এক ঝটকায় দুচোখের পাতা খুলে ফেললাম আর সইতে পারলাম না বলে। নিঃসীম অন্ধকার। পাতাল কারাগার নিশ্চয়। মেঝে তো পাথরের।
তবে কি আমাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে গেল? নিদারুণ ভয়ে ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠেছিলাম। দুহাত সামনে বাড়িয়ে টলেটলে গিয়েছিলাম। কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু সমাধি গহ্বরের দেওয়াল তো হাতে ঠেকবে।
ঠেকেছিল হাতে। পাথরের দেওয়াল নিশ্চয়। মসৃণ, হড়হড়ে, ঠান্ডা। হাত বুলিয়ে একপাক ঘুরে এসেছিলাম। প্রতি পদক্ষেপে গা শিরশির করে উঠেছিল। টোলোভো-র এই পাতাল কারাগারের অনেক গা-হিম-করা গল্লামাথায় ভিড় করে আসছিল। তাই পা টিপে টিপে অনেকক্ষণ যাওয়ার পর মনে হলো, গোল হয়েই ঘুরছি দেওয়াল ধারে।
কিন্তু শুরু করেছিলাম কোত্থেকে? পকেট হাতড়ালাম। ছুরিটা নেই। আমার নিজের জামাকাপড় নেই। আলখাল্লার মতো কী একটা পরিয়ে রেখেছে–অজ্ঞান অবস্থায় টের পাইনি। ছুরিটা থাকলে দেওয়ালের খাঁজে খুঁজে রেখে একপাক ঘুরে এসেই বুঝতে পারতাম–শুরু করেছিলাম কোথা থেকে।
আলখাল্লা থেকে একটা লম্বা উল টেনে নিলাম। বিছিয়ে রাখলাম মেঝের ওপর দেওয়াল থেকে একটু লম্ব ভাবে। মেঝেতে পা রগড়ে রগড়ে এক পাক ঘুরে আসতেই পা ঠেকল উলে।
কিন্তু-ক-পা হাঁটলাম? এমন কাহিল বোধ করছি যে মাথাও ঠিক রাখতে পারছি না। স্যাঁতসেঁতে হড়হড়ে মেঝের ওপর দিয়ে আবার পা রগড়ে এগোতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম। পড়েই রইলাম–এত অবসন্ন। ঘুমিয়ে পড়লাম ওই ভাবেই।
ঘুম ভাঙার পর আবার দেওয়াল ধরে টহল দেওয়া শুরু করলাম। মুখ থুবড়ে পড়ার আগে আটচল্লিশবার পা ফেলেছিলাম–এখন বাহান্নবার পা ফেলেই উলের ওপর এসে গেলাম। তার মানে, কারাগারের বেড় একশ পা। অর্থাৎ পঞ্চাশ গজ তো বটেই। তবে আকৃতিটা কীরকম, তা বুঝতে পারলাম না। হাত বুলানোর সময়ে অবশ্য অনেকগুলো কোণে হাত ঠেকেছিল। তা থেকে পাতাল-সমাধির আকার ধারণায় আনা যায়নি।
এই যে এত গবেষণা করে যাচ্ছিলাম, এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল সামান্য–আশা ছিল না একেবারেই। তবে একটা আবছা কৌতূহল আমাকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল নিরন্ধ্র এই তমিস্রার মধ্যে। প্রথম-প্রথম খুব হুঁশিয়ার হয়ে পা ফেলেছিলাম। কেন না, মেঝে তো শ্যাওলা হড়হড়ে রীতিমতো বিশ্বাসঘাতক। যদিও শক্ত মেঝে, তবুও পা ফেলতে ভয় হয়।
তারপর অবশ্য ভয় কেটে গিয়েছিল। ফটাফট পা ফেলে এগিয়ে গিয়েছিলাম–মতলব সমাধি গহ্বরের ব্যাস কতখানি, তা হেঁটে দেখে নেব। তাই আড়াআড়িভাবে হাঁটছিলাম সীমাহীন আঁধার ভেদ করে। দশ বারো পা এই ভাবে যাওয়ার পরেই, আলখাল্লা থেকে টেনে ছিঁড়ে নেওয়া উলের খানিকটা পায়ে জড়িয়ে যাওয়ায়, হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিলাম কঠিন শিলার ওপর।
ধড়াম করে আচমকা আছাড় খেয়েছিলাম বলেই চমকে দেয়ার মতো পরিস্থিতিটা সেই মুহূর্তে খেয়াল করতে পারিনি। সেকেন্ড কয়েক ওইভাবে মুখ থুবড়ে ধরাশায়ী থাকার পর ব্যাপারটা আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
ব্যাপারটা এই। আমার চিবুক কারাগারের পাথুরে মেঝেতে ঠেকে আছে ঠিকই, কিন্তু ঠোঁট আর মুখের ওপর দিকের অংশ কিছুই স্পর্শ করছে না। যদিও মনে হচ্ছে, থুতনি থেকে বেশ উঁচুতেই রয়েছে এরা-অথচ ছুঁয়ে যাচ্ছে না কিছুই। একই সঙ্গে মনে হচ্ছে যেন কপালে এসে লাগছে পাকের। বাষ্প–নাকে ভেসে আসছে পচা ফাঙ্গাসের অদ্ভুত গন্ধ।
দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম সামনে–শিউরে উঠেছিলাম তৎক্ষণাৎ। আমি মুখ থুবড়ে পড়েছি একটা গহ্বরের কিনারায়। সে গহ্বরের তলদেশ কোথায়, তা তো জানিই না–গোলাকার গহ্বরের পরিধি কতটা, তাও বোঝবার উপায় আমার নেই। কিনারার ধার থেকে হাতড়ে হাতড়ে এক টুকরো পাথর খসিয়ে এনে ফেলে দিয়েছিলাম গহ্বরের মধ্যে। গহ্বরের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে পাথরের টুকরো বেগে নেমে গিয়েছিল পাতাল-প্রদেশে–ধাক্কার শব্দ আর প্রতিধ্বনির ঢেউ তুলে এনে আছাড় দিয়ে দিয়ে ফেলে গিয়েছিল কানের পাতায়। তারপর পাথর নিজেই চাপা শব্দে গোত খেয়েছিল জলের মধ্যে–প্রবলতর প্রতিধ্বনি গুমগুম শব্দে ধেয়ে এসেছিল ওপর দিকে।
একই সঙ্গে আচমকা একটা শব্দ ভেসে এসেছিল মাথার ওপর দিক থেকে। ঠিক যেন একটা দরজা খুলেই বন্ধ হয়ে গেল। চকিতের জন্য আলোর রেখা নিরন্ধ্র আঁধারকে চমকিত করে দিয়ে আঁধারেই অদৃশ্য হয়ে গেল।
কী ধরনের মৃত্যুর ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছিল আমার জন্য; তা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠেছিলাম। নিজের গলার আওয়াজ শুনেও তখন চমকে উঠেছিলাম। দুধরনের মৃত্যুর ব্যবস্থা আছে শুনেছিলাম এই ভূগর্ভ কারাগারে। প্রথমটা নিষ্ঠুর নির্যাতন সইতে না পেরে যেন তিল তিল করে মরতে হয়। দ্বিতীয়টা আরও ভয়াবহ; আমাকে এই দ্বিতীয় মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল। আমার কপাল ভালো। তাই আর এক পা এগোইনি। মুখ থুবড়ে পড়েছিলাম বলেই গহ্বরের মধ্যে তলিয়ে যাইনি।
আতঙ্কে আমার প্রতিটি স্নায়ু থরথর করে কেঁপে উঠেছিল নারকীয় গহ্বরের তলিয়ে যাওয়ার পরের অবস্থাটা কল্পনা করতে গিয়ে। নিপীড়নের আরও অঢেল ব্যবস্থা নিশ্চয় মজুদ রয়েছে গহ্বরের তলদেশে–বেঁচে গেছি ভাগ্য সহায় হয়েছিল বলে।
টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। ঠক ঠক করে কাঁপছিল পা থেকে মাথা পর্যন্ত। কীভাবে যে হাতড়ে হাতড়ে পাথুরে দেওয়ালের পাশে ফিরে এসেছিলাম, তা শুধু আমি জানি আর ঈশ্বর জানেন।