পারমেসের কাগজপত্র এবং থোথের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ হয় ধ্বংস হয়েছে, নয়ত ছড়িয়ে পড়েছে সিরিয়া মরুভূমির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। অনেক খুঁজলাম। কিন্তু সমস্ত পরিশ্রম ব্যর্থ হলো।
তখন থেকেই থোথের আংটি এবং তার মধ্যে লুকানো পারমেসের ওষুধ খুঁজে পাবার আশা আমি ত্যাগ করেছি। মনস্থির করলাম যতদিন ওষুধের প্রভাব কেটে না যায় ততদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব। সময় যে কী ভয়ঙ্কর জিনিস তা আপনি কীভাবে বুঝবেন? কালস্রোত অসীম, অনন্ত। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত কালের এই সীমিত গন্ডির মাঝেই আপনাদের অভিজ্ঞতা সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমি জানি। যুগ-যুগ ধরে কালের অসীম স্রোতে ভেসে চলছি আমি। ইতিহাসের উত্থান পতন আমি নিজের চোখে দেখেছি। ট্রয় নগরীর . পতন যখন হয় তখন আমি বৃদ্ধ। হেরোগেটাস যখন মেমফিস নগরীতে আসে, আমি তখন অতি বৃদ্ধ। যীশু খ্রিস্ট যখন পৃথিবীতে তাঁর নতুন বাণী প্রচার করলেন, আমি তখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছি।
কিন্তু আজও আপনি আমাকে জীবিত মানুষ হিসেবেই দেখছেন। কারণ আমার রক্তে ওই অভিশপ্ত পদার্থ এখনও ক্রিয়াশীল। তবে এবার আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি।
এই সুদীর্ঘ জীবনে আমি সব দেশে ঘুরেছি, সব জাতির সাথে বসবাস করেছি। পৃথিবীর সব ভাষাই আমার কাছে একই রকম। ক্লান্তিকর সময় কাটানোর জন্য আমি সব ভাষা শিখেছি। সময় যে কীভাবে ধীরে চলে তা আপনাকে কীভাবে বোঝাব? বর্বরতার মধ্যযুগ আর আধুনিক সভ্যতার উন্মেষ আমার নিজের চোখে দেখা। এসবই আমি পেছনে ফেলে এসেছি। অন্য কোনো নারীর দিকে কখনও আমি প্রেমের দৃষ্টিতে তাকাইনি। আতমা জানে আমি তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি।
প্রাচীন মিশর সম্পর্কে গবেষকরা যা লিখতেন তা পড়া আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এই দীর্ঘ জীবনে অনেক কাজ করেছি। কখনো প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেছি, কখনওবা দারিদ্র্যের মধ্যে। কিন্তু যে অবস্থায়ই থাকি না কেন প্রাচীন মিশর সংক্রান্ত পত্র-পত্রিকা সব সময় কিনেছি। নয় মাস আগে আমি সানফ্রান্সিসকোতে ছিলাম। সেখানে এক পত্রিকায় পড়লাম, প্রাচীন আবারিস নগরীর কাছাকাছি এলাকার বালির তলা থেকে কিছু প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। খবরটা পড়ে আমার বুক ধক করে উঠল। ওখানে আরও লেখা ছিল, যিনি খননের দায়িত্বে আছেন, বর্তমানে তিনি সদ্য আবিষ্কৃত গেছে। মমিটির কফিন এখনও ভোলা হয়নি। কফিনের ওপর একটা চিত্রলিপি আছে তাতে লেখা-ফারাও টুথমোসিসের আমলের গভর্নরের কন্যা এখানে শুয়ে আছেন।
পত্রিকায় আরও লেখা আছে, কফিনের ঢাকনা সরাবার পর মমিটার বুকে একটা প্লাটিনামের বড়ো আংটি পাওয়া গেছে। তাতে বিরাট একখন্ড স্ফটিক বসানো। বুঝতে পারলাম, পারমেস এখানেই থোথের আংটি লুকিয়ে রেখেছিল। আর এজন্য ও বলেছিল, অতি নিরাপদ জায়গায় আংটিটা লুকিয়ে রেখেছে। কারণ কোনো মিশরীয়ই মমির অভিশাপ নেওয়ার জন্য কফিনের ঢাকনা খুলবে না।
ওই রাতেই আমি সানফ্রান্সিসকো ত্যাগ করলাম। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আরবিসে পৌঁছে গেলাম। অতীতের সেই সমৃদ্ধ নগরীর জায়গায় বর্তমানে কয়েকটা বালুর স্তূপ আর ভাঙাচোরা কয়েকটা প্রাচীর ছাড়া আর কিছুই নেই। কয়েকজন ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক এখানে খনন করছিল। তাদের কাছে গিয়ে আংটিটার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। তারা বলল যে আংটি আর মমিটা কায়রোর বুলাক জাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমি বুলাক জাদুঘরে গেলাম। সেখানে গিয়ে শুনলাম, ম্যারিয়েট বে নামে এক লোক আংটি আর মমির মালিকানা দাবি করেছে। তাই ওগুলো তাকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে শুনলাম তিনি দুটি জিনিসই লুভর মিউজিয়ামের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। ওগুলোকে অনুসরণ করে অবশেষে আমি ভরে হাজির হলাম। সুদীর্ঘ চার হাজার বছর পর আমার আমার দেহাবশেষ খুঁজে পেলাম আমি। খুঁজে পেলাম সেই আংটি, যেটাকে এতকাল তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।
কিন্তু ওগুলো হাতে পাবো কীভাবে? কেমন করে ওই মূল্যবান বস্তু দুটি আমি একান্ত করে পাবো? এবার ভাগ্য আমার প্রতি প্রসন্ন হলো। মিউজিয়ামের মিশরীয় সংগ্রহশালার অ্যাটেনডেন্টের পদ খালি হলো। আমি সোজা ডিরেক্টরের কাছে চলে গেলাম। তাকে বোঝাতে পারলাম যে প্রাচীন মিশর সম্পর্কে অনেক কিছু জানি আমি।
অতি আগ্রহে হয়তো একটু বেশিই বলে ফেললাম। আমার কথা শুনে ডিরেক্টর মন্তব্য করলেন, তোমাকে তো দেখছি সামান্য অ্যাটেনডেন্টের পদের চেয়ে অধ্যাপকের পদেই বেশি মানায়। তারপরও তিনি আমাকে চাকরি দিলেন। আর এভাবেই আমি এই চাকরিটা পেলাম। এখানে আজকেই আমার প্রথম এবং শেষ রাত।
মি. ভ্যান্সিটার্ট স্মিথ, এই হলো আমার কাহিনি। আপনার মতো বিদ্বান ব্যক্তির কাছে এর বেশি কিছু আমার বলার নেই। আজ রাতে দৈবক্রমে আপনি সেই নারীর মুখ দেখলেন যাকে সুদূর অতীতে আমি ভালোবেসেছিলাম। বাক্সের মধ্যে স্ফটিক বসানো অনেকগুলো আংটি রয়েছে। কিন্তু আমার সেই প্রাটিনামের আংটিটি খুঁজে পাওয়ার জন্য আমাকে পরীক্ষা করতে হয়েছিল।
আংটিটার স্ফটিক খণ্ডের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছি ওটার ভেতরে পারমেসের আবিষ্কৃত ওষুধের কয়েক ফোঁটা রয়ে গেছে। অবশেষে আমার এই সুদীর্ঘ অভিশপ্ত জীবনের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে।