এ সময় দেশে যুদ্ধ শুরু হলো। হেক্সোমদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য মহান ফারাও পূর্ব সীমান্তে একদল সৈন্য পাঠালেন। আবরিসে একজন গভর্নর পাঠালেন যাতে ফারাওদের শাসন কায়েম করতে পারেন। শুনেছিলাম গভর্নরের মেয়ে নাকি খুব সুন্দরী। একদিন পারমেসকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে তার সঙ্গে দেখা হলো। চারজন ক্রীতদাস একটা পালকিতে করে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রথম দেখাতেই আমি তার প্রেমে পড়ে গেলাম।
আমি আর আমার মাঝে রইলাম না। ভাবলাম, এই-ই আমার জীবনের কাঙ্খিত নারী। ওকে ছাড়া আমার জীবন ধারণ অসম্ভব। মহান দেবতা হোরাস-এর নামে শপথ করলাম, ওকে নিজের করে পেতেই হবে। আমার মনের কথা পারমেসকে জানালাম, কিন্তু ও আমার কাছ থেকে চলে গেল। দেখলাম ওর মুখটা মাঝরাতের অন্ধকারের মতো কালো হয়ে গেছে।
সেই মেয়ের সাথে আমার ভালোবাসার কাহিনি আপনাকে বলার প্রয়োজন নেই। শুধু এতটুকুই বলব, আমি যেমন তাকে ভালোবাসতাম, সেও আমাকে তেমনি গভীরভাবে ভালোবাসত। শুনেছিলাম, আমার সাথে দেখা। হওয়ার আগেই নাকি পারমেসের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল। পারমেস তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল। কিন্তু এ কথা শুনে আমি হেসেছিলাম। কারণ আমি জানতাম ওর হৃদয় আমার।
এ সময় এক দুর্যোগ দেখা দিল। আমাদের শহরে হোয়াইট প্লেগের আক্রমণ হলো। অনেকেই মারা যেতে লাগল। কিন্তু আমি অসুস্থ লোকদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কারণ আমার কোনো ক্ষতির আশঙ্কা ছিল না। আমার সাহস দেখে গভর্নরের মেয়ে মানে আমার প্রেমিকা বিস্মিত হলো। আমি তাকে আমার গোপন আবিষ্কারের কথা বললাম। অনুরোধ করলাম আমার এই চমৎকার আবিষ্কার ব্যবহারের জন্য।
আমার ওষুধ তোমার ওপর প্রয়োগ করতে দাও, আতমা (Atma), আমি বললাম। তা হলে ফুলের মতো তোমার এই সুন্দর শরীর কখনও শুকিয়ে যাবে না। হাজার হাজার বছর চলে যাবে কিন্তু আমরা এবং আমাদের ভালোবাসা চিরকাল রয়ে যাবে। ফারাও শেফুর বিরাট পিরামিড ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপরও আমরা রয়ে যাব।
কিন্তু ওর মনে সংশয় ছিল। এটা কি ঠিক হবে? আমাকে ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল। এর ফলে কি দেবতার ইচ্ছাকে বাধা দেয়া হবে না? মহান দেবতা ওসাইরিস যদি আমাদের দীর্ঘ জীবন চাইতেন, তবে তিনি নিজেই কি ব্যবস্থা করতেন না?
ভালোবাসার কথা বলে আমি ওর সন্দেহ দূর করলাম। যদিও ও ইতস্তত করছিল। বলেছিল, এটা একটু বড়ো প্রশ্ন। ভেবে দেখার জন্য আমার কাছে এক রাত সময় চাইল। বলল যে আগামীকাল সকালে ওর জবাব জানতে পারব। যদিও এক রাত বেশি সময় নয়। আমাকে বলেছিল, এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আইসিসের কাছে সাহায্য চাইবার জন্য প্রার্থনা করবে।
এক বুক সংশয় আর মনের মধ্যে অমঙ্গলের চিন্তা নিয়ে ওর কাছ থেকে বাড়ি ফিরে আসলাম। পরদিন সকালে মন্দিরের প্রথম বলিদান শেষ হওয়ার পরেই আমি আমাদের প্রাসাদের উদ্দেশ্যে ছুটে গেলাম। প্রাসাদে পৌঁছে সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় এক ক্রীতদাসীর সাথে দেখা হলো। সে বলল, তার মনিব কন্যা খুব অসুস্থ। একথা শুনে পাগলের মতো ছুটে ওর ঘরে চলে গেলাম। দেখলাম বিছানায় শুয়ে আছে ও। মাথাটা বালিশের ওপর। মুখটা বিবর্ণ, চোখ দুটো চকচক করছে। ওর কপালের মাঝ বরাবর একটা বেগুনি রঙের ক্ষত জ্বলজ্বল করছে। ক্ষতটা দেখেই বুঝতে পারলাম কী হয়েছে। এ হলো হোয়াইট প্লেগের চিহ্ন। একে অনিবার্য মৃত্যুর চিহ্নও বলা যায়।
আতমা বাঁচল না।
সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা কী বলব! মাসের পর মাস আমি পাগলের মতো আচরণ করতে লাগলাম। জ্বরে আক্রান্ত শরীরে ভুল বকতে লাগলাম। কিন্তু আমি মরতে পারলাম না। মৃত্যুকে আমি যেমন করে কামনা করেছিলাম, মরুভূমিতে তৃষ্ণার্ত কোনও আরবও বুঝি তেমনভাবে পানির খোঁজ করে না। যদি বিষ অথবা অস্ত্রের আঘাতে মরতে পারতাম তবে পরজগতে আমার ভালোবাসার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য একটুও দেরি করতাম না। আমি চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কোন ফল হয়নি। সেই অভিশপ্ত ওষুধ আমার দেহে শক্ত প্রভাব বিস্তার করে বসেছে।
এক রাতে দুর্বল শরীরে আমি বিছানায় শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ পারমেস আমার ঘরে প্রবেশ করল। ও বাতির আলোর বৃত্তের মাঝে দাঁড়াল। ও আমার দিকে তাকিয়ে রইল। দেখলাম ওর চোখে বিজয়ের দৃষ্টি।
তুমি আমাকে মরতে দিলে কেন? পারমেস আমাকে জিজ্ঞাসা করল। আমাকে যেমন দীর্ঘায়ু করেছ, ওকে কেন করলে না?
দেরি করে ফেলেছিলাম, আমি জবাব দিলাম। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম তুমিও তো ওকে ভালোবাসতে। তুমি আমার দুর্ভাগ্যের সঙ্গী। একদিন পরজগতে ওকে আমরা ঠিকই দেখতে পাব। কিন্তু এর জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে। চিন্তাটা কত ভয়ঙ্কর, তাই না? মূর্খ, আমরা মূর্খ। মৃত্যুকে আমরা শত্রু বলে গণ্য করেছিলাম।
একথা তুমি বলতে পার, উন্মাদের মতো হেসে পারমেস বলল। তোমার মুখ থেকে এ ধরনের কথা বেরুতে পারে। কিন্তু আমার কাছে এসব অর্থহীন।
কী বলতে চাও তুমি? আমি চিৎকার করে বললাম, কনুই-এর ওপর ভর দিয়ে উঠে বসলাম। শোকে নিশ্চয়ই তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
পারমেসের চেহারায় আনন্দের ছাপ। ওর সারা শরীর এমন ভাবে কাঁপছে যেন শয়তান ভর করেছে।
জান, আমি কোথায় যাচ্ছি? ও জিজ্ঞাসা করল।
না, আমি জবাব দিলাম। বলতে পারব না।