মি. স্মিথ, আপনার কাছে আমার আর কিছু বলার নেই। এ কাহিনি এতকাল আমার মনের মধ্যে ছিল। আজকে আপনার কাছে বলে মুক্তি পেলাম। ইচ্ছে করলে আমার জীবনের ইতিহাস আপনি অন্য লোকদের কাছে বলতে পারেন আবার নাও বলতে পারেন। এ ব্যাপারে আপনার পূর্ণ স্বাধীনতা রইল।
আজ রাতে আপনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেন। আমি বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য সাধনের পথে কোনো বাধাই আমি সহ্য করতাম না। আমার কাজ শেষ হওয়ার আগে যদি আপনাকে দেখতে পেতাম তা হলে আমাকে বাধা দেওয়ার বা কোনো রকম বিপদ সংকেত জানানোর সুযোগটুকু পর্যন্ত আপনাকে দিতাম না। এবার আপনাকে বাইরে বেরুবার রাস্তা দেখিয়ে দিই। এই দরজা দিয়ে বেরুলে আপনি Rue de Rivoli রাস্তায় যেতে পারবেন। শুভ রাত্রি, মি. স্মিথ।
মি. জন ভ্যান্সিটার্ট স্মিথ যেতে যেতে পেছনে ফিরে তাকালেন। মুহূর্তের জন্য সোসরার কৃশ দেহটা সরু দরজা পথে দেখতে পেলেন। পরমুহূর্তে দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। খিল আটকানোর গুরুগম্ভীর শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিল।
.
লন্ডনে ফিরে আসার দুদিন পরে মি. জন ভ্যান্সিটার্ট স্মিথ দি টাইমস পত্রিকায় একটি খবর পড়লেন। খবরটি পাঠিয়েছে সংবাদপত্রের প্যারিস সংবাদদাতা। সংবাদটি হচ্ছে :
স্যুভর মিউজিয়ামে অস্বাভাবিক ঘটনা
গতকাল সকালে মিউজিয়ামের বড়ো ঈজিপশিয়ান চেম্বারে এক অদ্ভুত আবিষ্কার হয়েছে। সকালে ঝাড়ুদারেরা ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখে ঈজিপশিয়ান চেম্বারের নবনিযুক্ত বুড়ো অ্যাটেনডেন্টের মৃতদেহ মাটিতে পড়ে আছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, মৃত ব্যক্তি দুহাত দিয়ে সদ্য সংগৃহীত মমি জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। মৃত ব্যক্তি এত দৃঢ় ভাবে মমিটাকে আলিঙ্গন করে রেখেছিল যে অনেক কষ্টে তাদেরকে আলাদা করা গেছে। একটা বড়ো বাক্সে অনেকগুলো মূল্যবান আংটি ছিল। বাক্সটা খুলে সেগুলো এলোমলো করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের ধারণা লোকটা মমি চুরি করে ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের কাছে বিক্রি করতে চেয়েছিল। কিন্তু মমি নিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। লোকটার বয়স কত বা দেশ কোথায় কিছুই জানা যায়নি। তার এই অস্বাভাবিক ও নাটকীয় মৃত্যুতে শোক করার জন্য কোনো আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলের ওপর রাখলেন স্মিথ। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল লুভর মিউজিয়াম। মনে পড়ল সেই রাতের কথা…সেই রহস্যময় মানুষটির কথা।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : তারক রায়
ভূত বিড়াল
ছেলেবেলা থেকেই আমি পশুপাখি খুব ভালোবাসি। আমার স্বভাবও ছিল শান্ত। জন্তুজানোয়ার পুষতে ভীষণ ভালোবাসতাম। বড়ো হলাম কিন্তু স্বভাব পালটাল না।
বিয়ে করলাম অল্প বয়সে। বেশ মনের মতো বউ পেলাম। স্বভাবটি মিষ্টি। শান্ত। জম্ভজানোয়ার পোষার শখ আমার মতোই। আমাদের শখের চিড়িয়াখানায় একটা বেড়ালও ছিল। কালো বেড়াল।
শুধু কালো নয়, বেড়ালটা বেশ বড়োও বটে। বুদ্ধিও তেমনি। বেড়ালের মগজে যে এত বুদ্ধি ঠাসা থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। বউ কিন্তু কথায় কথায় একটা কথা মনে করিয়ে দিত আমাকে। কালো বেড়ালকে নাকি ছদ্মবেশী ডাইনী মনে করা হতো সেকালে। আমি ওসব কুসংস্কারের ধার ধারতাম না।
বেড়ালটার নাম পুটো। অষ্টপ্রহর আমার সঙ্গে থাকত, পায়ে পায়ে ঘুরত, আমার হাতে খেত, আমার কাছে ঘুমাতো। পুটোকে ছাড়া আমারও একদিন চলত না।
বেশ কয়েক বছর পুটোর সঙ্গে মাখামাখির পর আমার চরিত্রের অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখা গেল।
ছিলাম ধীর, শান্ত। হয়ে উঠলাম অস্থির, অসহিষ্ণু, খিটখিটে। মেজাজ এমন তিরিক্ষে হয়ে উঠল যে বউকে ধরেও মারধর শুরু করলাম। পুটোকেও বাদ দিলাম না।
এক রাতে মদ খেয়ে বাড়ি এসে দেখি পুটো আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। আর যায় কোথায় মাথায় রক্ত উঠে গেল আমার, খপ করে চেপে ধরলাম। ফাঁস করে সে কামড়ে দিল আমার হাতে। আমি রাগে অন্ধ হয়ে গেলাম। পকেট থেকে ছুরি বের করে পুটোর টুটি ধরলাম এক হাতে আরেক হাতে ধীরে সুস্থে উপড়ে আনলাম একটা চোখ।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙবার পর একটু অনুতাপ হলো বৈকি। উত্তেজনা মিলিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে কিন্তু পুটো আমার ছায়া মাড়ানো ছেড়ে দিল। চোখ সেরে উঠল দুদিনেই। কিন্তু আমাকে দেখলেই সরে যেত কালো ছায়ার মতো।
আস্তে আস্তে মাথার মধ্যে পশু প্রবৃত্তি আবার জেগে উঠল। যে বিড়াল আমাকে এত ভালোবাসত, হঠাৎ আমার ওপর তার এত ঘৃণা আমার মনের মধ্যে শয়তানী প্রবৃত্তিকে খুঁচিয়ে তুলতে লাগল। সে কিন্তু কোনো দিন ক্ষতি করেনি আমার। তা সত্ত্বেও ওকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার জন্যে হাত নিশপিশ করতে লাগল আমার।
একদিন সত্যি সত্যিই ফাঁসি দিলাম পুটোকে। বাগানের গাছে লটকে দিলাম দড়ির ফাঁসে। ও মারা গেল। আমিও কেঁদে ফেললাম। মন বলল, এর শাস্তি আমাকে পেতেই হবে।
সেই রাতেই আগুন লাগল বাড়িতে। রহস্যময় আগুন। জ্বলন্ত মশারী থেকে বউকে নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলাম পুড়ছে সারা বাড়ি।
দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল গোটা বাড়ি। খাড়া রইল শুধু একতলার একটা দেয়াল। পাড়ার সবাই অবাক হয়ে গেল সাদা দেয়ালের ওপর একটা কালো ছাপ দেখে। ঠিক যেন একটা কালো বেড়াল। গলায় দড়ির ফাঁস।