খুটখাট খড়মড় আওয়াজ শুনেই চোখ ঠিকরে এসেছিল মেঝের দিকে। ডানদিকের কোনো গর্ত থেকে পালে পালে ধেড়ে ইঁদুর আগুন-রাঙা বুভুক্ষু চোখে ধেয়ে আসছে মাংসখন্ডর দিকে। অতি কষ্টে খাবার বাঁচালাম শয়তানদের ধারালো দাঁতের খপ্পর থেকে। তাড়িয়েও দিলাম কুচুটে করাল প্রাণি বাহিনীকে।
প্রায় আধঘণ্টা পরে (একঘণ্টাও হতে পারে–সময়ের হিসেব রাখার কোনো উপায় তো ছিল না), ওপরে সিলিং-এর দিকে চাইতেই খটকা লেগেছিল। স্পষ্ট দেখলাম, পেন্ডুলাম আরও বেশি দুলছে–প্রায় গজখানেক জায়গা জুড়ে দুলেই চলেছে। হতভম্ব হলাম (ভয়ার্তও হলাম) পেন্ডুলামের চেহারা দেখে। নিচের দোলকটা একটা ভারি ক্ষুরের মতো ধারালো কাস্তে ছাড়া কিছুই নয়। দুপাশের শিংয়ের মতো উঁচু হয়ে থাকা অংশ দুটোর নিচের দিকে মস্ত দোলকটার নিচের অংশ বাঁকানো ফলক-যা বাতাস কেটে আসছে যাচ্ছে–সাঁ সাঁ শব্দে। রক্ত হিম হয়ে গেল আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে। শাণিত এই দোলক বেশ খানিকটা নিচেও নেমে এসেছে!
পিশাচসম ঘাতকরা তাহলে আমাকে দগ্ধে দন্ধে মারার নতুন প্ল্যান এঁটেছিল। এ গহ্বরে যাদের আটক রাখা হয়, তাদেরকে মারা হয় তিল তিল করে–এটা আমি জানি। ওরা তাই কুয়োয় নিজেরাই ছুঁড়ে দেয়নি—আমাকে–ভেবেছিল আমিই হেঁটে গিয়ে ঢুকে যাব নিঃসীম অন্ধকারে আমার সেই পতন-দৃশ্য দেখার জন্যেই ওপরের দরজা ফাঁক করেছিল নিমেষের জন্যে। যখন দেখল, কপাল জোরে বেঁচে গেছি–তখন আয়োজন হয়েছে আর এক মানসিক অত্যাচারের। ধারালো দোলকের দুলে দুলে নেমে আসা! অমানুষ না হলে এমন অভিনব ফন্দী কারও মাথায় আসে!
কত ঘণ্টা, কত দিন যে এই নির্মম মানসিক ধকল সয়ে গিয়েছিলাম, সে হিসাব দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। সভয়ে বিস্ফারিত চোখে শুধু দেখেছিলাম, ঘণ্টায় ঘণ্টায়, দুলে দুলে, রক্তলোলুপ খড়গ নেমে আসছে নিচের দিকে। নামতে নামতে এসে গিয়েছিল বুকের এত কাছে। যে, ইস্পাতের গন্ধ ভেসে আসছিল নাকে।
দমকে দমকে, এক এক ঝটকান দিয়ে, ধারালো খড়গ আমার নাকের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে গেছে ইস্পাতের শীতল গন্ধ–মৃত্যুর হাতছানি প্রকট হয়ে উঠেছিল তার মধ্যে। নির্মিশেষে সেই দুলন্ত মৃত্যুদূতকে ঘণ্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন দেখতে দেখতে সহসা আমি সর্বাঙ্গ এলিয়ে দিয়ে শিথিল হয়ে পড়েছিলাম। আসন্ন ঝকমকে মুত্যুকে দেখে অকস্মাৎ প্রশান্তির ঢল নেমেছিল আমার প্রতিটি রক্তকণায়।
বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ আর কোনো খেয়াল ছিল না। মর্মান্তিক যাতনা থেকে মুক্তি পেয়েছি দেখে অন্তরালের পিশাচ ঘাতকরা নিশ্চয় মুষড়ে পড়েছিল। তাই পেন্ডুলামের দুলুনিও বন্ধ করে রেখেছিল। কতখানি বিকট কুটিল মন থাকলে এইভাবে হত্যা করার ইচ্ছেটা হয়, সে ভাবনারও। আর সময় পাইনি; কেননা, খড়গ-দোলক আবার দুলতে শুরু করেছিল। আবার সাঁই সাঁই শব্দে বাতাস কেটে আমার বুকের ঠিক ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল লৌহ-কারাগারের এদিক থেকে সেদিকে–প্রায় তিরিশ ফুট জায়গা জুড়ে অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছে দুলুনি…নামছে একটু একটু… লক্ষ্যস্থল আমার বুকের মধ্যপ্রদেশ।
এ অবস্থায় ক্ষিদে তেষ্টা উড়ে যাওয়ার কথা। আমার কিন্তু পেট চুঁইয়ে উঠেছিল। বাঁ হাত বাড়িয়ে মাংসের টুকরো ধরে মুখের কাছে টেনে এনেছিলাম। ইঁদুর শয়তানরা বেশির ভাগই খেয়ে গেছে। খেতে গিয়েও বিদ্যুতের মতোই একটা বুদ্ধি ঝলসে উঠেছিল মাথার মধ্যে। ক্ষীণ আশার প্রদীপ টিমটিম করে উঠেছিল মগজে। স্নায়ুমন্ডলী বুঝি নৃত্য করে উঠেছিল এই আশার স্নান আভায়। কাঠ হয়ে পড়ে থেকে ছলছল করে দেখে গিয়েছিলাম খড়গের আনাগোনা
ডানে বাঁয়ে…ডানে বাঁয়ে…দুলে দুলে বাতাস কেটে কেটে লোলুপ খড়গ নামছে শনৈঃ শনৈঃ…তালে তালে আমি অট্টহাসি হাসছি উন্মাদের মতো–কখনো হুঙ্কার দিচ্ছি বিকৃত উল্লাসে…।
নামছে…নামছে…রক্তপিপাসু খড়গ নামছে তো নামছেই…বিরামহীন ছন্দে নির্ভুল লক্ষ্যে নেমে আসছে আমার বক্ষদেশ লক্ষ্য করে…এসে গেছে ইঞ্চি তিনেক ওপরে…আর একটা নেমে এসে প্রথমেই কাটবে আমার আলখাল্লা…আলখাল্লার ওপর আছে পাটির বাঁধন…একটাই পাটি দিয়ে পেঁচিয়ে বাধা হয়েছে কাঠের ফ্রেমের সঙ্গে…এক জায়গা কেটে গেলেই বাঁ হাত দিয়ে টেনে সমস্ত বাঁধন খসিয়ে ফেলতে পারব? আশা আমার সেটাই। কিন্তু…পটি বুকের ওপর আছে তো? খড়গের ফলক বুকের যেখানটা আগে স্পর্শ করবে–পাটি কি সেখানে আছে? মাথা উঁচু করে দেখেছিলাম বুক। নেই। পাটি নেই বুকের ঠিক সেই জায়গায়! পাটি আছে আশপাশে-খড়গ যেখানে বুক কাটবে- সেই জায়গায় রাখা হয়নি পটির ফাস।
ইঁদুরের দল তখন আমাকে হেঁকে ধরেছে। কনুই পর্যন্ত বাঁ হাত আলগা করে এতক্ষণ মাটির থালার ওপর হাত নেড়ে নেড়ে ওদের ঠেকিয়ে রাখছিলাম। একটু একটু করে বেপরোয়া হয়ে উঠছিল বুভুক্ষুর দল। রক্তরাঙা চোখে ধারালো দাঁত দেখিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল আমার হাতের ওপর। আঙুলে কামড় বসিয়ে টুকরো টুকরো খেয়ে যাচ্ছিল থালার মাংস। মাংস আর নেই এখন। আছে শুধু চর্বি। আচমকা আবার আশার বিজলী চাবুক মেরে চালু করে দিয়েছিল আমার ভয়-নিস্তেজ মগজকে। হাত বাড়িয়ে চর্বি তুলে নিয়ে মাখিয়ে দিয়েছিলাম পটিতে। তারপর হাত রেখেছিলাম বুকের ওপর। শুয়েছিলাম মড়ার মতো নিস্পন্দ দেহে। আকুল প্রতীক্ষায় নিঃশ্বাস ফেলতেও বুঝি ভুলে গিয়েছিলাম।