এগুলোর মধ্যে একটা প্রকান্ড আংটি, যাতে একটা বড়ো ক্রিস্টালের পাথর বসানো, তার মনোযোগ কাড়ল। প্রচণ্ড আগ্রহের সাথে পাত্রের তরল পদার্থ দিয়ে সে এটা পরীক্ষা করল। অচিরেই তার গলা দিয়ে আনন্দের চিৎকার বেরিয়ে এলো। আনন্দে সে শূন্যে হাত ছুঁড়ল। হাতের ধাক্কায় তাকের ওপরে রাখা মাটির পাত্র উলটে গেল। তরল পদার্থটুকু মেঝের ওপর পড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে তার একটা ধারা স্মিথের পায়ের কাছে গড়িয়ে আসল।
বুড়ো অ্যাটেনডেন্ট তাড়াতাড়ি বুকের কাছ থেকে একটা লাল রঙের রুমাল বের করল। মেঝের ধারাটা মুছতে মুছতে ঘরের অন্ধকার কোণে বসে পড়ল। মুছতে গিয়ে এক পর্যায়ে স্মিথের মুখোমুখি হয়ে পড়ল।
এক্সকিউজ মি, স্মিথ বিনয়ের সাথে বললেন। দুর্ভাগ্যবশত আমি এই দরজার পেছনে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
আর আমাকে লক্ষ্য করেছিলেন? বুড়ো পরিষ্কার ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল। তার মৃত-পান্ডুর মুখে তীব্র ঘৃণার ছাপ ফুটে উঠেছে।
সত্যবাদী হিসেবে স্মিথের খ্যাতি আছে। হ্যাঁ, তিনি বললেন। আমি তোমার কাজ দেখেছি। তুমি যা করেছ তা দেখে আমার মনে প্রচণ্ড কৌতূহল জেগেছিল।
লোকটা তার পোশাকের ভেতর থেকে একটি বিরাট ছুরি বের করল।আপনি অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন, সে বলল। দশ মিনিট আগেও যদি আপনাকে দেখতে পেতাম তবে এই ছুরি দিয়ে আপনার হৃৎপিন্ড ফুটো করে দিতাম। এখনও যদি আপনি আমাকে স্পর্শ করেন কিংবা আমার কাজে বাধা দেন তা হলে মরা মানুষে পরিণত হবেন।
তোমাকে বাধা দেওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই, স্মিথ জবাব দিলেন। এখানে আমার উপস্থিতি নিছকই দুর্ঘটনা। এখন তুমি যদি আমাকে বাইরে যাওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দাও তবে তোমার প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ থাকব। অত্যন্ত ভদ্র এবং নরম গলায় স্মিথ কথাগুলো বললেন। কারণ লোকটা তার নিজের বাম হাতের তালুতে ছুরির ধারাল ডগাটা দিয়ে মৃদু চাপ দিচ্ছিল। বোধহয় ছুরিটার তীক্ষ্ণতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে চাইছে। তার চেহারায় এখনও ঘৃণার ভাব স্পষ্ট।
যদি বুঝতে পারতাম… সে বলল। কিন্তু না, হয়তো ভালোই হয়েছে। আপনার নাম কী?
স্মিথ নিজের নাম বললেন।
জন ভ্যান্সিটার্ট স্মিথ, লোকটা পুনরাবৃত্তি করল। আপনি কি সেই লোক যিনি লন্ডনে এলকাবের ওপর গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন? রিপোর্টটা আমি পড়েছি। কিন্তু এ বিষয়ে আপনার জ্ঞান অতি নগণ্য।
স্যার! দারুণ বিস্ময়ে মিশরতাত্ত্বিক ভ্যান্সিটার্ট স্মিথ চিৎকার করে উঠলেন।
তবে অনেকের চেয়ে আপনার গবেষণাপত্রটা অনেক উন্নত মানের। আমাদের প্রাচীন মিশরীয় জীবনের মূল নীতির কথা আপনারা কোনো লিপি অথবা স্মৃতিস্তম্ভে খুঁজে পাবেন না। অথচ আপনারা এগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেন।
আমাদের প্রাচীন মিশরীয় জীবন! স্মিথ বিস্ফারিত চোখে কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, ঈশ্বর, মমির মুখের দিকে তাকান!
অদ্ভুত লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে মমির মুখের ওপর আলো ফেলল। তার গলা থেকে বেদনামাখা বিলাপ ধ্বনি বেরিয়ে এল। বাইরের বাতাস মৃতদেহ সংরক্ষণের কলা-কৌশলকে এটুকু সময়ের মধ্যে অনেকখানি নষ্ট করে ফেলেছে। মমির মুখের চামড়া বিবর্ণ হয়ে গেছে, চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে, বিবর্ণ ঠোঁট দুটো কুঁচকে যাওয়ায় হলুদ দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। কেবল মাত্র কপালের ওপরকার বাদামী চিহ্নটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ হলো সেই মুখ যেটায় কিছুক্ষণ আগেও ছিল যৌবন আর সৌন্দর্য।
দুঃখে আর আতঙ্কে সে হাত ঘষল। তারপর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে স্মিথের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল।
এটা কোনো ব্যাপার নয়, লোকটা কাঁপা কণ্ঠে বলল। সত্যিই এটা কোন ব্যাপার না। আজ রাতে একটা কাজ করার দৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে আমি এখানে এসেছি। কাজটা হয়ে গেছে। আর সব কিছু আমার কাছে মূল্যহীন। আমি যা খুঁজছিলাম তা পেয়েছি। পুরোনো অভিশাপ দূর হয়েছে। এখন ওর সাথে। আমি মিলতে পারব। ওর দেহের কী হলো তা কোনও বিষয় নয়। ওর আত্মা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
এগুলো পাগলের প্রলাপ, স্মিথ বললেন। তাঁর মনে এই বিশ্বাস ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছিল যে তিনি এক পাগলের পাল্লায় পড়েছেন।
সময় নেই, আমাকে যেতে হবে, অ্যাটেনডেন্ট বলল। সুদীর্ঘ কাল ধরে যে সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেই মুহূর্ত এসে গেছে। কিন্তু প্রথমে আপনাকে বাইরে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেব। আমার সাথে আসুন।
বাতি হাতে নিয়ে অ্যাটেনডেন্ট অগোছাল ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। স্মিথ তাকে অনুসরণ করলেন। তারা দ্রুত ঈজিপশিয়ান, অসিরিয়ান আর পারসিয়ান সংগ্রহের ঘরগুলো অতিক্রম করলেন। শেষে বুড়ো দেয়ালের গায়ে একটা ছোটো দরজার পাল্লা মৃদু ধাক্কা মেরে খুলল। দেখা গেল একটা ঘোরানো পাথরের সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। তারা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন। স্মিথ কপালে রাতের ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ পেলেন। এবার উলটো পাশে একটা দরজা দেখলেন, যেটা দিয়ে রাস্তায় বেরুনো যায়। তার ডান পাশে আরেকটা দরজা খোলা, যেটা থেকে বাতির হলুদ আলো প্যাসেজের ওপর পড়েছে। এ ঘরের ভেতরে আসুন, অ্যাটেনডেন্ট সংক্ষেপে বলল।
স্মিথ ইতস্তত করতে লাগলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে এই অভিযানের সমাপ্তি বুঝি এখানেই ঘটবে। যদিও কৌতূহল অমীমাংসিত রেখে যেতে পারছেন না তিনি। তাই অদ্ভুত লোকটার সাথে আলোকিত ঘরটায় ঢুকলেন।