আমি আমার কাছে যাচ্ছি, পারমেস বলল। শহরের প্রাচীরের বাইরে জোড়া খেজুর গাছের পাশের সমাধিতে শুয়ে আছে ও।
ওখানে কেন যাবে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
মরতে! পারমেস চিৎকার করে বলল। মরতে যাচ্ছি! পৃথিবীর আর কোনো কিছু আমাকে আটকাতে পারবে না।
কিন্তু তুমি মরতে পারবে না, আমি চিৎকার করে বললাম। তোমার রক্তে এখনও ওই অভিশপ্ত ওষুধের প্রভাব রয়েছে।
আমি ওটাকে অগ্রাহ্য করতে পারব, পারমেস বলল। এমন একটা শক্তিশালী ওষুধ আমি আবিষ্কার করেছি যেটা তোমার ওষুধের প্রভাব নষ্ট করে ফেলতে পারবে। আমার শরীরে এখন ওটা কাজ করছে। এক ঘণ্টার মধ্যে আমি মারা যাচ্ছি। আমি আমার সাথে মিলিত হব। কিন্তু তুমি এই জীবনের বোঝা বইবার জন্য পড়ে থাকবে।
পারমেসের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম ও সত্যি কথাই বলছে। ওর চোখের আলো সেই কথাই বলছে।
তুমি আমাকে শেখাও! আমি বললাম।
কখনও না! পারমেস জবাব দিল।
মহান দেবতা থোথ আর আনুবিসের নামে তোমার কাছে অনুরোধ করছি!
কোনো লাভ হবে না, পারমেস শীতল কণ্ঠে বলল।
তা হলে আমি নিজেই খুঁজে নেব, আমি চিৎকার করে বললাম।
পারবে না, পারমেস বলল। আমি দৈবক্রমে এটা আবিষ্কার করেছি। ওষুধের মধ্যে এমন একটা উপাদান আছে, যা তুমি কখনও সংগ্রহ করতে পারবে না। থোথ-এর আংটির মধ্যে যেটুকু ওষুধ আমি রেখেছি, তার বাইরে এক ফোঁটা ওষুধও কেউ কোনোদিন তৈরি করতে পারবে না।
থোথের আংটির মধ্যে? আমি পুনরাবৃত্তি করলাম। আংটিটা কোথায়?
তুমি একথা কখনও জানতে পারবে না, পারমেস বলল। তুমি আমার ভালোবাসা পেয়েছিলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কে জিতল? তোমাকে আমি এই নোংরা পৃথিবীতে রেখে আমার কাছে চলে যাব। পারমেস পাগলের মতো ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। পরদিন সকালে খবর পেলাম থোথের তরুণ পুরোহিত মারা গেছে।
এরপর আমার দিনগুলো গবেষণার মধ্যে কাটতে লাগল। সেই বিষের সন্ধান আমাকে অবশ্যই পেতে হবে। যেটা আমার ওষুধের প্রভাব নষ্ট করে আমাকে মৃত্যু দান করবে। ভোর থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত আমি টেস্টটিউব আর ফার্নেস নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। থোথের মন্দির থেকে পারমেসের ব্যবহৃত প্যাপিরাস আর ফ্লাস্কগুলো সংগ্রহ করলাম। কিন্তু হায়! ওগুলো থেকে কিছুই জানতে পারলাম না। প্যাপিরাসগুলোতে লেখা কিছু ইঙ্গিত আমার মনে আশা জাগিয়ে তুলল। কিন্তু কোনও লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলাম না। মাসের পর মাস আমি কঠোর পরিশ্রম করতে লাগলাম। মাঝে মাঝে যখনই ক্লান্ত হয়ে পড়তাম তখন জোড়া খেজুর গাছের পাশে আমার সমাধিতে হাজির হতাম। সেখানে আতমার উপস্থিতি অনুভব করতাম। ওর উদ্দেশ্য ফিসফিস করে বলতাম, ওর কাছে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি।
পারমেস বলেছিল ওর আবিষ্কারের সাথে থোথের আংটির সম্পর্ক রয়েছে। আংটিটার কথা আমার মনে আছে। ওটা একটা বিরাট আর ভারী আংটি। আংটিটা সোনা দিয়ে তৈরি নয়। এক ধরনের ভারী দুর্লভ ধাতু দিয়ে তৈরি, যেটা হারবাল পর্বত থেকে আনা হয়েছিল। মনে পড়ল, বিরাট ওই আংটিটায় একখন্ড ফাঁপা স্ফটিক বসানো রয়েছে। হয়তো ওটার মধ্যেই পারমেসের আবিষ্কৃত ওষুধের কয়েক ফোঁটা থাকতে পারে। পারমেসের গোপন আবিষ্কার ধাতুর সাথে সম্পর্কিত নয়। কারণ প্রাটিনামের তৈরি অনেকগুলো আংটি থোথের মন্দিরে আছে। তা হলে কি পারমেস তার আবিষ্কৃত ওষুধ ফাঁপা স্ফটিকের মধ্যে জমা রেখেছে? এ সিদ্ধান্তে আসার পর আমি তন্নতন্ন করে পারমেসের কাগজ পত্র পরীক্ষা করতে লাগলাম। একখানা কাগজ থেকে জানলাম আমার ধারণাই ঠিক। স্ফটিক খন্ডের মধ্যেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে সেই বিষ। সেই বিষের কয়েক ফোঁটা তখনও ব্যবহার করা। হয়নি।
কিন্তু আংটিটা খুঁজে পাব কীভাবে? আংটিটা পারমেসের সাথে ছিল না। ওর মৃতদেহটা মমিতে পরিণত করার সময় তা পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মাঝেও আংটিটা পাওয়া যায়নি। যে সব জায়গায় ও যেত সেখানেও খুঁজে দেখেছি। কিন্তু পাইনি। এ সময় নতুন এক দুর্ভাগ্য না এলে হয়তো শেষ পর্যন্ত আমার পরিশ্রম সার্থক হতো।
হিসোসদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। ফারাও-এর সেনাবাহিনী সেই যুদ্ধে পরাজিত হলো। এই মেষ পালক জাতি আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা আমাদের সবকিছু লুটপাট করতে লাগল। এই এলাকায় দিনের বেলায় বইতে লাগল রক্ত স্রোত আর রাতের বেলায় জ্বলতে লাগল আগুন। আমাদের আবারিস ছিল মিশরের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা কেন্দ্র। কিন্তু ওই বর্বরদের আমরা ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না। নগরীর পতন হলো। গভর্নর এবং সৈন্যদের হত্যা করা হলো। আর অন্যদের সাথে আমি বন্দি হলাম।
বছরের পর বছর ধরে ইউফ্রেটিস নদীর ধারে আমি পশু চরাতে লাগলাম। আমার প্রভু মারা গেল। তার ছেলেও বুড়ো হলো। কিন্তু মৃত্যু থেকে তখনও আমি বহু দূরে। অবশেষে একদিন একটা দ্রুতগামী উটের পিঠে চড়ে আমি পালালাম। এগিয়ে চললাম মিশরের দিকে। হিকসোসরা মিশরে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। তাদের রাজা দেশটা শাসন করছে। আবারিস নগরী বিধ্বস্ত হয়েছে।
শহরটাকে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বিরাট বিরাট মন্দিরগুলোর জায়গায় এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ। প্রতিটা কবর লুট করা হয়েছে। প্রত্যেকটা স্মৃতিসৌধ ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমার আমার সমাধির কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই। মরুভূমির বালির তলায় হারিয়ে গেছে সেই সমাধি। যে পোড়া খেজুর গাছ। সমাধিটাকে চিহ্নিত করতো তার কোনও চিহ্ন নেই।