিক যন্ত্রণা!
এ স্বাধীনতা তাহলে টিকবে কতক্ষণ? একটার পর একটা অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সরিয়ে দিচ্ছি–পরক্ষণেই ততোধিক যন্ত্রণার যন্ত্র হাজির করছে পিশাচ-হৃদয় বিচারকরা। নিঃসীম আতঙ্কে কাঠ হয়ে গিয়ে জুল জুল করে তাকিয়ে ছিলাম চারপাশের চার দেওয়ালের দিকে। প্রথমে যা টের পাইনি–এখন তা শিহরণের ঢেউ তুলে দিয়ে গেল আমার প্রতিটি স্নায়ুর ওপর দিয়ে।
বিচিত্র একটা পরিবর্তন আসছে ঘরের আকৃতিতে। পরিবর্তনটা কী, তা ধরতে পারছি না। কিন্তু তা আঁচ করতে গিয়েই ঠকঠক করে কাঁপছে আমার সর্বাঙ্গ। ভয়ের ঘোরের মধ্যে দিয়ে সেই প্রথম আবিষ্কার করলাম গন্ধক-দ্যুতির উৎস।
এ আলো আসছে আধ ইঞ্চি ফাঁকা থেকে। চারটে দেওয়াল যেখানে মেঝেতে লেগে থাকার কথা সেখানে রয়েছে আধ ইঞ্চি ফাঁকা; অর্থাৎ চারটে ধাতব দেওয়ালই ঝুলছে মেঝে থেকে আধ ইঞ্চি ওপরে; গন্ধক-দ্যুতি তার অনির্বান আভা নিক্ষেপ করে গেছে এতক্ষণ এই ফাঁকার মধ্যে দিয়ে। ভয়ে বুক টিপটিপ করছিল বলে সাহস হলো না ফাঁকা দিয়ে উঁকি মেরে ওদিকের দৃশ্য দেখার। তারপর অবশ্য চেষ্টা করেছিলাম। মাটিতে উপুড় হয়ে উঁকি মারতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুই দেখতে পাইনি।
উঠে দাঁড়িয়ে আচমকা দেওয়ালের চেহারা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ আগে আবছাভাবে আঁচ করেছিলাম, কোথায় যেন কী পালটে যাচ্ছে। পরিবর্তনের স্বরূপ আন্দাজ করতে গিয়েই অজানা আতঙ্কে প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। এখন স্বচক্ষে দেখলাম সেই পরিবর্তন। আগেই বলেছি, এ ঘরের লোহার দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা কিন্তু উদ্ভট বিদঘুঁটে বীভৎস মূর্তি–তারা কেউই পার্থিব প্রাণি নয়, অদৃশ্য লোকের আততায়ী প্রত্যেকেই তাদের বিকট চেহারা এতক্ষণ প্রকট হয়ে ওঠেনি রঙ ফিকে হয়ে গিয়েছিল বলে।
এখন সেই নিষ্প্রভ দানবদল উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে। প্রতিটি রঙের রেখা সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। কোটরাগত নারকীয় চোখে দেখা দিয়েছে স্ফুলিঙ্গ।
হ্যাঁ, সত্যিই আগুন লকলকিয়ে উঠছে অবয়ব। দেওয়াল তেতে উঠছে, লাল হয়ে উঠছে, লোহা তেতে লাল হয়ে গেলে ঠিক যা হয়!
জানোয়ার! জানোয়ার! এরা মানুষ না পশু! এভাবেই শেষে নিকেশ করতে চায় আমাকে! দু-দুবার ওদের পাতা মৃত্যুর ফাঁদ টপকে গিয়ে বেঁচে গেছি–তাই এবার চার দেওয়ালের দানবদের লেহিহান করে তুলছে লোহা তাতিয়ে দিয়ে। উৎকট বাষ্পে দম নিতেও কষ্ট হচ্ছে আমার। তীব্র আঁচে চামড়া ঝলসে যাবে মনে হচ্ছে।
উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে আগুনের আঁচ। চার দেওয়ালের দানবদল লোল জিহা আর আগুন চোখ মেলে যেন আরও কাছে এগিয়ে আসছে। দৃষ্টি বিভ্রম নাকি?
আঁতকে উঠলাম পরক্ষণেই ঘরের আর একটা নারকীয় পরিবর্তন দেখে। ঘরটা ছিল চৌকোনা। এখন তা দ্রুত বরফির মতো হয়ে যাচ্ছে বিপরীত দুটো কোণ ছোটো হচ্ছে যে হারে, মুখোমুখী অন্য দুটো কোণ বড়ো হচ্ছে সেই একই হারে। দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে মেঝের ছোটো হয়ে যাওয়া–সঙ্কীর্ণ হচ্ছে বরফি মেঝে–দুদিক থেকে আগুন রাঙা দেওয়াল আমাকে ঠেলে নিয়ে চলেছে….