হেনরি তার গাড়ি থামাল। ও বিয়ারের কেস তুলছে, আমি নিচের সিঁড়ির বোতামটা চেপে ধরলাম। দোতলার ল্যান্ডিং বাল্ব জ্বলে উঠবে। কিন্তু জ্বলল না। টিমি ঠিকই বলেছে সবগুলো বাল্ব ভেঙে রেখেছে ওর বাবা।
বার্টি কাঁপা গলায় বলল, আমি বিয়ার নিয়ে যাই। তুমি পিস্তল রেডি রাখো।
আপত্তি করল না হেনরি। পিস্তল বাগিয়ে আগে আগে চলল। আমি ওর পিছনে, আমার পিছনে বিয়ার হাতে বার্টি। দোতলার ল্যান্ডিং-এ উঠে এলাম, গন্ধের তীব্রতা বাড়ল আরও। পচা আপেলের গন্ধ।
প্রতিবেশীরা এই লোকটাকে লাথি মেরে দূর করে দিচ্ছে না কেন? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
কীসের প্রতিবেশী? পাল্টা প্রশ্ন করল হেনরি। এ গন্ধে ভূত পালাবে। কে যাবে ওকে লাথি মেরে দূর করে দিতে?
তিনতলায় উঠছি আমরা। এ তলার সিঁড়িগুলো আগেরগুলোর চেয়ে সরু এবং খাড়া। গন্ধে নাড়িভুড়ি উল্টে আসার জোগাড়। উপরতলায় ছোটো একটি হলো, একটা দরজা দেখতে পেলাম, দরজার মাঝখানে ছোটো একটি ফুটো। বার্টি প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, দেখো, কীসের মধ্যে এসেছি।
হলঘরের মেঝেতে থকথকে পিচ্ছিল একটা জিনিস, ছড়িয়ে আছে সমস্ত জায়গায়। ছোটো ছোটো গর্ত এখানে-সেখানে। মনে হলো মেঝেতে এক সময় কার্পেট পাতা ছিল, কিন্তু ধূসর জিনিসটা ওটা খেয়ে ফেলেছে।
হেনরি দরজার সামনে গেল, আমরা ওর পিছু নিলাম। বার্টির কথা জানি না, তবে ভিতরে ভিতরে ভয়ানক কাঁপুনি উঠে গেছে আমার। হেনরি পিস্তল দিয়ে বাড়ি মারল দরজায়। রিচি? ডাকল সে, কণ্ঠ শুনে মনে হলো না একচুলও ভয় পেয়েছে। যদিও মুখ কাগজের মতো সাদা। আমি নাইট আউল-এ হেনরি পার্মালি। তোমার বিয়ার নিয়ে এসেছি।
পুরো এক মিনিট কোনও সাড়া নেই, তারপর বলে উঠল একটা কণ্ঠ, টিমি কোথায়? আমার ছেলে কই? ভয়ের চোটে প্রায় দৌড় দিতে যাচ্ছিলাম। ওটা মোটেই মানুষের কণ্ঠ নয়। ঘরঘরে, অপার্থিব, ভৌতিক একটা আওয়াজ।
ও আমার দোকানে আছে, বলল হেনরি। খানা খাচ্ছে। ও না খেতে পাওয়া বেড়ালের মতোই হাড্ডিসার হয়ে গেছে।
এক মুহূর্ত কিছুই শোনা গেল না, তারপর ভয়ঙ্কর একটা ঘরঘরে শব্দ ভেসে এল। আত্মা কাঁপিয়ে দেয়া গলাটা দরজার ওপাশ থেকে বলল, দরজা খুলে বিয়ারটা ভিতরে ঠেলে দাও। আমি খুলতে পারব না।
এক মিনিট, বলল হেনরি। এ মুহূর্তে তোমার কী অবস্থা, রিচি?
তা দিয়ে তোমার দরকার নেই, বলল কণ্ঠটা, বিয়ার দিয়ে চলে যাও।
মরা বেড়ালে আর চলছে না, তাই না? বলল হেনরি। হাতে বাগিয়ে ধরল পিস্তল।
বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল হেনরির কথাটা শুনে। গত তিন সপ্তাহে দুটি তরুণী আর এক বুড়ো সৈনিক নিখোঁজ হয়েছে–সকলেই সন্ধ্যার পরে।
হয় বিয়ার দাও, নয়তো আমি নিজেই বেরিয়ে আসব, বলল ভয়ঙ্কর কণ্ঠ। হেনরি আমাদেরকে ইশারা করল পিছু হঠতে। আমরা তাই করলাম। ইচ্ছে হলে আসতে পারো, রিচি, পিস্তল ক করল হেনরি।
ঠিক তখন প্রচণ্ড ধাক্কায় খুলে গেল দরজা। বেরিয়ে এল রিচি। তারপর এক সেকেন্ড, মাত্র এক সেকেন্ড দৃশ্যটা দেখলাম, তারপর তিন তলা থেকে লাফাতে লাফাতে নিচে চলে এলাম আমি আর বাৰ্টি একেকবারে চার/পাঁচটা সিঁড়ি টপকে। বরফের উপর ডিগবাজি খেয়ে পড়লাম। হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দিলাম ছুট।
ছুটতে ছুটতে শুনলাম হেনরির পিস্তলের আওয়াজ। পরপর তিনবার। আমি এক বা দুই সেকেন্ডের জন্য যে দৃশ্য দেখেছি তা জীবনেও ভুলব না। জেলির প্রকান্ড একটা ঢেউ, অনেকটা মানুষের আকারের: থকথকে, পিচ্ছিল একটা জিনিস পিছনে ফেলে এগিয়ে আসছিল।
তবে ওর চেয়েও ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল। ওটার চোখ হলুদ, বুনো, আর সমতল, তাতে মানুষের আত্মার চিহ্ন নেই। তবে চোখ দুটো নয়। চারটে। জিনিসটা মাঝখানে, দুজোড়া চোখের মধ্যে সাদা, আঁশের মতো গোলাপি মাংসখণ্ড কিলবিল করছিল।
ওটা ভাগ হয়ে যাচ্ছিল একটা থেকে দুটো। আমি আর বার্টি দোকানে ফিরে এলাম একটি বাক্য বিনিময় না করে। জানি না ও কী ভাবছে, তবে আমার দুই ঘরের নামতা মনে পড়ে যাচ্ছিল। দুদুগুণে চার, চার দুগুণে আট দুদুগুণে ষোলো, মোলো দুগুণে…।
আমাদেরকে দেখে লাফিয়ে উঠল কার্ল আর বিল পেলহ্যাম। ঝড়ের বেগে প্রশ্ন করতে লাগল। তবে দুজনের কেউ কিছু বললাম না। অপেক্ষা করছি হেনরির জন্য। ও ফিরে আসে নাকি তাই, দেখব। আশা করি হেনরিই ফিরে আসবে।
উন্মাদ
মরচে ধরা লোহার গেটটা ধাক্কা দিল রোজালিন। কা-আ-আচ শব্দে খুলে গেল ওটা। সদর দরজার দিকে পা বাড়াল রোজালিন। দরজার মাথায় লাইলাকের ঘন ঝাড় ঝুলছে; গন্ধটা মিষ্টি তবে কেমন যেন দম বন্ধ করে দেয়।
পেতলের ভারী কড়া ধরে নাড়ল রোজালিন। কয়েক সেকেণ্ড পরে খুলে গেল দরজা।
রোজালিন, সত্যি তুই? কত্ত বড়ো হয়ে গেছিস! চেনাই যাচ্ছে না! ওকে জড়িয়ে ধরলেন হ্যারিয়েট ফুপু। তাঁর গা থেকেও লাইলাকের গন্ধ আসছে।
কেমন আছ, ফুপু? জিজ্ঞেস করল রোজালিন।
ভাল। আয়, ভেতরে আয়, মা। গরমে একদম ঘেমে গেছিস। ঘরে ঠাণ্ডা আছে।
রোজালিন ফুপুর পিছু পিছু একটি বড়ো, অন্ধকার হলওয়েতে ঢুকল। মাটির নিচের গুহার মতোই শীতল হলঘর।
কতদিন পরে দেখলাম তোকে! পনেরো বছর তো হবেই। ট্রেনে কোনো কষ্ট হয়নি তো? জবাবের অপেক্ষা না করে বকবক করেই যেতে লাগলেন ফুপু। তোর বাবাকে কতবার লিখেছি তোকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। তোর বাবা তোর ফুপাকে পছন্দ করে না জানি। কিন্তু তোর ফুপাও তো মারা গেছে চার বছর হলো… বিরতি দিলেন হ্যারিয়েট ফুপু। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আর্থার আত্মহত্যা করেছে চার বছর হলো। রোজালিন নিজের পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকল। কী বলবে বুঝতে পারছে না। বাবা ওকে বলেছেন হ্যারিয়েট ফুপু একটু অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ। ঠিকই বলেছেন।