সে দরজায় কড়া না নেড়েই ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, দুঃখিত। ভেবেছিলাম এটা আমার কামরা। বেরিয়ে যাচ্ছিল, কী মনে করে থমকে গিয়ে ইতস্তত গলায় জানতে চাইল, আপনি কি একা?
হ্যাঁ।
এটা–ব্যাপারটা অদ্ভুত। মানে ক্রিসমাস একাকী কাটানো, তাই না? আমি কি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?
নিশ্চয় পারো।
সে এসে আগুনের ধারে বসল।
আশা করি আপনি ভাবছেন না আমি কোনো মতলব নিয়ে এখানে এসেছি। আমি সত্যি ভেবেছিলাম এটা আমার রুম, ব্যাখ্যা দিল সে।
তুমি ভুল করেছ বলে আমি খুশি। কিন্তু তোমার মতো তরুণের তো ক্রিসমাসের সময় একা থাকার কথা নয়।
আমি দেশে যেতে পারিনি আমার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। তাহলে আমার কাজের ক্ষতি হতো। আমি একজন লেখক।
ও আচ্ছা, আমার মুখে হাসি এসে গেল। এরকম অস্বাভাবিক পেশার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল আর এ তরুণটি দেখছি নিজের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। তা তো বটেই, লেখালেখির মূল্যবান সময় নষ্ট করা উচিত নয়। আমি চোখ মটকে বললাম।
না, একটি মুহূর্তও নষ্ট করা উচিত নয়। কিন্তু আমার পরিবার বিষয়টি বুঝতে চায় না। তারা কোনটা জরুরি তা-ই জানে না।
সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে পরিবারের সহায়তা পাওয়া যায় খুব কম।
পাওয়া যায় না বললেই চলে, গম্ভীর গলায় বলল যুবক।
তুমি কী লিখছ?
কবিতা এবং ডায়ারি একযোগে। নাম রেখেছি মাই পোয়েমস অ্যান্ড আই। লেখক ফ্রান্সিস র্যাণ্ডেল। এটাই আমার নাম। আমার পরিবার বলে লেখালেখি করে কোনো লাভ নেই। বিশেষ করে এত কম বয়সে। কিন্তু নিজেকে আমি কম বয়সী বলে ভাবি না। মাঝে মধ্যে নিজেকে বয়োবৃদ্ধ বলে মনে হয়। মনে হয় অনেক কাজ বাকি থাকতেই না আবার মরে যাই।
সৃজনশীলের চাকায় দ্রুত গতি আনতে হবে।
ঠিক তাই। আপনি আসল কথাটি বুঝতে পেরেছেন। আপনি একদিন আমার লেখা পড়বেন। দয়া করে অবশ্যই পড়বেন! তার কণ্ঠে মরিয়ার সুর, চাউনিতে ভয় দেখে আমি বললাম :
ক্রিসমাসের দিনে আমরা বড় বেশি নিরানন্দ আচরণ করছি। তোমার জন্য একটু কফি বানিয়ে আনি? আমি কেক খাব।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠলাম। কফি চড়িয়ে দিলাম পারকোলেটরে। তবে আমার কথায় বোধহয় আঘাত পেয়েছিল ছেলেটি, ফিরে এসে দেখি সে চলে গেছে। আমি যারপরনাই হতাশ হলাম।
কফি বানিয়ে রুমটির বইয়ের তাকে চোখ বুলাতে লাগলাম। মোটা মোটা বইয়ের ভলিউম। বাড়িওয়ালি এজন্য আগেই আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বলেছিলেন : আশা করি বইপত্রে আপনার বিরাগ নেই, মিস। আমার স্বামী এগুলো ছুঁয়েও দেখেন না আর বইগুলো রাখবার জায়গাও পাচ্ছি না। এ কারণে এ কামরার ভাড়া আমরা একটু কম নিই।
বইতে আমার বিরাগ নেই, বললাম আমি। বই বরং আমার ভালো বন্ধু।
কিন্তু এ বইগুলোর চেহারাসুরত তেমন বন্ধুসুলভ মনে হচ্ছে না। আমি হাতের কাছে যা পেলাম তা-ই একখানা তুলে নিলাম। নাকি নিয়তিই আমাকে ওই বইটি তুলে নিতে বাধ্য করেছে?
কফিতে চুমুক দিতে দিতে আর সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আমি জীর্ণ চেহারার পাতলা বইটি পড়তে লাগলাম। এটির প্রকাশনাকাল ১৮৫২ সালের বসন্ত। মূলত কবিতার বই- কাঁচা হাতের লেখা তবে পরিচ্ছন্ন। তারপর দেখি ডায়ারির ঢঙে কিছু লেখাও রয়েছে। কৌতূহল নিয়ে ওতে চোখ বুলালাম। শুরুতেই লেখা ক্রিসমাস, ১৮৫১। আমি পড়তে লাগলাম :
আমার প্রথম ক্রিসমাস দিনটি কাটল একাকী। তবে আমার একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে। হাঁটাহাঁটি শেষে আমি যখন আমার লজিং হাউজে ফিরেছি, এক মধ্যবয়স্ক মহিলাকে দেখতে পেলাম। প্রথমে ভেবেছি বোধহয় ভুল করে ভুল কামরায় প্রবেশ করেছি। কিন্তু তা নয়। ভদ্রমহিলার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পরে হঠাৎ তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমার মনে হয় উনি ভূত ছিলেন। তবে আমি ভয় পাইনি। ওনাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল। তবে আজ রাতে আমার শরীরটা কেনো জানি ভালো লাগছে না। একদমই ভালো লাগছে না। এর আগে কোনোদিন ক্রিসমাসের সময় আমি অসুস্থ হইনি।
বইয়ের শেষ পাতায় প্রকাশকের একটি নোট রয়েছে :
ফ্রান্সিস র্যাণ্ডেল ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ক্রিসমাসের রাতে আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু বরণ করেন। এ বইতে যে ভদ্রমহিলার কথা বলা হয়েছে তিনিই ওকে সর্বশেষ জীবিত দেখেন। তাঁকে সামনে আসার আহ্বান জানালেও তিনি কোনোদিনই তা করেননি। তাঁর পরিচয় রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে।
মৃত্যুকূপ
ব্যারামে ধুঁকছিলাম। মরতে বসেছিলাম। যন্ত্রণায় মনের ভেতর পর্যন্ত মোচড় দিচ্ছিল। ওরা যখন আমার বাঁধন খুলে দিয়ে উঠে বসার অনুমতি দিল–মনে হলো, এই বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবো। প্রাণদন্ডের হুকুমটুকুই কেবল শুনতে পেয়েছিলাম। তারপর সব শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে বিচারকের ঠোঁটের রঙ দেখতে পেয়েছিলাম। সাদা হয়ে গেছে। নারকীয় নিপীড়নের এই দন্ড তাদের মুখ দিয়ে বের করতে গিয়েই অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। আমার তাহলে কী হবে। জ্ঞান হারালাম তারপরেই।
পুরোপুরি জ্ঞান ফেরার আগে আবছা একটা অনুভূতি মন আর শরীরের ওপর অসহ্য চাপ সৃষ্টি করেছিল। সব মনেও করতে পারছি না। বড়ো অস্পষ্ট। বুকের মধ্যে হৃৎপিন্ড যেন ফেটে যাচ্ছিল।
চোখ খুলিনি এতক্ষণ। তবে বুঝতে পারছিলাম, শুয়ে আছি চিৎ হয়ে। বাঁধন নেই। হাত বাড়ালাম। শক্ত আর ভিজে মতো কী যেন হাতে ঠেকল। কী হতে পারে জিনিসটা, এই ভাবনাতেই কয়েক মিনিট কাটিয়ে দিলাম। চোখ মেলার সাহস হলো না।