হঠাৎ তিনি সেই পথে একটা আলো দেখতে পেলেন। আলোটা ক্রমশ কাছিয়ে আসছে।
স্মিথ চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। উত্তেজনায় তার স্নায়ু টান টান। আলোটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে থেমে এগুচ্ছে। আলো বহনকারী নিঃশব্দে এগোচ্ছে। তারপরও তার পায়ের টিপটিপ শব্দ শোনা যাচ্ছে।
স্মিথ ভাবলেন মিউজিয়ামে হয়তো চোর ঢুকেছে। তাই তিনি আরও অন্ধকার কোণে সরে গেলেন। আলোটা এখনও দুই রুম দূরে। এবার পাশের রুমে আসল। এখনও কোনো শব্দ নেই।
হঠাৎ করেই বাতির আলোটার পেছনে একখানা মুখ দেখা গেল। মুখের অধিকারীর দেহটা ছায়ায় মোড়ানো। আলোটা মুখের ওপর এমনভাবে পড়েছে, মনে হচ্ছে মুখটা যেন বাতাসে ভাসছে। এই মুখের ওপর চকচকে চোখ দুটো আর কর্কশ চামড়া দেখে ভুল হওয়ার কোনো উপায় নেই। গভীর রাতের রহস্যময় আগন্তুক আর কেউ নয়, সেই অ্যাটেনডেন্ট–যাকেমি. স্মিথ কথা বলার জন্য খুঁজেছিলেন।
লোকটাকে দেখে স্মিথ প্রথমে ভাবলেন কথা বলবেন। বলবেন, কী ভাবে এখানে আটকা পড়েছেন আর বেরুবার রাস্তার কথাও জানতে চাইবেন। কিন্তু লোকটা রুমে ঢুকার পর স্মিথ লক্ষ্য করলেন ওর চলাফেরার মধ্যে কেমন যেন গোপনীয়তার ভাব ফুটে উঠেছে। ওর চোরের মতো ভাব দেখে স্মিথ নিজের ধারণা পাল্টাতে বাধ্য হলেন। বুঝতে পারলেন লোকটা অফিশিয়াল ডিউটি দিতে বের হয়নি। তার পায়ে ফেল্ট সোল স্লিপার। উত্তেজনায় ঘন ঘন শ্বাস নেয়ায় তার বুক দ্রুত ওঠানামা করেছে। মাঝে মাঝে দ্রুত ডানে আর বামে তাকাচ্ছে। দ্রুত নিঃশ্বাসের ফলে আলোর শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছে। স্মিথ অন্ধকার কোণ থেকে তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন। বুঝতে পারলেন, লোকটা গোপনে এখানে এসেছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে।
বুড়ো অ্যাটেনডেন্টের চলাফেরার মধ্যে কোনো ইতস্তত ভাব নেই। সে হালকা কিন্তু দ্রুত পদক্ষেপে একটা বড়ো বাক্সের কাছে গেল। পকেট থেকে চাবি বের করে বাক্সের তালা খুলল। স্মিথ দেখলেন বাক্সটার মধ্যে অনেকগুলো তাক। সবচেয়ে ওপরের তাক থেকে লোকটা একটা মমি বের করল। তারপর যথেষ্ট সতর্কতার সাথে সেটা মাটিতে নামাল। বাতিটা মমির পাশে রাখল। সে মমির পাশে প্রাচ্যদেশীয় ভঙ্গিতে বসল। এরপর কাঁপা কাঁপা হাতে মমিটাকে ঢেকে রাখা দামি লিনেনের কাপড় খুলতে শুরু করল। কাপড়ের ভাঁজগুলো খুলতেই ঘরটা এক তীব্র সুগন্ধে ভরে গেল। প্রতিটা ভাঁজ খোলার সাথে সাথে সুগন্ধি কাঠের টুকরো এবং মশলার গুঁড়ো মেঝেতে পড়ছে।
জন স্মিথ পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, এই মমিটি আগে কখনও খোলা হয়নি। ঘটনাটা তাকে প্রচণ্ড কৌতূহলী করে তুলেছে। প্রচণ্ড কৌতূহল তার সমস্ত দেহকে শিহরিত করে তুলল। তাঁর পাখির মতো মাথাটা দরজার পেছন থেকে ক্রমশই বেরিয়ে আসতে লাগল। যখন চার হাজার বছর পুরোনো দেহটার মাথা থেকে শেষ ভাঁজটা সরানো হলো তখন বিস্ময়ে তার গলা থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল।
প্রথমেই বুড়ো লোকটার হাতে একরাশ ঘন কালো চুল ঝরে পড়ল। দ্বিতীয় ভাঁজ খুলতেই দেখা গেল ফর্সা কপাল। সেখানে ধনুকের মতো বাঁকানো সুন্দর দুটি ভ্র। তৃতীয় ভাঁজ খুলতে দেখা গেল দুটি চোখ আর উন্নত নাক। চতুর্থ এবং শেষ ভাঁজ খোলার পর দেখা গেল মিষ্টি একটা মুখ। চিবুকের গড়নটা অপূর্ব। আসলে সমস্ত মুখটা অদ্ভুত সুন্দর। তবে একটুখানি খুঁত রয়েছে।
কপালের মাঝখানে কফি রঙের একটা ক্ষত। মেয়েটার চেহারা দেখে প্রাচীন মিশরীয়দের মৃতদেহ সংরক্ষণের অপূর্ব কলাকৌশল সম্পর্কে চমৎকার ধারণা পাওয়া যায়। মুখখানা দেখতে দেখতে স্মিথের চোখ দুটো ক্রমশ বিস্ফারিত হয়ে উঠল। তাঁর গলা দিয়ে সন্তুষ্টির শব্দ বেরিয়ে এলো।
মেয়েটার চেহারা স্মিথের ওপর যতখানি প্রভাব বিস্তার করল বুড়ো অ্যাটেনডেন্টের ওপর প্রভাবের কাছে তা কিছুই নয়। সে উত্তেজিত ভাবে শূন্যে হাত ছুঁড়ে কর্কশ কন্ঠে কী যেন বলল। তারপর মমির পাশে শুয়ে পড়ল। মমিকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁট আর কপালে বারবার চুমু খেতে লাগল। Ma petite! সে ফরাসী ভাষায় গুঙিয়ে বলল। Ma pauvrepetite! প্রচণ্ড আবেগে তার কণ্ঠস্বর বুজে গেল। তার মুখের অসংখ্য বলিরেখা তির তির করে কাঁপছে। কিন্তু স্মিথ প্রদীপের আলোয় দেখলেন, বুড়োর চকচকে চোখ দুটো শুকনো। সেগুলোতে এক ফোঁটা পানি নেই।
কয়েক মিনিট মমিটাকে জড়িয়ে ধরে সে শুয়ে রইল। সুন্দর চেহারাটার কাছে নিজের মুখ নিয়ে বিলাপ করছে। হঠাৎ সে হেসে উঠল। অজানা ভাষায় কী যেন বলল। তারপর একলাফে উঠে দাঁড়াল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে নতুন কোনও কাজ করার জন্য প্রচণ্ড শক্তি পেয়েছে।
ঘরের মাঝখানে একটা বিরাট গোল বাক্স। স্মিথ জানেন, এতে প্রাচীন মিশরের নানারকম আংটি আর মূল্যবান পাথরের এক চমৎকার সংগ্রহ আছে। বুড়ো অ্যাটেনডেন্ট বাক্সটার কাছে গেল।
বাক্সের তালা খুলে ঢাকনা উঁচু করল। পাশের সরু তাকের ওপর বাতিটা রাখল। পকেট থেকে একটা ছোটো মাটির পাত্র বের করে বাতির পাশে রাখল। তারপর গোল বাক্সটা থেকে এক মুঠো আংটি বের করল। তারপর গম্ভীর এবং চিন্তিতভাবে এক এক করে প্রতিটি আংটিতে পাত্র থেকে একরকমের তরল পদার্থ লাগাতে লাগল। লাগানোর পর প্রতিটি আংটি আলোর সামনে তুলে ধরে দেখতে লাগল। প্রথম দফার আংটিগুলো সম্পর্কে সে আশাহত হয়েছে এটা পরিষ্কার বোঝা গেল। ফলে আংটিগুলোকে অধৈর্যের সঙ্গে গোল বাক্সের ভেতর ছুঁড়ে ফেলল। এরপর আরও এক মুঠো আংটি তুলল।