আমরা এতক্ষণে হার্লো ও কার্ডোস্ট্রিটের মোড়ে চলে এসেছি। শুধু ঠাণ্ডা নয়, ভয়েও গা কেমন হিম হয়ে আছে আমার। এরকম গল্প হজম করা মুশকিল। তবে কি না পৃথিবীতে অনেক আজব ঘটনাই ঘটে।
জর্জ কেলসো নামে এক লোককে চিনতাম আমি। ব্যাঙ্গর পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টে কাজ করত। পনেরো বছর সে কাটিয়েছে মাটির নিচে পানির পাইপ আর বৈদ্যুতিক তার মেরামতের কাজে।
অবসর নেয়ার তখন মাত্র দুবছর বাকি। একদিন সে চাকরিটা ছেড়ে দিল। ফুল্কি হ্যান্ডম্যান ওকে চিনতো। সে বলেছে জর্জ একদিন এসেক্সের একটি ড্রেনের পাইপ সারাতে হাসি মুখে, স্বভাবসুলভ ঠাট্টা মশকরা করতে করতে মাটির নিচে গিয়েছিল।
পনেরো মিনিট পর যখন সে উপরে উঠে এল, তার সমস্ত চুল বরফের মতো সাদা, চাউনি দেখে মনে হচ্ছিল নরক দর্শন করে এসেছে। সে সোজা ওয়ালির স্পাতে ঢুকে আকণ্ঠ মদপান শুরু করে।
মদ খেয়ে খেয়ে দুবছরের মাথায় মারা যায় জর্জ। ফ্রাঙ্কি ওর সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছিল সিউয়ার পাইপে কী দেখে ভয় পেয়েছে জর্জ। জর্জ ফ্রাঙ্কিকে জিজ্ঞেস করেছিল সে কোনোদিন কুকুর সাইজের মাকড়সা দেখেছে কি না। ঘটনা কতটা সত্য আর কতটা অতিরঞ্জিত আমি জানি না, তবে পৃথিবীতে নিশ্চয় এমন ঘটনা ঘটে যা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষকেও পাগল বানিয়ে ছাড়ে।
আমরা রাস্তার মোড়ে মিনিট খানিকের জন্য দাঁড়ালাম। যদিও তীব্র ঠাণ্ডা বাতাসের চাবুক আছড়ে পড়ছে গায়ের উপর।
টিমি কী দেখল? জিজ্ঞেস করল বাটিং।
টিমি বলেছে ও ওর বাবাকেই দেখেছে, জবাব দিল হেনরি। তবে সারা গায়ে ধূসর জেলি মাখা। পরনের জামাকাপড় যেন গলে গিয়ে লেগে ছিল শরীরের সঙ্গে।
ঈশ্বর! বলল বার্টি।
রিচি আবার কম্বল দিয়ে মুড়ে নেয় নিজেকে এবং বাতি নিভিয়ে দেয়ার জন্য চেঁচাতে থাকে বাচ্চাটার উদ্দেশ্যে।
ফাঙ্গাস বা ছত্রাকের মতো দেখাচ্ছিল বোধহয় ওকে, মন্তব্য করলাম আমি।
হ্যাঁ, সায় দিল হেনরি। অনেকটা সেরকমই।
পিস্তলটা রেডি রেখো, বলল বার্টি।
রেডি আছে, বলল হেনরি। আমরা আবার হাঁটা দিলাম।
রিচি গ্রেনাডাইনের অ্যাপার্টমেন্ট হাউজটি পাহাড়ের প্রায় চূড়াতে, ভিক্টোরিয়ান আদলে গড়া। এগুলোকে এখন অ্যাপার্টমেন্ট হাউজে রূপান্তর ঘটানো হচ্ছে। বার্টি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রিচি তিনতলায় থাকে। আমি সুযোগ বুঝে হেনরির কাছে জানতে চাইলাম এরপরে বাচ্চাটার কী হলো।
নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে, এক বিকেলে বাচ্চাটা বাসায় এসে দেখে তার বাবা প্রতিটি জানালা চাদর দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে। ঘর থেকে বদ গন্ধটার তীব্রতা বেড়েছে আরও, কেমন ফল পচা গন্ধ।
সপ্তাহখানিক ধরে রিচি তার ছেলেকে দিয়ে চুল্লিতে বিয়ার গরম করাল। ভাবা যায়? বেচারা দিনের পর দিন ওই বাড়িতে বসে চুল্লিতে বিয়ার গরম করছে আর শুনছে চুক চুক করে তা পান করছে তার বাবা।
এরকম চলল আজ পর্যন্ত। আজ বাচ্চাটা ঝড়ো হাওয়ার কারণে ছুটি পেয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছিল বাসায়।
ছেলেটি বলেছে সে সোজা ঘরে ঢুকে পড়ে, আমাদেরকে বলল হেনরি। উপরতলায় হলঘরে একটি বাতিও জ্বলছিল না–টিমির ধারণা ওর বাবা সবগুলো বাল্ব ভেঙে রেখেছে। তাই প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে দরজার সামনে আসতে হলো ওকে।
এমন সময় শুনতে পেল কিছু একটা নড়াচড়া করছে ওখানে, হঠাৎ টিমির মনে পড়ল তার বাবা সারাদিন কী করে সে সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। বাবাকে সে গত একমাসে বলতে গেলে চেয়ার ছেড়ে নড়তেই দেখেনি। তার কি বাথরুমে যাওয়ারও প্রয়োজন হয় না!
দরজার মাঝখানে একটা ফুটো ছিল। ফুটোর মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে কৌশলে ছিটকিনি খুলে ফেলল টিমি। তারপর একটা চোখ রাখল ফুটোতে।
আমরা রিচির বাড়ির সামনে চলে এসেছি। আমাদের সামনে উঁচু, নোংরা একটা মুখের মতো ঝুলে আছে বাড়িটি। তিনতলার জানালা বন্ধ। অন্ধকার। যেন কেউ কালো রঙ মেখে দিয়েছে জানালায়, যাতে বাইরে থেকে ভিতরে কী হচ্ছে বোঝা না যায়।
তিন
অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল টিমির। তারপর প্রকাণ্ড ধূসর একটা পিণ্ড দেখতে পেল সে, মানুষের আকৃতির মতো নয় মোটেই, মেঝের ওপর গড়িয়ে চলছে, পিছনে রেখে আসছে ধূসর, পিচ্ছিল একটা চিহ্ন। সাপের মতো একটা হাত বাড়িয়ে দিল ওটা–দেয়াল থেকে টান মেরে খুলে নিল একটা তক্তা। দেয়ালের গর্ত থেকে টেনে আনল একটা বেড়াল। এক মুহূর্ত বিরতি দিল হেনরি। তারপর বলল, একটা মরা বেড়াল। পচা। গায়ে কিলবিল করছিল সাদা সাদা পোকা…।
থামো, কাতরে উঠল বার্টি।
ঈশ্বরের দোহাই লাগে বেড়ালটা খেয়ে ফেলে রিচি।
ঢোক গেলার চেষ্টা করলাম, দলা দলা কী যেন ঠেকল গলায়। তখন টিমি এক ছুটে পালিয়ে আসে ওখান থেকে, সমাপ্তি টানল হেনরী।
ওখানে আর যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না, বলল বার্টি। হেনরি কোনও মন্তব্য করল না। বার্টি আর আমার ওপর চোখ বুলাল শুধু।
যাব, বললাম আমি। রিচির জন্য বিয়ার নিয়ে এসেছি না! বার্টি আর কিছু বলল না। আমরা সিঁড়ি বেয়ে সামনের হলরুমের দরজায় চলে এলাম।
সঙ্গে সঙ্গে নাকে ধাক্কা দিল গন্ধটা।
কী যে বিশ্রী, ভয়ঙ্কর বোটকা গন্ধ! বমি ঠেলে এল গলায়।
হলঘরের নিচে একটা মাত্র হলুদ বাতি জ্বলছে টিমটিম করে। সিঁড়িগুলো উঠে গেছে উপরে, মিশেছে অন্ধকারে।