পণ করেছিলাম, এই দেওয়ালের আশ্রয়েই থাকব এখন থেকে। মরতে হয় এখানেই মরব–নিতল গহ্বরের আতঙ্কঘন তলদেশে আছড়ে পড়ার চেয়েও তা শতগুণে শ্রেয়। যেহেতু গহ্বরের তলায় কী আছে তা জানি না–তাই অজানা বিভীষিকার কল্পনা ডালাপালা মেলে ধরে পঙ্গু করে তুলল আমার মস্তিষ্ককে। না জানি এই কারাগারের নানা দিকেই এই ধরনের আরও কত কুৎসিত আর বীভৎস মৃত্যুর ফাঁদ পেতে রেখে দিয়েছে অমানুষ জল্লাদরা। আমার মনের অবস্থা তখন যদি অন্য রকম হতো, তাহলে বোধহয় গহ্বরে ঝাঁপ দিয়েই সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে দিতাম। সেটাও যে সহজতর হতো–সে ভাবনাও কুরে কুরে খাচ্ছিল মাথার কোষগুলোকে। কেনো, আমি তো শুনেছি, এই পাতাল-কারাগারের যাদের আনা হয়–নিমেষ মৃত্যু তাদের কপালে লেখা থাকে না, এদের পৈশাচিক প্ল্যানই হলো একটু একটু করে মানরা কয়েদীকে প্রক্রিয়াগুলো শুনলেও নাকি গায়ের রক্ত পানি হয়ে যায়। নিদারুণ উত্তেজনায় জেগেছিলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তারপর ঘুম নামল চোখে। ঘুম ভাঙার পর হাতের কাছেই পেলাম এক জগ জল আর এক টুকরো রুটি। প্রথমবার যখন ঘুমে বেহুশ হয়েছিলাম, তখনও এই দুটো জিনিস পেয়েছিলাম ঘুম ভাঙার পরেই। এখনও কেউ এসে রেখে গেছে আমাকে ঘুমে অচেতন দেখে–আড়াল থেকে তাহলে দেখছে আমার মৃত্যু যন্ত্রণা! পিশাচ কোথাকার!
ক্ষিদের চোটে কোঁৎ কোঁৎ করে গিলে নিয়েছিলাম রুটি, ঢকঢক করে খেয়েছিলাম পানি। তারপরেই আশ্চর্য ঘুম নামল দুচোখে। নিশ্চয় ঘুমের আরক শিােনো ছিল পানিতে। ঘুমালাম তাই মড়ার মতো। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম, বলতে পারবো না। তবে ঘুম যখন উড়ে গিয়েছিল চোখের পাতা থেকে–তখন আশপাশের দৃশ্য আর ততটা অদৃশ্য থাকেনি। যেন গন্ধক-দ্যুতির মধ্যে দিয়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল প্রতিটি বস্তু। বিচিত্র এই প্রভাব উৎস কোথায়, প্রথমে তা ঠাহর করতে পারিনি–কেননা আমি তখন আবিষ্ট হয়ে দেখছিলাম কারাগারের চেহারা।
ভুল করেছিলাম কারাগারের সাইজের আন্দাজি হিসেবে। দেওয়ালের পরিধি পঁচিশ গজের বেশি হবে কোনমতে। ছোটো হলেও পরিত্রাণের পথ যখন নেই, তখন খামোখা তা নিয়ে আর ভেবে লাভ কী। তাই ছোটোখাটো ব্যাপারগুলোর দিকে কৌতূহল জাগ্রত করেছিলাম। পরিধির মাপে হিসাব ভুল করেছিলাম কীভাবে, তাও বুঝেছিলাম।
প্রথমবারে প্রায় এক চক্কর ঘুরে এসে হোঁচট খেয়ে পড়েছিলাম উলের কয়েক পা দূরেই। তারপর টেনে ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠেই আবার উলটোদিকে হেঁটেছিলাম। ঘুমের ঘোরে বাঁ দিকে না গিয়ে ডানদিকে হেঁটেছিলাম। তাই দ্বিগুণ মনে হয়েছিল গহ্বরের বেড়।
কারাগারের আকৃতি নিয়েও ভুল ধারণা করেছিলাম। হাত বুলিয়ে বুলিয়ে (ঘুমের ঘোরে) যেগুলোকে কোণ বলে মনে হয়েছিল–আসলে তা খাঁজ। অজস্র খাঁজকাটা দেওয়াল। দেওয়াল ঢুকে রয়েছে এই সব খাজের মধ্যে। অন্ধকারে তাই মনে হয়েছিল, দেওয়াল বুঝি গোল হয়ে ঘুরে গেছে। এখন আর সে বিভ্রান্তি নেই। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, ঘরটা চৌকোনা। দেওয়ালও পাথর দিয়ে তৈরি নয়। লোহা বা অন্য কোনো ধাতু দিয়ে গড়া। অজস্র কিম্ভূত ছবি আঁকা রয়েছে চার দেওয়ালেই। কুসংস্কারে ডুবে থাকা মঠের সন্ন্যাসীদের মগজ থেকেই কেবল এরকম উদ্ভট কল্পনার আকৃতি সম্ভবপর হয়। প্রতিটি মূর্তিই অপার্থিব, অমানুষিক, পৈশাচিক–কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেই মাথার মধ্যে ঘোর লেগে যায়–রক্ত হিম হতে শুরু করে। যদিও পাতালের স্যাঁৎসেঁতেনির জন্যে বিদঘুঁটে আকৃতিদের রঙ ফিকে হয়ে এসেছে–বিকট অবয়বগুলোও আর তেমন স্পষ্ট নয়। তা সত্ত্বেও যা দেখতে পাচ্ছি ওই অপার্থিব আলো যার মধ্যে দিয়ে–তার প্রতিক্রিয়াতেই তো আমার মাথার চুল খাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
পাথুরে মেঝের ঠিক মাঝখানে রয়েছে পাতাল কূপ। গোটা ঘরে গহ্বর ওই একটাই। গোলাকার।
আমি চিৎ হয়ে শুয়ে আছি একটা কাঠের কাঠামোর ওপর। ঘুমে অচেতন থাকার সময়ে আমাকে এই অবস্থায় আনা হয়েছে। মজবুত পাটি দিয়ে এই কাঠামোর সঙ্গে আমাকে পেঁচিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। বেরিয়ে আছে শুধু মুন্ডু আর বাঁ হাতের একটুখানি–যাতে কষ্টেসৃষ্টে হাত বাড়িয়ে মাটির থালায় রাখা মাংস টেনে নিয়ে মুখে পুরতে পারি।
পানির জগ উধাও। ভয়ানক ব্যাপার সন্দেহ নেই। কারণ, তেষ্টায় আমার ছাতি ফেটে যাচ্ছে। তেষ্টা আরও বাড়বে ওই মাংস খেলে–কারণ ওতে প্রচুর ঝালমশলা চর্বি দেওয়া হয়েছে পিপাসা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে। অথচ জল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যন্ত্রণা সৃষ্টির আর এক পরিকল্পনা! কশাই কোথাকার!
এরপর তাকিয়েছিলাম কারাগার-কক্ষের কড়িকাঠের দিকে। প্রায় তিরিশ চল্লিশ ফুট ওপরে দেখতে পাচ্ছি ধাতুর চাদর দিয়ে মোড়া সিলিং–দেওয়াল চারটে যেভাবে তৈরি, প্রায় সেইভাবে। দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল একটাই জিনিস। মহাকালের একটা প্রতিকৃতি। তবে গতানুগতিক কাস্তে নেই হাতে। তার বদলে রয়েছে একটা দোলক। ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো। দোলকটা যেন একটা ক্ষুরধার কাস্তে। ঠায় চেয়েছিলাম বলেই মনে হয়েছিল, শাণিত কাস্তে যেন অল্প অল্প দুলছে। চোখের ভুল ভেবে আরও খুঁটিয়ে চেয়েছিলাম। এবার আর ভুল বলে মনে হয়নি। কাস্তে-দোলক সত্যিই দুলছে। খুব আস্তে। চোখ সরিয়ে নিয়ে তাকিয়েছিলাম দেওয়ালের অন্যান্য দৃশ্যের দিকে।