একরাতেই ফকির হয়ে গেলাম আমি। কালো বেড়ালের স্মৃতি ভোলার জন্যে আবার একটা বেড়ালের খোঁজে ঘুরতে লাগলাম সমাজের নিচু তলায়। একদিন একটা মদের আড্ডায় দেখতে পেলাম এমনি একটা বেড়াল। বসেছিল পিপের ওপর–অথচ একটু আগেও জায়গাটা শূন্য ছিল। অবিকল পুটোর মতোই বড়ো, মিশমিশে কালো। শুধু বুক ছাড়া। সেখানটা ধবধবে সাদা।
বেড়ালটার মালিকের সন্ধান পেলাম না। তবে আমি গায়ে হাত দিতেই যেন আদরে গলে গেল সে। বাড়ি নিয়ে আসার পরের দিন সকাল বেলা লক্ষ্য করলাম–একটা চোখ নেই।
সেই কারণেই আরো বেশি করে আমার বউ ভালোবেসে ফেলল নতুন বেড়ালকে। মনটা ওর নরম। মমতায় ভরা, তাই।
যা ভেবেছিলাম, আমার ক্ষেত্রে ঘটল কিন্তু তার উল্টো। ভালোবাসা দূরের কথা–দিনকে দিন মনের মধ্যে ক্রোধ আর ঘৃণা জমা হতে লাগল নতুন বিড়ালের প্রতি। কোত্থেকে যে এত হিংসা বিদ্বেষ রাগ মনে এল বলতে পারব না।
বেড়ালটার আদেখ্যেতাপনাও বাড়ল তালে তাল মিলিয়ে। যতই মাথায় খুন চাপতে লাগল আমার ওর প্রতি–ততই আমার গায়ে মাথায় কোলে চাপার বহর বেড়ে গেল হতভাগার। প্রতিবারেই ভাবতাম, দিই শেষ করে। সামলে নিতাম অতি কষ্টে।
বউ কিন্তু একটা জিনিসের প্রতি বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত আমার। তা হলো কালো বেড়ালের সাদা বুক। পুটোর সঙ্গে তফাৎ শুধু ঐ জায়গায়। সাদা ছোপটা দেখতে অবিকল ফাঁসির দড়ির মতো!
একদিন পুরোনো বাড়ির পাতাল ঘরে গেছি বউকে নিয়ে। অভাবের তাড়নায় না গিয়ে পারতাম না। ন্যাওটা বেড়ালটা পায়ে পায়ে আসছে। পায়ে পা বেঁধে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম নিজেকে। কিন্তু সামলাতে পারলাম না মেজাজ। ধাঁ করে একটা কুড়াল তুলে নিয়ে নিশানা করলাম হতচ্ছাড়া বেড়ালের মাথা–বাধা দিল আমার বউ।
বউ বাধা না দিলে সেদিনই দফারফা হয়ে যেত নতুন বেড়ালের। কিন্তু সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল বউয়ের ওপর। অমানষিক রাগ। কুড়ালটা মাথার ওপরে তুলে বসিয়ে দিলাম ওর মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল স্ত্রী।
সমস্যা হলো লাশটা নিয়ে। অনেক ভেবে চিন্তে দেওয়ালের মধ্যে রক্ত মাখা দেহটা খাড়া করে দাঁড় করিয়ে ইট দিয়ে গেঁথে ফেললাম। প্লাস্টার করে দিলাম। বাইরে থেকে ধরবার কোনো উপায় রইল না।
বড় শান্তিতে ঘুমালাম সে রাত্রে বেড়াল ছাড়া। কুড়াল নিয়ে খুঁজে ছিলাম তাকে বধ করার জন্যে–পাইনি।
দিন কয়েক পরে পুলিশ এসে সারা বাড়ি খুঁজল। আমি সঙ্গে রইলাম। একটুকুও বুক কাঁপল না। চার চারবার নিয়ে গেলাম পাতাল কুঠরির সেই দেওয়ালের কাছে।
তারপর যখন হতাশ হয়ে ওরা চলে যাচ্ছে, বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়লাম আমি। হাতের পাটি দিয়ে খটাস করে মারলাম দেওয়ালের ঠিক সেইখানে যেখানে নিজের হাতে কবর দিয়েছি বউকে।
.
আচমকা একটা বিকট কান্নার আওয়াজ ভেসে এল ভেতর থেকে। সারা বাড়ি গমগম করতে লাগল সেই আওয়াজে। দেখলাম, আমার মরা বউয়ের মাথার ওপর বসে রয়েছে সেই কালো বেড়ালটা, যার বুকের অংশটা সাদা!
ভৌতিক ক্রিসমাস
আমি আগে কখনো একাকী কাটাইনি ক্রিসমাস।
সাজানো গোছানো কামরায় একা একা বসে থাকতে আমার গা কেমন ছমছম করে। মাথায় যত রাজ্যের ভূত প্রেতের চিন্তা এসে ভিড় করে, মনে হয় রুমের মধ্যে কারা যেন কথা বলছে। অতীতকাল থেকে আসা মানুষজন। কেমন দম বন্ধ করা একটা অনুভূতি হয় আমার ফেলে আসা সবগুলো ক্রিসমাসের স্মৃতি জট পাকিয়ে যায় মনের মধ্যে : শিশুতোষ ক্রিসমাস, বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন, জানালার ধারে গাছ, পুডিংয়ের মধ্যে পুরে রাখা ছয় পেন্সের মুদ্রা এবং কালো আকাশ ঘেরা সকালের ক্রিসমাস; কৈশোরের ক্রিসমাস, বাবা-মায়ের সঙ্গে। যুদ্ধ, হাড় কাঁপানো শীত। দেশের বাইরে থেকে
আসা চিঠিপত্র; বড়ো হয়ে ওঠার পরের ক্রিসমাস; প্রেমিকের সঙ্গে তুষারপাত, যাদুকরী মোহ, রেড ওয়াইন, চুম্বন এবং মাঝরাতের আগে অন্ধকার রাস্তায় হাঁটাহাঁটি, বরফ পড়ে ধবধবে সাদা জমিন, কালো আকাশের পটভূমে ফুটে থাকা নক্ষত্রের হীরক দীপ্তি কত কত ক্রিসমাসের স্মৃতি বছর ঘুরে।
আর এবারই প্রথম আমার একলা ক্রিসমাস কাটানো।
তবে শুধু একাকীত্বই যে অনুভব করি তা নয়। আরও অনেক লোকই একা একা ক্রিসমাস কাটায় তাদের সঙ্গে এক ধরনের একাত্মতা অনুভূত হয় মনে। এদের সংখ্যা লক্ষাধিক
তারা অতীত এবং বর্তমানের মানুষ। এরকম একটা অনুভূতি জাগে, চোখ বুজলে মনে হয় অতীত বলে কিছু নেই, ভবিষ্যতের কোনো অস্তিত্ব নেই, শুধু রয়েছে সীমাহীন বর্তমান যার নাম সময় আর এ সময়টুকুই কেবল আমাদের হাতে আছে।
তবু আপনি যতই উন্নাসিক হোন না কেননা, কিংবা ধর্মকর্মে আপনার আগ্রহ না-ইবা থাকুক, ক্রিসমাসের সময় একা থাকলে আপনার কাছে অদ্ভুতই লাগবে।
কাজেই যখন যুবকটিকে আমি দেখলাম ভেতরে ঢুকতে, মনে বেশ স্বস্তি লাগল। তবে এর মধ্যে রোমান্টিক ব্যাপার কিছু নেই–আমি পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই এক নারী, চিরকুমারী স্কুল শিক্ষিকা, গম্ভীর, মাথা ভর্তি কালো চুল, এক সময়ের সুন্দর চক্ষু জোড়া এখন ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন আর যুবকের বয়স কুড়ির কোঠায়, একটু অন্যরকম পোশাক গায়ে, গলায় ওয়াইন কালারের টাই এবং কালো ভেলভেট জ্যাকেট, মাথার বাদামী চুলে কতদিন নাপিতের কাঁচি পড়েনি কে জানে! তার নীল, সরু চোখজোড়ায় অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, খাড়া নাক, উদ্ধত চিবুক। তবে খুব একটা শক্তিশালী কাঠামো তার নয়। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা।