ঘরটা ছোটো। সাধারণত দারোয়ানদের এরকম ঘর দেওয়া হয়। ভেতরে আগুন রাখার তাওয়ায় আগুন জ্বলছে। এক পাশে একটা চাকাওয়ালা চৌকির ওপর বিছানা পাতা। আরেক পাশে একখানা অমসৃণ কাঠের চেয়ার। মাঝখানে একটা গোল টেবিল রয়েছে। টেবিলের ওপর একটা প্লেটে রাতের খাবারের অবশিষ্ট পড়ে আছে।
স্মিথ লক্ষ্য করলেন ঘরের আসবাবগুলো তৈরির মধ্যে প্রাচীন কারিগরি দক্ষতার ছাপ বিদ্যমান। মোমবাতি, মোমদানি, চুলো খোঁচাবার শিক, দেয়ালে ঝোলানো নকশা–সবগুলোর মধ্যে সুদূর অতীতের ছাপ রয়েছে।
বুড়ো অ্যাটেনডেন্ট বিছানার কিনারায় বসে অতিথিকে চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করল। হয়তো আমার ভাগ্যে এই ছিল, বুড়ো চমৎকার ইংরেজিতে বলল। ভাগ্য হয়তো আগেই ঠিক করে রেখেছে যে যাওয়ার আগে আমি একটা বিবরণ রেখে যাব। এ বিবরণ হচ্ছে সেই লোকদের জন্য যারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিজেদের বুদ্ধি কাজে লাগাতে চায়। আমি আপনাকে সেই কথা বলতে চাই। চাই আপনার মাধ্যমে সবাই এই কথা জানতে পারুক। পরজগতের দোরগোড়ায় পা রেখে আমি আপনাকে আমার জীবনের গল্প বলছি।
.
আপনি ঠিকই অনুমান করেছিলেন আমি মিশরীয়। প্রাচীন মিশরে জন্মেছিলাম আমি। কী, অবাক হচ্ছেন? বিশ্বাস করছেন না? আগে আমার বিচিত্র কাহিনি পুরোটা শুনুন। বুড়ো একটু থেমে আবার বলল, তো যা বলছিলাম, আমি জন্মেছিলাম প্রাচীন মিশরে। আজ যে পদদলিত দাসজাতি নীলনদের তীরে বাস করছে আমি সে গোত্রের কেউ নই। প্রাচীন মিশরে যে বীর্যবান আর পরিশ্রমী জাতি বাস করত, যারা ইহুদিদের বশ করেছিল আর দুর্ধর্ষ ইথিওপিয়ানদের দক্ষিণের মরুভূমিতে তাড়িয়ে দিয়েছিল, যারা বিশাল বিশাল পিরামিড তৈরি করেছিল, সেই জাতিতে আমার জন্ম।
যীশুর জন্মের মোলোশো বছর আগে ফারাও Tuthmosis-এর রাজত্বকালে আমি পৃথিবীর আলো প্রথম দেখেছিলাম। আপনি আমার কাছ থেকে দূরে সরে বসছেন। ভয় পাচ্ছেন? কিন্তু একটু ধৈর্য ধরে আমার কাহিনি শুনুন। তা হলে বুঝতে পারবেন, আমি যতটা না ভয়ের তার চেয়ে অনেক বেশি করুণার পাত্র।
আমার নাম সোসরা। আমার বাবা ছিলেন আবরিস এর ওসাইরিস দেবতার মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। মন্দিরটা ছিল নীলনদের বুবাস্তিক শাখার তীরে। এই মন্দিরেই আমি পালিত হয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিলাম। আমাকে সব রকমের অতীন্দ্রিয় বিদ্যায় শিক্ষিত করে তোলা হয়। এই বিদ্যা সম্পর্কে আপনাদের বাইবেলেও লেখা আছে। আমি মেধাবী ছাত্র ছিলাম। দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী পুরোহিত আমাকে যা শেখাতে পারতেন না, ষোলো বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই আমি তা শিখে ফেললাম। ওই সময় থেকে আমি নিজেই প্রকৃতির গোপন তত্ত্ব সম্পর্কে গবেষণা শুরু করলাম। আমার এই জ্ঞানের কথা আমি কাউকে জানাইনি।
সমস্ত প্রশ্নের থেকে একটা প্রশ্ন আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করল। প্রশ্নটা হলো জীবনের প্রকৃতি কী? এই বিষয়ে আমি অনেক গবেষণা করতে শুরু করলাম। এর মূলনীতির গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলাম। ওষুধের লক্ষ্য হলো রোগ হলে দেহ থেকে রোগকে তাড়িয়ে দেয়া। আমার মনে হলো এমন একটা পদ্ধতি কি আবিষ্কার করা যায় যাতে দেহে কোন দিন দুর্বলতা কিংবা মৃত্যু বাসা বাঁধতে না পারে? আমার গবেষণা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা অর্থহীন। করলেও আপনি বুঝতে পারবেন না। এ গবেষণার জন্য আমাকে দীর্ঘকাল অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়েছে। এ পরীক্ষার কিছু অংশ পশুর ওপর, কিছু অংশ ক্রীতদাসদের ওপর আর কিছু অংশ আমার নিজের ওপর চালিয়েছিলাম। বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকুই বলি, দীর্ঘ গবেষণার ফলে আমি এমন একটা তরল পদার্থ আবিষ্কার করেছিলাম যেটা ইনজেকশন দিয়ে রক্তের মধ্যে প্রবেশ করালে মানবদেহ সময়, হিংস্রতা অথবা রোগের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। এর ফলে মানুষ অমর হবে না কিন্তু ওষুধের কার্যকারিতা থাকবে হাজার বছর ধরে। ফলে সে বেঁচে থাকবে সহস্র বছর।
প্রথমে একটা বিড়ালের ওপর এই ওষুধ প্রয়োগ করলাম। তারপর তার শরীরে মারাত্মক বিষ ঢুকিয়ে দিলাম। কিন্তু তীব্র বিষেও বিড়ালটি মরল না। আজও লোয়ার ঈজিপ্টে ওটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে কোনও রহস্য বা জাদু নেই। এটা নিছকই এক রাসায়নিক আবিষ্কার। যেটা আবারও তৈরি করা যেতে পারে।
যৌবনে যে কেউ জীবনকে ভালোবাসে। আমার মনে হলো জীবনের সমস্ত দুশ্চিন্তার বন্ধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পেয়েছি আমি। কারণ মৃত্যুকে আমি তাড়িয়ে দিতে পারব বহু দূরে। অত্যন্ত হালকা মনে আমি আমার আবিষ্কৃত সেই অভিশপ্ত জিনিসটি আমার শিরায় ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর এমন একজনকে খোঁজ করতে লাগলাম যাকে আমি আমার দীর্ঘ জীবনের সঙ্গী করতে পারি।
মহান দেবতা থোথ-এর মন্দিরে এক তরুণ পুরোহিত ছিল। তার নাম পারমেস। সে প্রকৃতি আর পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক ছিল। এ জন্য ওকে আমি খুব পছন্দ করতাম। আমার এই গোপন আবিষ্কারের ব্যাপারে ওকে সব খুলে বললাম। ও উৎসাহিত হয়ে আমাকে অনুরোধ করায় ওর শরীরে ওই ওষুধ ঢুকিয়ে দিলাম। ভাবলাম, এই সুদীর্ঘ জীবনে একজন সাথি পেলাম।
এই বিরাট আবিষ্কারের পর আমার গবেষণায় কিছুটা ঢিল পড়ল। কিন্তু পারমেস দ্বিগুণ উদ্যমে গবেষণা শুরু করল। প্রতিদিন তাকে থোথের মন্দিরে গভীর মনোযোগের সাথে কাজ করতে দেখেছি। কিন্তু ওর কাজ সম্পর্কে খুব কম কথাই আমাকে বলতো। আমি শহরের পথে পথে অলসভাবে ঘুরে বেড়াতাম। আনন্দের দৃষ্টিতে চার পাশে তাকিয়ে ভাবতাম এ সবই চলে যাবে শুধু আমি টিকে থাকব। পথচারীরা মাথা নুইয়ে আমাকে সম্মান জানাতো। কারণ পন্ডিত হিসেবে বিদেশেও আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল।